ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

২১ আগস্ট: রাজনৈতিক অভিসন্ধির অনুসন্ধান

মারুফ রসূল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৭, ২২ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১০:৪৩, ২১ আগস্ট ২০২১
২১ আগস্ট: রাজনৈতিক অভিসন্ধির অনুসন্ধান

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আর ৩ নভেম্বরের ঘাতকদের রাজনৈতিকভাবে চিনতে পারলেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকারীদের রাজনৈতিক অভিসন্ধির অনুসন্ধান করা যাবে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ও কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর রাষ্ট্রীয় মদদে হত্যাকারীদের রেহাই দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। তৎকালীন রাজনৈতিক সমীকরণের একটি সম্প্রসারিত পাঠ হলো ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট—  বাংলাদেশ দর্শনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অপ-দর্শনকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার আধিপত্যবাদ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং জেলহত্যা মামলার বিচার হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুনীদের অবস্থান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে—  খুনীরা সেটা জানতো। এ কারণেই তারা দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে, হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করে এবং ২১ বছর ধরে মামলার আলামত নষ্ট করে। সর্বশেষ, তারা বঙ্গবন্ধু কন্যা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যার অপচেষ্টা করে।

পঁচাত্তর পরবর্তী অবৈধ সরকারগুলো ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটিই মুছে ফেলতে চেয়েছিল! ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে রাজনৈতিক দলবিধি (পিপিআর) আদেশ জারি করে সামরিক সরকার। যার মোদ্দাকথা ছিল—  রাজনীতি করতে হলে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। সে সময়ের খবরের কাগজে এ বিষয়ক প্রতিবেদনগুলো পড়লে পরিষ্কার হয়ে যায়, এ আদেশ ছিল রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগকে সরিয়ে দেবার চক্রান্ত। কারণ ১৯৭৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ যখন দলের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচি জমা দেন, স্বভাবতই সামরিক সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে। কেনো করে— এটা সে সময়ে জারিকৃত রাজনৈতিক দলবিধির দশম ধারা দেখলেই বোঝা যায়। ‘মৃত ব্যক্তির মাহাত্ম্য প্রচার’ নিষিদ্ধ করে সামরিক সরকারের দেওয়া ঘোষণাতেই এটা সুস্পষ্ট যে, তারা চায়নি আওয়ামী লীগের কোথাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম থাকুক।

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর কুখ্যাত দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শুরু হলে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় থেকেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। জাতীয় সংসদে ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল আইন’ পাস হলে এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট দায়ের করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী কর্নেল ফারুকের মা মাহমুদা রহমান এবং কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খান। ১৯৯৭ সালের ২৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে এ দুটি মামলা খারিজ করে দেন। ১২ মার্চ ১৯৯৭ থেকে ০৮ নভেম্বর ১৯৯৮— এই সময় ধরে চলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার ও রায় প্রদানের কাজ। সুতরাং বিএনপি-জামায়াত সরকার কর্তৃক ২০০১ সাল পরবর্তী রাজনৈতিক হত্যা, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের হত্যা বা ২১ আগস্টের নির্মম গ্রেনেড হামলা ছিল এই খুনীচক্রের বেঁচে যাওয়ার শেষ সুযোগ। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বা ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা মামলা থেকে নিজেদের বাঁচাতেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী দণ্ডপ্রাপ্ত ও পলাতক খুনি মেজর নূরও এই হামলার সঙ্গে জড়িত। হাওয়া ভবনে হামলার পরিকল্পনার বৈঠকে সে উপস্থিত ছিল।

এই সমীকরণ ধরে এগুলেই ১৯৭৫ ও ২০০৪ সালের হত্যাকারীদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় অনেকাংশেই কার্যকর হয়েছে, জেলহত্যা ও ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হয়েছে। কিন্তু হত্যাকারীদের ষড়যন্ত্র থেমে আছে— এ কথা কি নিশ্চিত করে বলা যায়?

কারণ এই হত্যাকাণ্ডগুলোর যে রায় আদালত দিয়েছে, সেগুলো পাঠ করলেই বোঝা যায়— একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রমূলক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটানো হয়েছিল। পঁচাত্তরের পর মোশতাক সরকারকে যেমন এক ঘণ্টার মধ্যেই স্বীকৃতি দিয়েছিল পাকিস্তান, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত গ্রেনেড আর গুলিও এসেছিল পাকিস্তান থেকেই। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে সামরিক ও গোয়েন্দা বিভাগ ছিল সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ, আর ২০০৪ সালে আসামির তালিকাতেই উঠে এসেছে এদের নাম। জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম পঁচাত্তরেও খুনীদের তাঁবেদারি করেছে, ২০০৪ সালেও তাদের চরিত্রের কোনো বদল ঘটেনি। ষড়যন্ত্রের নতুন জালে কুশীলবের ভূমিকায় এসেছে নতুন পাত্র-পাত্রী। আদালতের রায়ে বিচারকগণ বারবার এই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন পরোক্ষভাবে।

ঘটমান বর্তমানে চোখ রেখে মাথা খাটালে ‘হ্যামলেট’- এর মার্সেলাসের উক্তিটিই বারবার মনে পড়ে— Something is rotten in the state of Denmark. ‘ডেনমার্ক’- এর স্থলে ‘বাংলাদেশ’ বলতে ইচ্ছে করে না।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়