ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সুদানে গণতন্ত্রের সংকট, সমাধান কোন পথে

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৭, ৪ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৬:১১, ৪ নভেম্বর ২০২১
সুদানে গণতন্ত্রের সংকট, সমাধান কোন পথে

পৃথিবী যখন গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে চাইছে তখন মিয়ানমার, মালি বা সুদানের মতো দেশে সামরিক শাসন চলছে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পৃথিবীর সবচেয়ে কাঙ্খিত বস্তু।

আফ্রিকা মহাদেশে গত এক দশকে সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে কয়েকটি দেশে। ২০১২ সালে মালি এবং এরপর মিসর, বুরকিনা ফাসো, জিম্বাবুয়ে, সুদান, চাদ, গিনি এবং সর্বশেষ ফের সুদানে সেনা অভুত্থান ঘটেছে। ফলে পূর্ব আফ্রিকার দেশ সুদান এখন উত্তাল। দেশটি গত কয়েকদিন ধরেই বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। যদিও মাঝখানে দেশটির অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। গুলিতে মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে দেশটিতে।

গত ২৫ অক্টোবর দেশটির প্রধানমন্ত্রী আব্দাল্লাহ হামদকে গৃহবন্দী করে সেনাবাহিনী। অবশ্য পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। অভ্যুত্থানের নেতা জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ বুরহান বেসামরিক সরকার ভেঙে দিয়েছেন, রাজনৈতিক নেতাদের বন্দী করে তিনি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। এক সংবাদ সম্মেলনে বুরহান জানান যে, আমরা গত সপ্তাহে যে বিপদ দেখেছিলাম তাতে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে চলে যেতে পারতো।

বর্হিবিশ্ব অবশ্য বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) জোটে সুদানের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। দেশটিতে চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য অর্থ ছাড় এবং নতুন প্রকল্প অনুমোদন বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ফলে সুদান অর্থনীতিতে যে অগ্রগতি অর্জন করেছিল এখন তা ধরে রাখা চ্যালেঞ্জিং হবে।

একদিকে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার বিষয়টি ভালো চোখে না দেখা, অন্যদিকে নিজ দেশে জনগণের বেসামরিক ক্ষমতা হস্তান্তর করা- দুই মিলে পরিস্থিতি যে খুব ভালো হবে না, তা ইতোমধ্যেই বুঝতে পারছে অভ্যুত্থানকারী। সেপ্টেম্বরের এই সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশটির আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই মিসরীয়রা দাবি করতে থাকে- মিসর ও সুদান এক রাষ্ট্র হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ১৯৫৪ সালে মিসরীয়ার ব্রিটিশদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। ওই চুক্তি অনুসারে ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি সুদান স্বাধীনতা লাভ করে।

দেশটিতে গৃহযুদ্ধের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সেখানে গৃহযুদ্ধ চলেছে। এর মধ্যেই একজন সামরিক কর্মকর্তা দেশটির ক্ষমতা দখল করেন। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও ১৯৮৩ সালে আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৮৯ সালের ৩০ জুন কর্নেল ওমর আল বশির একদল সামরিক কর্মকর্তার সমর্থন নিয়ে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থান ঘটান। এরপর তিনি শক্ত হাতে দেশ শাসন করেন। ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদানের জন্ম হয়। ওমর দেশে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন এবং ইসলামি আইন চালু করেন। ১৯৯৬ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি নিজেকে সুদানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন এবং এরপর এক নির্বাচনে নিজেই প্রার্থী হন। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সুদানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ঘোষণা করে।

ওমর ২০০৫ সালের ৯ জানুয়ারি একটি চুক্তি করেন। চুক্তি অনুসারে দেশের দক্ষিণাঞ্চল স্বায়ত্ত্বশাসন ভোগ করবে এবং স্বাধীনতার জন্য ছয় বছর পর গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও ওমর ২০১০ ও ২০১৫ সালে নির্বাচনে জয় পান। যদিও শেষ নির্বাচন বিরোধী দল বর্জন করে। এরপর ওমর আল বশিরকে ২০১৯ সালে সরিয়ে দেওয়া হয়। তিন দশক পর সুদানে পরিবর্তন আসে। কিন্তু তারপর থেকে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য সংকট বাড়তে থাকে। এই অবস্থায় সুদানের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়তে থাকে। গত সেপ্টেম্বরে ব্যর্থ এক অভ্যুত্থান চেষ্টা করে বশিরের অনুগত সেনারা। এই ঘটনার পর থেকেই সামরিক বাহিনী ও বেসরকারি নেতৃত্বের মধ্য দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

গত অক্টোবরেও দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ করেছে মানুষ। এসব কারণে পরিস্থিতি মূলত খারাপ হচ্ছিল। জনগণ দুই দিকে বিভক্ত ছিল। বশির সরকারের পতনের পর থেকে সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক গোষ্ঠীগুলোর ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তিতে চলছিল দেশ। এটি মূলত নড়বড়ে ধরনের ব্যবস্থা ছিল। সুদানের অর্থনীতি দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি এবং অধিকাংশই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তবে দেশটির প্রধান রফতানি পণ্য তেল। সুদানের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সব সময়ই একটি অস্থিতিশীলতার মধ্যে পার করেছে। সামরিক শাসনও সেখানে ইতিহাসের দীর্ঘ অধ্যায়। তবে এখন জনগণ বেসামরিক নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে রাস্তায় বিক্ষোভ করছে। জনগণের জীবন মান উন্নয়নে দেশটিতে প্রয়োজন একটি স্থিতিশীল সরকার। তবে সুদানের এই সংকট থেকে উঠে আসা সহজ হবে না। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই তীব্র চাপ মোকাবিলা করতে হবে দেশের জনগণকে। 


লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক 
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়