ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর খুলছে স্কুল-কলেজ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়?

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১০, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১  
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর খুলছে স্কুল-কলেজ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়?

চলছে স্কুল-কলেজ খোলার প্রস্তুতি

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অর্থাৎ ৫৪৪ দিন পর আগামী ১২ সেপ্টেম্বর খুলছে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার দুয়ার।  এটি স্মরণকালের দীর্ঘতম বন্ধ। গত ৫ সেপ্টেম্বর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠক শেষে শিক্ষামন্ত্রী গণমাধ্যমে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণী কক্ষে পাঠদান শুরুর ঘোষণা দেন। এ জন্য কিছু জরুরি দিকনির্দেশনাও জারি করা হয়।

নির্দেশনাগুলো হলো: শ্রেণী কক্ষে পাঠদানকালে শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ সবাইকে মাস্ক পরিধান করতে হবে। ২০২১ সালে যারা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী তাদের প্রতিদিন স্কুলে আসতে হবে। এ ছাড়াও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন ক্লাসে আসবে। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণী এবং ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে একদিন ক্লাস করবে। যেসব স্কুলে শিক্ষার্থী বেশি সেখানে প্রয়োজনে দুই শিফটে ক্লাস হবে। প্রথম শিফট সকাল ৯:৩০ মিনিট থেকে তিন ঘণ্টা চলবে। দুপুরে ৩০ মিনিটের বিরতির পর পুনরায়  ক্লাস শুরু হয়ে চলবে ৩:৪৫মিনিট পর্যন্ত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এক দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে, বের হতে হবে অন্য দরজা দিয়ে।

এই নির্দেশনায় প্রাকপ্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের সশরীরে ক্লাস আপাতত বন্ধ থাকছে। কিন্তু  বিশ্ববিদ্যালয় খোলার তারিখ এখনও ঠিক করা হয়নি। পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে এই হলো শিক্ষা ব্যবস্থাপনার রোডম্যাপ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়ার জন্য ছাত্রছাত্রীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। অনেকের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে,  অনেক শিক্ষার্থীকে মেস কিংবা আত্মীয়-স্বজনের বাসায় এবং বহু শিক্ষার্থী গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। দেশে চালু ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২০টি আবাসিক হল আছে যেখানে প্রায় এক লাখ ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী থাকে। ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল যে, ১৫ অক্টোবরের পর ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হবে, তারপর কলেজ, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং সবশেষে শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু ঘটনা এই মুহূর্তে একটু বিপরীত মনে হচ্ছে!

যতটা বুঝতে পেরেছি যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। সর্বশেষ গত ২৪ আগস্ট জাতিসংঘ শিশু তহবিল একটি প্রতিবেদনে বলেছে, করোনার কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। এই দীর্ঘ বন্ধের কারণে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত চার কোটি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  করোনাসৃষ্ট মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্যের মতো সমস্যাগুলোর তীব্রতা অভূতপূর্ব হারে বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের কোটি কোটি শিশুর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত। সংক্রমণের ধাক্কা কাটিয়ে বিশ্বের কিছু অংশে স্কুল-কলেজ খোলার প্রস্তুতি নেওয়া হলেও পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ দেশেই শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ার হুমকিতে রয়েছে। সেফ দি চিলড্রেনের করা এ তালিকায় রয়েছে কঙ্গো, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, আফগানিস্তানসহ আটটি দেশ। বলা হচ্ছে এই দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।  ইয়েমেন, বুরকিনা ফাসো, ভারত, ফিলিপাইন, বাংলাদেশসহ আরও ৪০টি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে বলেও জানিয়েছে সেভ দ্যা চিলড্রেন।

শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে অন্তত এক-তৃতীয়াংশের ঘরে বসে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগও ছিল না। বর্তমানে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো চরম দারিদ্র্য, কোভিড-১৯, জলবায়ু পরিবর্তন, আন্তঃসম্প্রদায়গত সহিংসতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। ফলে সেখানে শিক্ষার্থীদের একটি হারিয়ে যাওয়া প্রজন্ম তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। সেভ দ্যা চিলড্রেন যুক্তরাজ্যের প্রধান নির্বাহী গোয়েন হাইনস বলেন, আমরা জানি যে, করোনায় স্কুল বন্ধের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দরিদ্র শিশুরা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, শিশুদের শিক্ষা ও জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া বিষয়গুলোর মধ্যে মাত্র একটি হচ্ছে কোভিড-১৯। তার মতে আমাদের এ ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং এখনই কাজ করতে হবে। কিন্তু বিষয়গুলো পূর্বের মতো করাই যথেষ্ট নয়। এটিকে আশা ও ইতিবাচক পরিবর্তনের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের অগ্রগামী ও ভিন্নভাবে সবকিছু গড়ে তুলতে হবে।

শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর ক্ষেত্রে সরকারকে অন্তত ৭টি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। স্কুল কলেজ খোলার পর কি পরিমাণ শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরবে বা ফিরবে না তা অনিশ্চিত। মাউশি বলছে খোলার পর উপস্থিতি-অনুপস্থিতি দেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না ফেরা শিক্ষার্থীর তালিকা তৈরির নিদের্শ দেওয়া হবে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। এডুকেশন ওয়াচের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন-২০২১ এ শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার ব্যাপারে উদ্বেগজনক মতামত পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয় প্রাথমিকের ৩৮ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন বিদ্যালয় খুলে দেয়ার পর শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যেতে পারে। ২০ শতাংশ মনে করেন বিদ্যালয় খুলে দেয়ার পর ঝরে পড়ার হার বাড়বে এবং ৮.৭ শতাংশ মনে করেন শিক্ষার্থীরা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে পারে। মাধ্যমিকের ৪১.২ শতাংশ মনে করেন, বেশি শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকবে। ২৯ শতাংশ মনে করেন ঝরে পড়ার হার বাড়বে। ৪০ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত উপস্থিতির হার বাড়বে এবং ২৫ শতাংশ মনে করেন, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। অর্থাৎ ২০২১ সালে এই ঝরে পড়ার হার বাড়বে বলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলো খুলছে, এখন আমাদের পরিসংখ্যানগুলো সঠিকভাবে বের করতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের আপাতত দুটি করে ক্লাস হবে। খোলার পর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের যেহেতু সপ্তাহে ছয়দিন ক্লাস হবে, তাই তাদের অ্যাসইনমেন্ট ও অনলাইন ক্লাস হবে না। তবে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির সশরীরে ক্লাস সপ্তাহে একদিন হওয়ায় তাদের অ্যাসাইনমেন্ট ও অনলাইন ক্লাস চলবে। পঞ্চম শ্রেণিসহ প্রাথমিক পর্যায়ের অন্যান্য শ্রেণির বাড়ির কাজও চলবে। ক্লাসের সময়সূচি প্রণয়নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছে মাউশি। এই নির্দেশনার মাধ্যমে কীভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চলবে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা পেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।

শিক্ষা কার্যক্রম চালুর ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে করোনা সংক্রমণের নিম্নগতি ধরে রাখা। শ্রেণীকক্ষে একজনও যদি আক্রান্ত অবস্থায় থাকে তাহলে বাকি সবারই সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কা থাকে। এ কারণে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বা করোনা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়নের জন্য পাঠানো হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, যেসব শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী টিকা নেননি, তাদেরকে টিকা নিতে হবে। ইউনিসেফের তথ্যমতে, উন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগ অংশে স্কুলগুলো ফের চালু হলেও বাকি বিশে^র অন্তত ১৬টি দেশে কঠোর লকডাউনের কারণে ১০ কোটিরও বেশি শিশু ক্লাসের বাইরেই থাকছে। আশঙ্কা করা হচেছ এক থেকে দেড় কোটি শিশু হয়তো আর কখনোই স্কুলজীবনে ফিরতে পারবে না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে মেয়ে শিশুরা।

ইউনিসেফের শিক্ষা বিষয়ক বৈশ্বিক পরিচালক রবার্ট জেনকিন্সের মতে, করোনা মাহামারির আগেও বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চল শিক্ষা সংকটের মুখে ছিল। তিনি বলেন, এখন আমরা শিক্ষার্থীদের একটি প্রজন্ম হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছি। এটি আজীবন প্রভাব ফেলতে পারে যদি না আমরা শিশুদের পূর্ণাঙ্গ ও ব্যাপক সহায়তা প্রদনা করে এমন কর্মসূচির দিকে না যাই। শুধু শিক্ষার জন্যই নয়, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য, পুষ্টি সহায়তা এবং সুরক্ষা অনুভূতির জন্যেও সহায়তা দরকার। কিন্তু উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর সরকার এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে প্রয়োজনীয় নজর দেবে কি? 


লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ