ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান

মাহফুজা হিলালী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৪:১৫, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০
মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে জনযুদ্ধ। এটা রাজা-বাদশার যুদ্ধ ছিল না, কিংবা শুধু সেনাবাহিনীর যুদ্ধ ছিল না। দেশের সবাই যুদ্ধে সম্পৃক্ত ছিলেন। যুদ্ধ সময়ে তিন কোটি চুয়াত্তর লাখ নারী ছিলেন। তারা কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেটা হোক সম্মুখযুদ্ধে কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে কিংবা নিজেদের জীবনযুদ্ধে (যে জীবনযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের কারণেই হয়েছিল)। অন্তত এ কথা বলা যায় রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী তথা স্বার্থান্বেষী যুদ্ধবিরোধী ছাড়া সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। তাই নারীর অবদান অস্বীকার করা বা ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। নারী দু’রকমভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন; প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং পরোক্ষ অংশগ্রহণ। আলোচনায় দেখানোর চেষ্টা করবো নারী কখন কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ্রহণ করেছেন, কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কতটা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, কতটা দুর্বিসহ পথ অতিক্রম করেছেন এবং আজও তাঁদের যুদ্ধ কীভাবে চলছে।

নারীর যাত্রাপথ সরল নয়। হোক যুদ্ধদিনে বা স্বাভাবিক সময়ে। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামে নারী অংশ নিয়েছেন। করেছেন সাংগঠনিক কাজ, থেকেছেন রাজপথে। বায়ান্নর ২১শে ফেব্রুয়ারি নারীই প্রথম পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল সমাবেশ করেছিলেন। পুলিশের লাঠিচার্জ এবং গুলিতে এদের অনেকেই গুরুতর আহত হয়েছিলেন। অনেক নারী গ্রেফতারও হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে ১৪ জন নারী আইন পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬০ সাল থেকে সক্রিয় হতে শুরু করে গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি, ওয়ারী মহিলা সমিতি, আপওয়া, নিখিল পাকিস্তান সমাজকল্যাণ সমিতি ইত্যাদি। তাঁরা সংবিধানে নারীর সম-অধিকারের বিধানের জন্যও আন্দোলন করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে সুফিয়া কামাল, সানজিদা খাতুন, রোকেয়া রহমান কবীর প্রমূখ নারীনেত্রীরা দাঙ্গাবিরোধী কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৬৬-এ ৬ দফা আন্দোলনে ৫০০ ছাত্রী সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি সুফিয়া কামাল নিজের বাড়িতে সভা করেছিলেন এবং কারফিউ চলাকালীন শহীদ মিনারে আড়াই হাজার নারী সমাবেশ করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অনেক নারী সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁরা ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণা, নির্বাচন কেন্দ্রে এজেন্ট হওয়া ইত্যাদি কাজ করেছেন। গ্রামে অনেক বৃদ্ধ মহিলাদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার সামর্থ ছিল না। তাদের বাঁশের দোলনা বানিয়ে কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হতো। মেয়েরা সেই বৃদ্ধাদের ভোট দিতে সব ধরনের সাহায্য করতেন। মহুকমা, থানা এবং গ্রামে অনেক নারী নির্বাচনি কাজ করেছিলেন, স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছিলেন।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের উদ্যোগে নিয়মিত কুচকাওয়াজ ও প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তেলন করা হয়েছিল। সে সময় পল্টন ময়দানে ১০ প্লাটুন জয় বাংলা বাহিনীর এক প্লাটুন ছাত্রী ছিলেন। এই ছাত্রীদের হাতে ডামি রাইফেল ছিল। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বাহিনী ‘বাংলাদেশ ডে’ পালন করে। এখানে মেয়েদের মধ্যে শামসুর নাহার ইকু পতাকা হাতে সামনে চলেন। ফোরকান বেগম, সাকী, কাওসার ঝুনু নেতৃত্ব দেন। তাঁদের সাথে অন্য মেয়েরাও ছিলেন। শুধু ঢাকাতেই নয়, বিভাগীয় শহরগুলোতেও নারীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭১-এর ৯ মার্চ চট্টগ্রামে জেএম সেন হলে মহিলা আওয়ামী লীগ-এর সভা হয়েছিল। এখানে বক্তৃতা করেছিলেন মেহেরুন্নেসা বেগম সরাফত উল্লাহ, বেগম নাজনীন, বেগম কামরুন্নাহার, বেগম মুছা খান, কুন্দপ্রভা সেন প্রমূখ। ১১ মার্চ চট্টগ্রাম পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শহরে লাঠি মিছিল হয়েছিল। ১৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের উদ্যোগে ১২ নম্বর তোপখানায় সাধারণ সভা হয়েছিল। সিরাজগঞ্জ শহরে এবং মহুকুমার থানা শহরে অনেক মেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। সত্তর-এর নির্বাচনের সময় প্রতিদিন মিছিল হতো। মিছিলের অগ্রভাগে থাকতেন মেয়েরা। তাঁরা নৌকা পাড়ের শাড়ি পরে মিছিলে যোগ দিতেন। এঁরা হলেন সৈয়দা ইসাবেলা, মেহেরনিগার এলাহী, আতিয়া সুলতানা, এলিজা সিরাজী, সাফিনা লোহানী, সখিনা তালুকদার, মিনা, লতা, খনা নিয়োগী, শিরিন, বীণা, হাসিনা, মিনি প্রমুখ। এরা পোস্টার লিখতেন, লিফলেট লিখে প্রেসে নিয়ে যেতেন। প্রেস থেকে ছাপানো লিফলেট বিতরণও করতেন।

এই যে নারীরা সাংগঠনিকভাবে তৎপর ছিলেন তাঁদের জানিয়ে কিংবা না জানিয়ে বাংলাদেশের সমস্ত গ্রামে-গঞ্জে মেয়েরা বাংলাদেশের হয়ে কাজ করেছেন। ৭ই মার্চের পর স্কুলে স্কুলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বলেছেন, ছাত্রছাত্রীদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছেন। এঁরা অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও কাজ করেছিলেন। শাহজাদপুরের বেলতৈল উচ্চ বিদ্যালয়ের মমতাজ মহল এবং ঊষা নির্বাচনে এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন। ৭ই মার্চের ভাষণের পর স্কুলে স্কুলে ৭ই মার্চে-এর ভাষণ শোনাতেন মমতাজ মহল, মীরা, আনোয়ারা প্রমুখ। এঁরা কাজ করেছিলেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে। নিজেরা দলগত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়ার মাধ্যমে কাজগুলো করতেন। এ রকম ছোট উদ্যোগগুলোর মিলিত ফলেই দেশের স্বাধীনতা এসেছিল।

যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর নারীর কর্মপন্থা বিভিন্ন রকম হয়ে যায়। যুদ্ধকালে নারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ যেভাবে ছিলো: 
নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ:
১. মুক্তিযুদ্ধের আগে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ও বিভিন্ন আন্দোলনে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ
২. সংগঠক হিসেবে নারী
৩. গেরিলা যুদ্ধে নারী
৪. শব্দ সৈনিক হিসেবে নারী
৫. চিকিৎসা ও সেবা ক্ষেত্রে নারী
৬. অস্ত্র লুকিয়ে রাখায় নারী
৭. খাদ্য সরবরাহে নারী 
৮. খবর আদান-প্রদানে নারী
৯. মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখায় ভূমিকায় নারী
১০. রাঁধুনীর ভূমিকায় নারী
১১. নির্যাতিত নারী

পরোক্ষভাবে নারীর অংশগ্রহণ:
১. মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে নারী
২. মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে নারী
৩. মুক্তিযোদ্ধার বোন হিসেবে নারী
৪.  প্রাপ্তবয়স্ক এবং আতঙ্কিত নারী
৫. সে সময়ে গর্ভবতী নারী
৬. গৃহহীন নারী
৭. গৃহবন্দী নারী

মুক্তিযুদ্ধে নারী সংগঠক হিসেবে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁরা হলেন মতিয়া চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, নূরজাহান মুরশিদ, মমতাজ বেগম প্রমূখ। প্রবাসিদের সংগঠিত করেছিলেন আশালতা সেন। তিনি তখন নিউ ইয়র্কে ছিলেন। ডা. ফৌজিয়া মোসলেম আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের চিকিৎসকের এবং চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা করেছিলেন। এছাড়া নাম না জানা অনেক নারী দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট দল, ক্যাম্প গঠন করে সাংগঠনিক কাজ করেছেন। সিরাজগঞ্জের সৈয়দা ইসাবেলা ছিলেন রৌমারি ইয়ুথ ক্যাম্পে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের সমস্ত কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এঁরা শহরকেন্দ্রিক নারী। এঁদের নাম অনেকেরই জানা। কিন্তু থানা শহরে বা গ্রামে যে নারী আরও কয়েকজন নারীকে সাথে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য, খবর, অস্ত্র পৌঁছে দিয়েছে, তাঁদের নাম জানা যায় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। অথচ, তাঁরা না থাকলে যুদ্ধটা সম্পূর্ণ হতো না। দেশ স্বাধীন হতো না। প্রধান ভূমিকা তাঁরাই পালন করেছেন। 

মুক্তিযুদ্ধে নারী গেরিলাদের কথা এলেই বেগম ফোরকানের নাম উঠে আসে। তাঁর নেতৃত্বে গেরিলা স্কোয়াড গড়ে উঠেছিল। প্রথমে দলে ছিলেন আট জন। তাঁরা ফেব্রুয়ারি থেকেই অস্ত্র প্রশিক্ষণ করেছিলেন। এরপর শতাধিক নারী এসেছেন। তাদের সুইসাইড স্কোয়াডের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যুদ্ধ শুরু হলে  সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় ‘গোবরা ক্যাম্প’ চালু হয়েছিল। এখানে ৩০০ তরুণী ছিলেন।

লুৎফুন্নাহার হেলেন মাগুড়া গার্লস স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন। মাগুরার মোহাম্মদপুর থানার একটি রাজাকার ক্যাম্প দখল করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পরিণত করেন। তিনি ছিলেন একদিকে সংগঠক, অন্য দিকে গুপ্তচরের কাজও করতেন। আগস্টে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে ধরে নেয় এবং চলন্ত জিপের পেছনে বেঁধে সারা শহরে টেনে নিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে হত্যা করে। তারপর লাশ নবগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়।

তারামন বিবি রাজীবপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে রান্নার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স ১৪/১৫ বছর। এ সময় তিনি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করতেন। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের ওপর হামলা চালাতো। এছাড়া তিনি অনেক বাঙালি পরিবারকেও নিরাপদ  স্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন।আলমতাজ বেগম ছবি প্রথমে মুক্তিযুদ্ধ শিবিরে রান্নাবান্না করতেন এবং পরে অস্ত্র চালনা ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ৭/৮ জন পাকিস্তানি সৈন্য তাঁদের ক্যাম্প ঘিরে ফেললে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন। বরিশালের মুলাদী থানায় কুতুব বাহিনীতে ৫০ জন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন করুণা বেগম। পুরুষের পোশাক পরে যুদ্ধ করেছিলেন আলেয়া বেগম। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানা কমান্ডের ইউনিট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ভারতের চাপড়া ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। ‘অপারেশন স্বরূপকাঠী বাহিনী’র  নারী বীথিকা বিশ্বাস এবং শিশির কনা। তাঁরা গ্রেনেড চার্জ করে গানবোট উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখানে ১০০ মেয়েকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিলো। জাহানারা ইমাম মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন, অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন। স্বামী শরীফ ইমামের কাছ থেকে ব্রিজ-কালভার্টের তালিকা নিতেন। ১১জন নারী শব্দ সৈনিকের কথা না বললেই নয়। তাঁরা হলেন কল্যাণী ঘোষ, মালা খান, শাহিন সামাদ, বুলবুল মহলানবীশ, রূপা ফরহাদ, নাসরীন আহমেদ, নমিতা ঘোষ, মঞ্জুলা দাশগুপ্ত, শিলা ভদ্র, উমা খান।

অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী হিসেবে অনেক কাজ করেছেন। রান্না করেছেন, খাদ্য সরবরাহ করেছেন, গুপ্তচরের কাজ করেছেন, অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন। রাতের অন্ধকারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একা নৌকা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদ প্রদান করতেন অনেক নারী। আবার শহর থেকে যাঁরা জীবন নিয়ে পালিয়ে গ্রামে যেতেন তাদের সাহায্য করতেন অনেক নারী। তাঁদের অবদানও কম নয়। যাঁরা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতেন তাঁরাও অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা। এবং সম্মুখযুদ্ধের যোদ্ধাই বটে।

এরপর আসি বীরাঙ্গনাদের প্রসঙ্গে। ঠিক কতো লক্ষ বীরাঙ্গনা আছেন, তার সঠিক তালিকা নেই। চার লক্ষ বা তারও বেশি নারী পাকিস্তানি সৈন্যদের ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। যাঁদের বীরাঙ্গনা খেতাব দেওয়া হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন পুরুষ যোদ্ধাদের অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তারা হয়েছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। আর অন্যদিকে ধর্ষিত নারীদের বলা হয়েছে বীরাঙ্গনা। শব্দগতভাবে আলাদা হওয়ার কারণে সামাজিকভাবেও বীরাঙ্গনারা সমাজে অস্পৃস্য-অবহেলিত হয়ে আছেন। তাই নারীরা নিজের বীরাঙ্গনা পরিচয় গোপন করে রেখে চলেন। কারণ সমাজ তাঁদের সম্মানের চোখে তো দেখেই না বরং অসম্মান করে। আগের দিনেও রাজা বাদশারা কোনো রাজ্য দখল করলে সেই রাজ্যের অন্তঃপুরের নারীদের অধিকার করতো। সে সময় অনেক নারী আংটির মধ্যে রাখা বিষ পান করে আত্মহত্যা করতেন। কেউ কেউ হেরেমের দাসি হয়ে থাকতেন আবার কেউ কেউ বিজয়ী রাজার উপপত্নী হয়ে থাকতেন। যুগ যুগ ধরেই যুদ্ধে নারী নির্যাতন যুদ্ধকৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধও এর ব্যতিক্রম নয়। জাতিকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করাই এর প্রধান কারণ। এছাড়া সৈন্যদের যেমন খাদ্যের ক্ষুধা রয়েছে, তেমনি যৌন ক্ষুধাও রয়েছে। তারা নিজেদের সার্বিকভাবে সক্ষম রাখতে অন্যায়ভাবে যৌন ক্ষুধা মেটায়।

এখানে যাকে ধর্ষণ করা হলো যে যুদ্ধ ক্ষেত্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে আঘাতপ্রাপ্ত হলো। একজন পুরুষের যেমন আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে অঙ্গহানি বা মৃত্যু হতে পারে। একজন নারীরও তেমনি অঙ্গহানি বা মৃত্যুই হচ্ছে। আলাদা করে তাকে অসম্মানিত বা অসৎ (অসতী) নারী বলবার কোনো অবকাশ নেই। তাই বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় জরুরি বিষয়। মেঘনা গুহঠাকুরতা তাঁর ‘নারীবাদী দৃষ্টিতে ধর্ষণ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন’ লেখায় বিশ্লেষণ করে বুঝিয়েছেন পুরুষের পৌরষত্বকে চ্যালেঞ্জ করবার জন্য নারীকে ধর্ষণ করা হয়। তিনি বলতে চেয়েছেন নারীর অভিভাবক পুরুষ (এ ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য রয়েছে) নারীকে ধর্ষণ করে মূলত পুরুষের উপরই প্রতিশোধ নেওয়া হয়। এ বিষয়ে বলতে চাই পুরুষের পৌরুষত্ব নয়, বাঙালির বাঙালিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেই বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। এক জরিপে জানা যায় চৌদ্দ লাখ নারী নির্যাতন-লাঞ্ছনার শিকার এবং স্বজনহারা হয়েছিলেন।

এখন বলতে চাই পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী নারী যোদ্ধাদের কথা। ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধার মা অপেক্ষা করেছিলেন সন্তানের প্রতিক্ষায়। কত মা তার সন্তানদের যুদ্ধে পাঠিয়েছেন তার হিসেব নেই। অনেক স্ত্রী স্বামীকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মা, স্ত্রী এবং বোনদের অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। যেমন,  মুক্তিযোদ্ধার খবর গোপন রাখা। অনেক সময় তাদের কাছে খাদ্য এবং টাকা পাঠাতে হয়েছে। অনেকে যোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন এবং নির্দিষ্ট সময়ে একা দায়িত্ব নিয়ে তা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিতেন। মুক্তিযোদ্ধার স্বজন নারীদের অনেক সময় সহিংসতার বা ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। এর পাশাপাশি এই নারীদের মানসিক অবস্থাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্বজনের বিচ্ছেদ তো আছেই তারপর তাঁরা ফিরে আসবেন কিনা, আবার দেখা হবে কিনা এ সব নিয়েও দুশ্চিন্তায় দিন কাটাতেন। অন্তত ত্রিশ লক্ষ মা তাঁদের সন্তানদের ফিরে পাননি।  সেই মায়েদের ত্যাগ তো মুক্তিযোদ্ধার ত্যাগের চেয়ে কম নয়। অনেক পরিবারের পুরুষ যুদ্ধে যাওয়ার কারণে পুরো পরিবারকে সামলেছেন কোনো নারী- এ যুদ্ধকেও ছোট করে দেখা যাবে না। আবার যে সব নারী উদ্বাস্তু হয়ে ঘুরে ফিরেছেন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তাঁদের যুদ্ধটাও নিতান্ত কম ছিল না।

সব মিলিয়ে যুদ্ধের সময় এতোগুলো নারী বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা হিলালীর কাছে জানতে পারি, তাঁরা একবার সাত দিন শুধু পানি খেয়ে কাটানোর পর এক গ্রামে খাদ্যের জন্য ঢুকেছিলেন। তখন এক ব্যক্তি সমাদর করে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের কাছারি ঘরে বসিয়ে মুড়ি-গুড় খেতে দিয়ে বাইরে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর সে বাড়ির তরুণী পুত্রবধূ এসে মুক্তিযোদ্ধাদের বলেন যে, তাঁর শ্বশুর রাজাকার। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে খবর দিতে গেছে। সেই তরুণী বধূ সেদিন বাড়ির পেছন দিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। এতগুলো মুক্তিযোদ্ধার জীবন যিনি বাঁচিয়েছিলেন সে নারী অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা। এই সব নারীরাই মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পাওয়ার অধিকার রাখে। অথচ, ২০১৩ সালের তালিকা অনুযায়ী মাত্র ২০৩ জন নারী মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে। সবার অবদান সামনে আনা জরুরি।

বীরাঙ্গনাদেরে নিয়ে ২০১২ সাল থেকে সংগ্রামে নেমেছিলেন মিতালি হোসেন। তিনি হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। তিনি দাবি জানিয়েছিলেন, “বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মতো সম্মান ও সম্মানী দেওয়া হোক।”  মিতালি হোসেনের সাথে যুক্ত ছিলেন সালমা আলী এবং রুমানা ইসলাম শাওন। ২০১৪ সালে এই রিট হয় এবং দুই বছর পরই এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এখানে তিন হাজার বীরাঙ্গনার তালিকা তারা দিয়েছিলেন। তবে একটি কথা খুব স্পষ্টভাবে গবেষণায় উঠে এসেছে যে, অনেক বীরাঙ্গনাই নিজেদের কথা বলতে চান না। নিজেদের লুকিয়ে রাখেন। তাঁদের যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। নিজের মানসিক যুদ্ধ, পারিবারিক যুদ্ধ এবং সামাজিক যুদ্ধ করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই এখনই উচিত তাঁদের প্রাপ্ত মর্যাদা দিয়ে তাঁদের যুদ্ধের অবসান ঘটানো।

মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধা শব্দ দুটি বহুল উচ্চারিত শব্দ। ‘মানুষ’ শব্দের মধ্যে যেমন নারী এবং পুরুষ দুই শ্রেণিকেই বোঝায়, তেমনি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দের মধ্যেও নারী এবং পুরুষ যোদ্ধা বোঝানো উচিত। এবং আমি মনে করি বীরাঙ্গনা বলে ১৯৭১ সালের ধর্ষিত নারীদের আলাদা না করে তাঁদেরকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তাহলে কোনো বিভেদ থাকবে না। লুকানোর প্রবণতা থাকবে না। কারণ তাঁদের ত্যাগ কোনোক্রমেই অস্বীকার করার নয়। আমি তাঁদেরকেও সম্মুখযুদ্ধের যোদ্ধা মনে করি।

মুক্তিযুদ্ধের কথা এলেই সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরুষদের কথা বলা হয়। পুরুষ যোদ্ধাদের মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান নিতান্ত কম নয়। বরং প্রায় সম পরিমাণে, অনেক ক্ষেত্রে বেশি। অথচ মাত্র তিনজন খেতাব প্রাপ্ত হয়েছেন: ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, তারামন বিবি, কাঁকন বিবি। বেশিরভাগ নারী মুক্তিযোদ্ধার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আবার বীরাঙ্গনাদের প্রতিনিয়ত অসম্মানিত হতে হচ্ছে। এখন সমস্ত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা জরুরি। তাছাড়া তাঁদের অবদানের কথা কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। নারীদের অবদান হয়তো এক সময় মানুষ ভুলে যাবে। তাই বারবার বলা প্রয়োজন যে, নারীর অবদানের স্বীকৃতি এখনই প্রয়োজন।

দেশের জন্য কাজ করা সমস্ত নারীদের প্রতি সম্মান জানাই।

 

লেখক: নাট্যকার, প্রাবন্ধিক
১৬ ডিসেম্বর, ২০২০


  


 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়