ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

পিটিয়ে মানুষ হত্যা: গণমাধ্যমের ভূমিকা

মামুন রশীদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৪, ১৪ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৭:৫১, ১৪ নভেম্বর ২০২০
পিটিয়ে মানুষ হত্যা: গণমাধ্যমের ভূমিকা

সংবাদপত্রের পাতায় প্রায়ই উঠে আসছে পিটিয়ে মানুষ হত্যার খবর। বিভৎস ও পৈশাচিক বিকৃতি যেন ঘিরে ধরছে আমাদের। যার কুফল স্পষ্ট হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা খবরে প্রতি সকাল হয়ে উঠছে ভারী ও বিষণ্ন। দেখেশুনে প্রশ্ন জাগে, এ কোন নিষ্ঠুর খেলায় মেতেছি আমরা? কী করে অবলীলায় পিটিয়ে মানুষ হত্যায় লিপ্ত হচ্ছি? এ কোন বোধ আমাদের তাড়িয়ে নিচ্ছে ক্রমশ অন্ধকারের দিকে? এ কোন বিপজ্জনক পথে হাঁটছি? সময় আমাদের কোথায় ঠেলে দিচ্ছে? মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যার যেসব বিভৎস বর্ণনা আমাদের পড়তে হয়েছে সংবাদপত্রের পাতায়, তার কয়েকটি তুলে ধরছি শুরুতেই।

পিটিয়ে হত্যার সর্বশেষ নৃশংসতার শিকার, নারায়ণগঞ্জের নলুয়াপাড়া এলাকার ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, নিহতের ছোট ছেলে আলামিন ভাড়া থাকতো শহরের একটি বাড়িতে। বিবাদের শুরু ভাড়ার টাকা নিয়ে। মাত্র পনেরশ টাকা বাকি পড়েছিল। তারই জের ধরে পিটিয়ে আহত করা হয়  মেহেদি হাসান ও তার ছেলে আলামিনকে। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মেহেদী হাসানকে মৃত ঘোষণা করেন।

গত ৯ নভেম্বর, পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা, মানসিক রোগের চিকিৎসা নিতে গিয়ে পিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উন্নত চিকিৎসার জন্য ৯ নভেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশের সিনিয়র এএসপি শিপনকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ সময় সেখানে কোনো মানসিক রোগের চিকিৎসক না থাকলেও হাসপাতালের কর্মচারীরা চিকিৎসা দেওয়ার কথা বলে তাকে একটি কক্ষে নিয়ে মারধর করে। মারধরের কয়েক মিনিটের মাথায় তার মৃত্যু হয়।

এই ঘটনার মাত্র একদিন আগে, ৮ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে সংস্কৃতিকর্মী, তরুণ কবি সৈয়দ মুনাব্বির আহমেদ তননকে। তননকে হত্যার কারণ হিসেবে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, নাসিরনগরে চলছিল সরকারি খালে বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধা পাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। সৃষ্ট হয় জলাবদ্ধতা। এভাবে বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ আটকে দেওয়ার প্র্রতিবাদ করেন তনন। এই প্রতিবাদই তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। দুর্বৃত্তরা তাকে নির্মমভাবে পেটায়। আহত তনন জেলা হাসপাতাল থেকে ঢাকায় নেওয়ার পথে মারা যায়।

এর আগে, গত ২৯ অক্টোবর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আবু ইউনুস মো. সহিদুন্নবী জুয়েলকে। সবচেয়ে ভয়াবহ এবং জঘন্যতম বিষয়, পিটিয়ে হত্যার পর নিহত জুয়েলের লাশ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ যে অভিযোগ তুলে জুয়েলকে হত্যা করা হয়েছে, সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে সে অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। প্রতিবেদনের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট সংবাদমাধ্যমে না এলেও, সংবাদমাধ্যমের কাছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক বলেছেন, ‘এটা ছিল স্রেফ গুজব’। 

মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে দেশের চারটি জেলায় চারজনকে পৃথক পৃথক কারণে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। যা সত্যিকার অর্থেই বেদনার, ভীতিকর এবং আগামীর জন্য অশনি সংকেত। পিটিয়ে হত্যার এই সংস্কৃতি যদিও একদিনের নয়, আজকেরও নয়। আমাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে ওয়াজ মাহফিলে প্রধান অতিথি না করায় দুলু মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তার অপরাধ ছিল স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে প্রধান অতিথি না করা। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে চেয়ারম্যানের সমর্থকরা মাহফিলের আয়োজক দুলু মিয়াকে বেধড়ক মারধর করে, এতে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। এত দূরের ঘটনা যদি আমাদের মনে না থাকে, তাহলে আরও সাম্প্রতিক একটি উদাহারণ দেই। এই সেদিন, মানে চলতি বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে পাবনার ঈশ্বরদীতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে হৃদয় নামের এক যুবককে। তার অপরাধ সে এলাকারই একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, হৃদয়ের এই প্রেমে মেনে নেয়নি মেয়েটির পরিবার। তাই মেয়েটির ফোন থেকে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে হৃদয়কে ডেকে নিয়ে মারধর করে। মারপিটের একপর্যায়ে হৃদয়ের মৃত্যু হলে তাকে ফেলে যাওয়া হয় ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এই দুটি নৃশংসতার মধ্যে সময়ের যদিও ব্যবধান রয়েছে, কিন্তু তারপরও এ দু’টি ঘটনা আমাদের নাগরিক মনে তেমন আলোড়ন তোলেনি। হয়তো আমরা অধিকাংশই এরকম দূরবর্তী ঘটনাগুলো ভুলে যাই। এর পেছনে হয়তো সমাজের দূরবর্তী এবং অনালোচিত অংশ- এরকম ভাবনা কাজ করে।  

কিন্তু গত বছর এরকম কাছাকাছি সময়ে (অক্টোবরে) শুধু সন্দেহের বশে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার কথা আমরা ভুলে যাইনি। আবরারকে সেসময় হত্যা করা হয়েছিল শুধু সন্দেহে। সন্দেহ ছিল আবরার ফাহাদ শিবির কর্মী। শুধু এই অপরাধেই তাকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই  নৃশংসতার কথা আমরা ভুলিনি, কারণ সংবাদমাধ্যম প্রতিনিয়ত আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে আবরারের ওপর নৃশংসতার কথা, তাকে জঘন্য এবং হৃদয়হীন ভাবে হত্যার কথা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে ঝড় তুলেছে। ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। মানুষের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ, ক্ষোভের ফলও মিলেছে হাতে হাতে। যার ফলে প্রশাসনও ত্বরিৎ ব্যবস্থা নেয়। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত হওয়া হত্যাকারীরা দ্রুত গ্রেপ্তার হয়। বিচার প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়। কিন্তু আবরার ফাহাদের হত্যার জঘন্যতার বিরুদ্ধে যেভাবে আমাদের সম্মিলিত আওয়াজ উঠেছিল, তা একইভাবে জুয়েল অথবা তনন অথবা অন্যদের বেলায় ওঠেনি। ওঠেনি বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধেও। ফলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অতীতে ঘটা অনেক নৃশংস হত্যাকাণ্ডেরই বিচার না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আশঙ্কা করি, অনেক ভুক্তভোগী পরিবারই সচেতন ও সক্রিয় না হওয়ায় এবং তাদের পাশে সামাজিকভাবে মানুষের অনুপস্থিতির কারণেই হয়তো অনেক ঘটনা নীরবেই হারিয়ে যায়। তাই প্রতিটি অপরাধ সমান গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। হত্যা সবসময়ই ঘৃণার, হত্যা সব সময়ই জঘন্য আপরাধ। এ ধরনের কোনো অপরাধকে, কোনো অপরাধীকেই এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এই যে প্রতিনিয়ত একটির পর একটি বেদনাদায়ক ঘটনার সাক্ষী হতে হচ্ছে আমাদের, এ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। দলবেঁধে একজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যার পেছনে কি এমন কারণ রয়েছে, তা আমাদের খুঁজে দেখার সময় এসেছে। আমরা কেন এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে উৎসাহিত হয়ে উঠছি? কেন একজন মানুষের ওপর অন্যরা দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে? কোন পৈশাচিক উল্লাসে মানুষকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে? অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের পেছনেই রয়েছে খুব তুচ্ছ কারণ।

আমরা আবরারের ওপর ঘটা নৃশংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি, আমরা বিশ্বজিৎতের ওপর যে বর্বরোচিত এবং ঘৃণ্য হামলার মধ্য দিয়ে তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছি। এসব ঘটনার প্রতিবাদে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছে, প্রতিকার চেয়ে রাস্তায় নেমেছে। তার ফলও মিলেছে। কিন্তু অন্যান্য সকল হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধেই আমরা তেমন সরব নই। এমনকি আমাদের সংবাদমাধ্যমও বেশিরভাগ সময় শুধু তাৎক্ষণিক অপরাধের বিবরণ পেশ করেই দায়িত্ব শেষ করছে। সংবাদমাধ্যমের পাতায় যেভাবে অপরাধের বর্ণনা আসে, অনেক সময় ঠিক সেভাবে অপরাধীর সাজা প্রাপ্তির খবর গুরুত্ব পায় না। চাপা পড়ে থাকা অনেক খবরের ফলোআপ প্রকাশ পায় না। প্রতিদিন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ খবরের ভারে চাপা পড়ে যায় সক্রিয় না হওয়া, সামাজিকভাবে মানুষকে পাশে না পাওয়া পরিবারগুলোর খবর। এতে হয়তো অপরাধীরা কিছুটা ছাড় পায়। তারা আরো উৎসাহী হয়ে ওঠে। 

মানুষকে এভাবে নৃশংসভাবে হত্যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কোনো ঘটনাকেই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। শুধু তাৎক্ষণিক সংবাদের বিবরণ হাজির করেই সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না বলেই মনে করি। একটি অপরাধের বিবরণ যে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদপত্রে স্থান পায়, সেই একই গুরুত্ব অপরাধীর সাজা নিশ্চিতের খবরও দাবি করে। একইভাবে, যে ঘটনাগুলো সময়ের চাপে চাপা পড়ে যায়, দীর্ঘসূত্রিতার শিকার হয়, সেগুলোকেও একই গুরুত্ব দিয়ে খুঁচিয়ে বের করে আনা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নিউজ ভ্যালু নির্ধারণ হওয়া উচিত অপরাধের গুরুত্ব বুঝে, ব্যক্তির নয়।

লেখক: কবি, সাংবাদিক

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়