ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

ভালোবাসায় মুক্তি, ঘৃণায় ধ্বংস

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪৪, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১  
ভালোবাসায় মুক্তি, ঘৃণায় ধ্বংস

১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আগে রোজ ডে এবং প্রপোজ ডে থাকে।  যদিও ঘটা করে এসব দিবস পালন করা হয় না।  তবে ভালোবাসা দিবস সারা বিশ্বেই বেশ ঘটা করেই পালন করা হয়। 

এক সময় আমরা এসব দিবসের নামই জানতাম না। আজ প্রযুক্তির কল্যাণে তা জানি। যাই হোক, ফাল্গুনের শুরুতে ভালোবাসা দিবসের এই যে প্রথা আজ সারা বিশ্বে  ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে তা আমরা সঠিকভাবে বুঝতেও পারছি না, পালনও করছি না। ভালোবাসাকে আমরা বন্দী করে দিয়েছি দিবসের মাঝে। পৃথিবী সৃষ্টির পর মানবসভ্যতা বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। সেই তখন থেকে আজ পর্যন্ত মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রেখেছে যে অদৃশ্য বস্তুটি তা হলো ভালোবাসা। অথচ কতরকমভাবেই এই শব্দটিকে বিশ্লেষণ করা হয়।  আর শেষ পর্যন্ত তা কেবল ভিন্ন সম্পর্কের আবেগে গিয়ে ঠেকেছে। ভালোবাসা আগেও যেমন ছিল আজও তেমনি আছে। আমরা তা ভুল পথে চালিত করছি। ভালোবাসাকে ঘিরে বৈজ্ঞানিক কত রসায়ন হয়েছে। আসলে কি এই অদৃশ্য বস্তু? যার জন্য মানুষ ছুটছে।  মানুষ তো আজ ভালোবাসার কাঙাল। সারা পৃথিবীতে আজ যা কমছে তা হলো ভালোবাসা। হিংসা, বিদ্বেষের চাপে ভালোবাসা তলানিতে ঠেকেছে। আর ভালোবাসা বলতে আমরা যা বুঝতে পারছি বা গা সয়ে নিয়েছি তা তো মোহ।  

মোহ আর ভালোবাসাকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। আমাদের দেশে ভালোবাসা দিবস এমন এক সময় আসে যখন প্রকৃতি নিজেই নতুন সাজে সাজতে থাকে। সে নিজেই রঙিন হতে আরম্ভ করে।  প্রকৃতি থেকে শীত বিদায় নেওয়ার প্রাক্কালে গাছে গাছে আম, লিচুর মুকুল দেখা দেয়, ফুল ফোটে,ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি চলে প্রকৃতিজুড়ে।  লোবাসার অর্থ যেন প্রকৃতিই বোঝে সবচেয়ে ভালো।  আজ দেশে বিদেশে কত দিবস পালিত হয় তার কোন পরিসংখ্যান নেই। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক এসব দিবস ঘটা করে পালন করা হয়। এসব ভালোবাসার জন্যও দিবস দরকার হয়। সেই দিবসে নাাকি ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। দিবস গেলেই ভালোবাসা উধাও।  কত আয়োজন হয় তার হিসাব নেই।  অথচ কি আশ্চর্য! প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিট ভালোবাসার হওয়া উচিত। কিন্তু সেটাকেও আমরা একটা নির্দিষ্ট দিনে বন্দী করে ফেলেছি। নিজের দায়িত্ব কর্তব্য পালনের মধ্যেও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে। 

সময় যত গড়াচ্ছে, ভালোবাসা দিবস পালনের তোড়জোড় ততই বাড়ছে। ফুল বিক্রি বাড়ছে, নতুন সাজে প্রকৃতির চেহারা বদলে যাচ্ছে, প্রেমিক প্রেমিকা ঘুরছে, আনন্দ করছে।  আমরা তো চাই এমন সুন্দর থাক বছরজুড়ে। কিন্তু তা থাকছে না।  ভাঙছে আর ভাঙছে।  ক্ষণিকের এক দিনে এক মুহূর্তে একটি দিবসের মাধ্যমেই শেষ হচ্ছে সেই দৃশ্যের। এটা যদি হয় তাহলে কাকে ভালোবাসা বলবো? ভালোবাসার সংজ্ঞা কি? হৃদয়ের যে আবেগ যা সেই সুদূর অতীতকাল থেকে মানুষে মানুষে একত্রিত করে রেখেছে, মায়ায়-মমতায় ধরে রেখেছে, একজনের বিপদে অন্যজনকে সামনে এনেছে, কারও হাত পরম নিশ্চিন্তে অন্য কারও হাতে ছেড়ে দিয়েছে তাই ভালোবাসা। আজ কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। যাকে ভালোবাসি বলে বিশ্বাস করছি, সেই তাকেই পরক্ষণে আবার সন্দেহ করছি-আরও সম্পর্ক আছে বলে অথবা সে আমার সাথে প্রতারণা করতে পারে বলে এই ভালোবাসার গুরুত্ব কতটুকু। যাকে সম্পর্ক বলে গণ্য করছি তা আদৌ সম্পর্ক কি না তা নিয়েই ভাবতে সময় পার হয়ে যাচ্ছে অনেকটা।

এক্ষেত্রে সবাই যুগের কথা বলে অজুহাত দেখানো চেষ্টা করেন। কিন্তু এই যুগের দায় আসলে আমাদেরই। আমরাই বিশ্বাস ভাঙতে ভাঙতে যুগটাকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছি যে একটি দিবস ছাড়া ভালোবাসা প্রায় উধাও একটি বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ভালোবাসা দিবসের এই দিনেও কি কারও স্বপ্নের ভালোবাসার অপমৃত্যু ঘটবে না তার কি গ্যারান্টি আছে। হরহামেশাই তো প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়ে ধর্ষণ বা গণধর্ষণের মতো জঘণ্য ঘটনাগুলো ঘটছে। ভালোবাসি বলে বিশ্বাস করেই তো এই নৃশংস ঘটনাগুলো ঘটছে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনসের কাছ থেকে যে ভালোবাসা দিবস আমরা আজ পালন করছি সেই ভালোবাসা থেকে সমাজ অনেক দূরে সরে গেছে। ভালোবাসা আজ কেবলই লৌকিকতা। অথচ ভালোবাসা অন্তরের বিষয় কোনো লৌকিকতা নয়। কোনোদিন ছিলও না। আমার ভালোবাসা প্রকাশ পাওয়া উচিত আমার কাজে। 

ভালোবাসা শব্দটির কোনো সীমারেখা থাকার কথা না থাকলেও আমরা তা একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলেছি। গায়কের সুরে যখন ভেসে ওঠে, সখী ভালোবাসা কারে কয়, সে কি কেবলি যাতনা ময়’- তখন সত্যি জানতে ইচ্ছে করে ভালোবাসা কারে কয়। তা কি আজ সত্যিই অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বের জেরে মানুষের ভেতর থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে? যার ভেতরে ভালোবাসা থাকে না তাকে তো মানুষ বলা যায় না? পশুও কি বলা যায়? কারণ পশুরও তো ভালোবাসা থাকে। চারদিকে এত নির্মমতা, খুনোখুনি, হানাহানি, যুদ্ধাবস্থা, হিংসা, শক্তি প্রদর্শনী এসব দেখে যে কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ভালোবাসা কোথায়? ভালোবাসা মানেই তবে কেবলই আজকের এই লোক দেখানো চাকচিক্যময় জগতের রঙিণ সম্পর্ক? এত ক্ষুদ্র আঙ্গিকে ভালোবাসাকে আমরা বেধে ফেলছি? আবার তাও যদি হয় তবে সেখানেও প্রতিনিয়ত এই বিশ্বাস ভাঙার খেলা চলে কেন?  যাকে ভালোবাসি বলে বিশ্বাস করছি সে-ই আমার বিশ্বাস ভাঙার কারণ হচ্ছে। একাধিক সম্পর্ক শব্দটি অচল হতো যদি ভালোবাসা অটুট থাকতো। তাছাড়া ভালোবাসার মতো একটি বিশাল শব্দকে আমরা নিজেদের স্বার্থে আজ ছোট করে রেখেছি। কোনো দিবসে নয় বরং প্রতিটি দিনই আসলে ভালোবাসা দিবস। কারণ ভালোবাসা ছাড়া একটি দিনও অতিবাহিত হওয়া সম্ভব নয়। ভালোবাসা হোক পৃথিবীতে সৃষ্ট প্রতিটি প্রাণীর জন্য। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

ঢাকা/সাইফ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়