ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চলে না || সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫১, ৭ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চলে না || সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

এ মুহূর্তে দেশের পাঁচটি পাবলিক তথা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অস্থিরতা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপাচার্য ফারজানা ইসলামের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ। আবরার হত্যার পর এক মাস ধরে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়– বুয়েটে। কবে নাগাদ শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে ফিরবেন, তা অনিশ্চিত। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ১০ দিন ধরে উপাচার্য ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছেন। দুই হলের শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। অন্যদিকে প্রথম বর্ষে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের হলে অবস্থান, সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি না করা এবং বিতর্কিত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত না রাখার দাবিতে আন্দোলন করছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার সমাধান হয়েছে।

যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় পড়েছেন বা পড়িয়েছেন, তারা যখন এগুলো দেখেন তখন হয়তো মনে মনে বলেন, ‘না, এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চলে না’। এই অবস্থায় কী করে পৌঁছল স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর কিংবা সম্ভাবনার দুয়ার খোলা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো? যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য নির্ভর করে শিক্ষকদের যোগ্যতা ও তাদের শিক্ষকসুলভ জীবনাচারণের উপর। তারা শিক্ষার্থীদের কাছে রোল মডেলের মতো।

দেশে উচ্চশিক্ষা চলছে জটিল সমস্যার মধ্যে দিয়ে। প্রধানমন্ত্রীও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অচলাবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন; কঠিন কথা বললেও কিছুটা হতাশাও উচ্চারিত হয়েছে তাঁর কণ্ঠে। বিদ্যাচর্চা সেখানেই বিকশিত হয় যেখানে শিক্ষক-গবেষকরা স্বাধীনভাবে পাঠ্য, পাঠক্রম, মূল্যায়ন, ঠিক করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সহায়কের ভূমিকায় থাকে। চিন্তার সংকীর্ণতায় অসহিষ্ণুতা বাড়ে। আমাদের ভাবতে হচ্ছে তবে কী সেটাই ঘটছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দিন ধরেই একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ কোন উপাচার্যকেই গ্রহণ করতে পারেন না। বর্তমান উপাচার্য ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা। কিন্তু অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের অপরাধ কি ছিল? তাঁকে প্রথম দিন থেকে সহযোগিতা করা হয়নি, আন্দোলন করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাকে বিদায় করা হয়।

জাহাঙ্গীরনগরসহ বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নীতি নৈতিকতা এখন ব্যাপক আলোচিত। উপাচার্যদের দুর্নীতি কতটা প্রমাণ করা যাবে বা যাবে না, সে বিষয়ে তর্ক বৃথা। বৃহত্তর নৈতিকতার দাবি বলবে, শিক্ষকের সাথে ছাত্রদের সম্পর্ক শুধু আইনি সূত্রে বাঁধা নয়। ছাত্রছাত্রীরা যদি কাউকে শিক্ষাক্ষেত্রে নিজেদের সর্বোচ্চ অভিভাবক রূপে দেখতে অস্বীকার করেন, তবে সেই পদটি আঁকড়ে থাকা সেই শিক্ষকের জন্য অনৈতিক।

মাত্র কিছুদিন আগে, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিনকে বিক্ষোভের মুখে ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়েছে। তিনি তার বিরুদ্ধে ছাত্রদের ক্ষোভ আঁচ করতে ভুল করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, খুব অল্পসংখ্যক ছাত্রছাত্রী অশান্তি সৃষ্টি করছে, বাকিরা তার সঙ্গে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো তার বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ ছিল ক্যাম্পাসে। ছাত্রছাত্রীদের এই প্রত্যাখ্যান শিরোধার্য করে পদত্যাগ করলে তার সম্মান বাঁচত।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও সেই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু একটা জনধারণা তৈরি হয়েছে যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অনেকের আচরণই শিক্ষকসুলভ নয়। তারা একেকজন স্ব স্ব ক্যাম্পাসে নির্মম শাসকের ভূমিকা পালন করছেন। আইন তাদের হয়তো এই শাসকের ক্ষমতা দিয়েছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হবার নৈতিক অধিকার তারা হারিয়েছেন কিনা নিজেরাই একদিন সময় করে ভেবে দেখবেন।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলে জ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার অলিখিত নিয়মে। স্বাতন্ত্রই উৎকর্ষের প্রধান শর্ত।  সেই বিবেচনায় উপাচার্যরা কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নন। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অলঙ্কার, বিবেক ও অহঙ্কার। শিক্ষক রাজনীতি যেহেতু আছে, নিশ্চয়ই রাজনীতির রং তাদেরও আছে এবং থাকবে। কিন্তু একবার এই পদে আসীন হলে প্রত্যাশা থাকে যে, তারা রাজনীতির অতিসক্রিয়তার পথে পা বাড়াবেন না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিজেকে ছাত্র-শিক্ষক অবরোধ থেকে মুক্ত করতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেছেন, যে সংগঠনের বিরুদ্ধে আবার তিনি চাঁদাবাজির অভিযোগও এনেছিলেন কয়েক মাস আগে। অভিভাবক হিসাবে উপাচার্য শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সাথে আলোচনা করতে পারতেন। কিন্তু মনে হলো তিনি বেত্রাঘাতের শাসনে বিশ্বাস করেন, তাই ছাত্রলীগকে দিয়ে শায়েস্তা করলেন এবং কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করলেন। বিভিন্ন পক্ষের সাথে কথা বলা ছাড়া কোন সংকটের মীমাংসা ভাবা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও চিন্তা করতে হবে যে, শাসন মানসিকতার প্রয়াস সবসময় সুবিবেচিত নয়। আর যারা আন্দোলন করছেন তারাও বিচার করুন, এ হেন লাগাতার বিক্ষোভ, আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা কতখানি বাড়ায় বা কমায়।

 

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়