ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ঈদে মিলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আমরা

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩৫, ৩০ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ০০:০০, ৩১ অক্টোবর ২০২০
ঈদে মিলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আমরা

মানবতার মুক্তিদূত, সব নবীর সরদার, ইহ ও পরকালের নেতা মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিবসের আনন্দকে আরবিতে ঈদে মিলাদুন্নবি বলা হয়। ঈদ অর্থ খুশি। মিলাদ-এর অর্থ জন্মলগ্ন বা ক্ষণ অর্থাৎ জন্ম। আর নবী অর্থ সংবাদবাহক, বার্তাবাহক, প্রেরিত দূত ইত্যাদি।

ইসলামের মূল কথা হচ্ছে তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত। এই তাওহিদ মানে আল্লাহর একত্ববাদ ঘোষণা, রিসালাত মানে আল্লাহর বাণী সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মিশন, আর আখিরাত অর্থ মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ও জমায়েত বা হাশর এবং মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে ভালো-মন্দের বিচার ও এর পুরস্কার ঘোষণা ও প্রদান ইত্যাদির মহিমাময় সময়।

এই রিসালাত নিয়ে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার প্রেরিত রাসূল বা নির্বাচিত দূত অথবা বার্তাবাহক বা মেসেঞ্জার হিসেবেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ধরাতে আগমন করেছিলেন।

এখন থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে, আরবের মরু প্রান্তরে, মা আমিনার গর্ভে, ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে, ১২ রবিউল আউয়ালে, এই মহামানব, তৎকালীন জাহিলি যুগের অন্ধকার দূর করে, বিশ্বকে আলোকিত করে, এই পৃথিবীতে পদার্পণ করেছিলেন।

তার পিতার নাম আব্দুল্লাহ। জন্মের পূর্বে তার পিতা এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। শিশু বেলায় তিনি তার মাকেও হারান। বাবা এবং মা হারা আরবের এই শিশুটি হালিমা সাদিয়া নামের এক বিদুষী নারীর স্তন্যপান করে বড় হতে থাকেন। তখন থেকেই এই শিশুর মধ্যে ব্যতিক্রমী স্বভাব লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া মহান সৃষ্টিকর্তা এই মহামানবকে নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ হিসেবে তৈরি করার প্রস্তুতি শুরুর সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। যুবক বয়সে সকলের কাছে বিশ্বাসী বা আল আমিন নামে পরিচিত হয়েছিলেন। ২৫ বছর বয়সে আরবের সুপরিচিত একটি উচ্চ বংশের ৪০ বছরের মহিলা ব্যবসায়ী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহাকে বিয়ে করেন। শুরু হয় তার দাম্পত্য জীবন। ৪০ বছর বয়সে তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুওয়াত লাভ করেন। সংসার জীবন, ব্যবসায়ী জীবনের পাশাপাশি নবুয়তের দায়িত্ব, মহান আল্লাহর রিসালাত প্রচারের কাজ করেন চুপে চুপে। আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার করার জন্য তিনি আল্লাহর নির্দেশে ধীরে ধীরে সম্মুখে আসতে থাকেন। মক্কার মুশরিক, কাফির, কুরাইশ ও অন্যরা তাকে নির্যাতন শুরু করে। আল্লাহর নির্দেশে তিনি মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় হিজরত করে সেখানেই একটি মডেল হিসেবে, ইসলামী  কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করেন। সেখানে মুসলিম-অমুসলিম, ইহুদি-খ্রিষ্টান সকল মানুষই বসবাস করত। তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য একটি চুক্তি, যা পরবর্তীতে মদীনার সনদ বা ‘চার্টার অব মদিনা’ নামে পরিচিত হয়।

মদিনায় রাষ্ট্র পরিচালনার পাশাপাশি ইসলাম প্রচার, বিভিন্ন আক্রমণ ঠেকানোর জন্য যুদ্ধ-বিগ্রহ শেষে, মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবার জন্মভূমি মক্কার সাথে সম্পর্কিত হন। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি তার উপর অত্যাচারীসহ সকল কাফির-মুশরিকের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এভাবে একজন ইসলামী রাষ্ট্রের সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্বে পরিচিত হয়ে আছেন। ৬৩ বছর বয়সে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেন।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এই জন্মদিবসকে ঘিরে, পাক-ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন ধরনের উৎসব, অনুষ্ঠান ইত্যাদি রয়েছে। একশ্রেণীর মুসলিম, যারা শুধু ১২ রবিউল আউয়াল এর আগ থেকে মিলাদুন্নবি উদযাপন এর জন্য সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা শুরু করেন। আবার অন্য একদল মুসলিম রয়েছেন যারা শুধু মিলাদুন্নবী উদযাপনকে মঙ্গলের বিষয় মনে না করে সিরাতুন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিরোনাম দিয়ে সারা বছরই রাসূলুল্লাহ সা. এর জীবনী নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, মিলাদুন্নবি বা নবীর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ১২ রবিউল আউয়াল যেমনি করে অনুষ্ঠান, শোভাযাত্রা, জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবি নামের অনুষ্ঠান করা হয়, তেমনি করে সারা বছরই মিলাদ পড়া হয়। আর এই মিলাদ আরবি শব্দ থেকে- যেটা এই আলোচনার প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে, জন্ম অর্থে সারা বছরের বিভিন্ন দিন মিলাদ হতে পারে না। কিন্তু একশ্রেণীর মুসলিম যারা কোনোভাবেই বিষয়টি স্বীকার করতে চান না, তারা এক ধরনের জোর খাটিয়ে এই জাতীয় আমল বা কাজ বাস্তবায়ন করে চলেছেন।

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনকে আমাদের জীবনে না এনে, অথবা তার জীবন থেকে কোনো আদর্শ গ্রহণ না করে, অথবা তাঁকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করে, অথবা তার কথা ও কর্মকে বিকৃত করে প্রচার করে, যত আনন্দ বা খুশি করি না কেন, যত ঈদ পালন করি না কেন, যত ঈদে মিলাদুন্নবি উদযাপন করি না কেন, তাতে কোনো সফলতা নেই। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বছরের ৩৬৫ দিনই আমাদের কাছে স্মরণীয়, আমাদের কাছে বরণীয়, আমাদের কাছে অনুসরণীয়, আমাদের নেতা, আমাদের শ্রেষ্ঠতম অভিভাবক, এতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু রবিউল আউয়াল এর ১২ তারিখ এলেই আমরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে সার্বিক অনুষ্ঠানাদির মধ্যে ব্যাপৃত থাকবো-এ জাতীয় কল্পনা বা আচার-অনুষ্ঠান থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। আরও একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, এমনিভাবে শুধু জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আটকে রাখলে তাতে আমাদের কখনোই কল্যাণ হবে না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ তার অমীয় বাণী আল কুরআনে অনেক কিছুই বলেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘‘(হে রাসুল!) আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে তোমরা আমাকে অনুসরণ করো, তবেই আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।’’ (আল কুরআন) আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘তোমাদের জন্য রাসূল এর জীবন চরিতে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’’ (আল কুরআন) অতএব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ না করে, তার সুন্নতকে ভালো না বেসে, দ্বীন ও ধর্মের মধ্যে নব নব আবিষ্কৃত বিদআতসমূহকে গ্রহণ করে, কখনোই মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রকৃত উম্মত দাবি করা যাবে না।

এবারের এই ঈদে মিলাদুন্নবি উপলক্ষে তাই আমাদের উচিত শপথ গ্রহণ করা, যেন আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত পথে চলতে পারি, তার দেখানো সুন্নত অনুযায়ী সকল আমল করতে পারি, দেশের কল্যাণে-মানবতার কল্যাণে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত পথে চলতে পারি, সর্বোপরি দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা অর্জন করা যায় সেইভাবে জীবন চালাতে পারি। আর সেই জন্য আল্লাহর দরবারে তাওফিক কামনা করছি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমিন!

ঢাকা/শান্ত

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়