ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ইউক্রেনের পরাজয়ে শুধু পুতিন নয়, বাইডেনও জয়ী হবেন 

জব্বার আল নাঈম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১৬, ২ মার্চ ২০২২   আপডেট: ২০:১৭, ২ মার্চ ২০২২
ইউক্রেনের পরাজয়ে শুধু পুতিন নয়, বাইডেনও জয়ী হবেন 

১৯৫৯ সালে তরুণ ফিদেল কাস্ত্রোর হাতে গড়া সমাজতান্ত্রিক কিউবাকে ধ্বংস করতে ফ্লোরিডায় নির্বাসিত সমাজতন্ত্র-বিরোধী দলের নেতাদের সমন্বয়ে এক বৈঠক পরিচালিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জনএফ কেনেডির সামরিক বাহিনী তাদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করবে। সেই লক্ষ্যে ১৯৬১ সালের যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি রাজনৈতিক কমিটি গঠিত হয়, যাদের নেতৃত্বে কিউবায় পরিচালিত হবে গেরিলা যুদ্ধ। পরবর্তীকালে তাদের সহযোগিতায় মার্কিন সৈন্যসহ বিগ-২৬ বোমারু বিমান পাঠাবে নিউ ইয়র্ক।

এমন পরিস্থিতিতে তরুণ ফিদেল বিশ্ব-পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে সাহায্য পার্থনা করলে প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুশ্চেভ তাতে সম্মতি প্রকাশ করেন। এবং গোপনে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র যোগান দেন। ক্রুশ্চেভ যে কিউবাকে আমেরিকার আগ্রাসন থেকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্য আগে থেকেই মনে লালন করছিলেন বিষয়টি তেমন নয়। এর পেছনে কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাস্ত্র করার জন্য ইতালি ও তুরস্কে আন্তঃমহাদেশীয় অস্ত্র তাক্ করে পশ্চিমা বিশ্ব যে হুমকি তৈরি করে রেখেছিল তার বিপরীতে গৃহীত পদক্ষেপমাত্র। মস্কো কালবিলম্ব না করে কিউবাতে মিসাইল বসায় যা ফ্লোরিডা থেকে মাত্র ৯০ কি.মি. দূরে। মস্কোর এই কিউবান মিসাইল একইসঙ্গে ওয়াশিংটনসহ যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নয়টি শহরে আক্রমণ করতে সক্ষম ছিল। 

এর ফলে শুরু হয় স্নায়ু যুদ্ধ। সোভিয়েত বাহিনী পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারে এমন একটা টানটান উত্তেজনাকর সময়ে জনএফ কেনেডির ভাই আইনজীবী ও নিউ ইয়র্কের সিনেটর রবার্ট কেনেডি রুশ রাষ্ট্রদূত অন্ত্যোনি দুবলেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা দীর্ঘ ১৩ দিন পর সমঝোতায় পৌঁছেন। সিদ্ধান্ত হয় মার্কিনিরা আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ইতালি ও তুরস্ক থেকে সরাবে এবং কিউবার উপর কোনোরকম হস্তক্ষেপ করবে না। সেসময় এভাবে স্নায়ু যুদ্ধে আমেরিকার এক ধরনের পরাজয় হয়েছিল মস্কোর হাতে।

যুক্তরাষ্ট্র এই ক্ষত ভুলতে পারে না। তাই ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ইউক্রেন প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের হালে পানি ঢালতে শুরু করে। কারণ, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া তাদের পূর্বের অবস্থানে ফিরে এসেছে। এই পুতিন রাষ্ট্রের ভেতরে প্রতিপক্ষ অ্যালেক্সই নাভালিনকে ঘায়েল করার পাশাপাশি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধ শক্ত হাতে দমন করেছেন। সিরিয়া যুদ্ধে বাশার আল আসাদকে সমর্থন দিয়ে তুরস্ককে পরাজিতের পাশাপাশি আমেরিকাকেও এক অর্থে পরাজিত করেছেন। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনকে সমর্থনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।  ইংল্যান্ডের রাজনীতিতে একের পর এক হস্তক্ষেপ করছেন। কথিত আছে জার্মান সাবেক চ্যান্সেলর মারকেল অ্যাঞ্জেলকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পেছনেও হাত রয়েছে তার। মধ্যপ্রাচ্যের নাভীতে ইসরায়েল নামক বিষফোঁড়া তিনি বাড়তে দিতে চান না।

শুধু কি তাই? ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন পুতিন- এ কথা বারবার উচ্চারণ করেছেন ট্রাম্পের তৎকালীন নির্বাচনী প্রতিপক্ষ হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন। আফ্রিকার অনেকগুলো দরিদ্র রাষ্ট্রে আমেরিকা ও ফ্রান্সের বিভিন্ন অন্যায় ও অনৈতিক কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে রাশিয়া। এমনকি মার্কিনিদের একক আধিপত্য ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্যে তুরস্ক, চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া, বেলারুশ ও কিউবার মতো রাষ্ট্রগুলোকে সফলভাবে একত্রিত করেছে দেশটি।  

অন্যদিকে পুতিনের কূটকৌশলের কাছে সম্মুখ কিংবা স্নায়ু যুদ্ধে একের পর এক পরাজয় ঘটছে মার্কিন বাহিনীর। আমেরিকা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে পুতিনকে ঠেকাতে, সেই লক্ষ্যে পুতিনের রাজনৈতিক বিরোধী প্রতিপক্ষ অ্যালেক্সই নাভালিনকে সহযোগিতা দিয়েও সফল হচ্ছে না বাইডেন প্রশাসন। একটা সময় রাশিয়াকে একঘরে করতেই আমেরিকার সহযোগিতায় ভাঙে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৯০ সালে আফগানিস্তান যুদ্ধে রাশিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেয় ক্ষমতাধর মার্কিন বাহিনী। বর্তমানে রাশিয়ার মিত্র বলে পরিচিত ইরান ও চীনকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলের চেষ্টা চলছে। আমেরিকা কোনোভাবেই চাইছে না রাশিয়া পরাশক্তি হিসেবে টিকে থাকুক।

এরই মাঝে ক্রিমিয়া ১৮ মার্চ, ২০১৪ সালে চলে আসে পুতিনের দখলে। ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে ক্রিমিয়া রাশিয়ার জন্য অপরিহার্য সত্য। কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট নন পুতিন। ইউক্রেনের সর্ব পূর্বাঞ্চল দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক নামক দুটি অঞ্চল বিচ্ছিন্নবাদীদের দখলে তুলে দেন। এই অঞ্চলগুলো পুতিনের রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত। দুটি এলাকায় সৈন্য পাঠিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিও দিয়েছে দেশটি। এই তিন অঞ্চলে রাশিয়ার কর্তৃত্বের ফলে কেবল যে ইউক্রেন কোণঠাসা তা নয়, বরং ইউরোপীয় ইউনিয়নও হুমকির মুখে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রকাশ্যে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যুদ্ধজাহাজ সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। 

এখন প্রশ্ন হলো-ইউক্রেনকে কেনো ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র হতে দিচ্ছে না রাশিয়া। এর কারণ কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্র চাইবে না পাশে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র কিংবা শক্তিশালী রাষ্ট্রের ছায়া থাকুক। ইউক্রেন যদি ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হয়েই যায় রাশিয়া হারাবে জ্বালানি সম্পদ রপ্তানির ৩৫ শতাংশ ব্যবসা, সেই সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির অবাধ ব্যবহার। ইউক্রেন সীমান্তে থাকবে ন্যাটো বাহিনীর অস্ত্র। যার মুখ থাকবে রাশিয়ার দিকে। এত দিকে ক্ষতি মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা রুশ রাষ্ট্রনায়ক পুতিনের নেই। আর এ কারণেই এই সামরিক আগ্রাসন। 

রাষ্ট্র অস্বীকার করার প্রবণতা এর পূর্বে মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনি আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়া দখলের সময় দেখিয়েছে। এরপরও অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো বাহিনী রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। যা হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দিশেহারা রাশিয়া তখন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। বিষয়টিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ না বলে, বলা যেতে পারে রাশিয়া ও আমেরিকার ‘কিউবান মিসাইল স্নায়ু যুদ্ধ’। 

মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটোবাহিনী আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়া আক্রমণের পর নজর দিয়েছে চীন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর দিকে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন আফগানিস্তানে পরাজয়ের পর অর্থনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে যায়। নতুনভাবে যুদ্ধে জড়াতে রাজি হবে না ইউরোপের কয়েকটি দেশ। জার্মানি রাশিয়ার সঙ্গে তেল ও খনিজ সম্পদের জন্য নতুন সম্পর্ক তৈরি করেছে। আফগানিস্তানে তারা পরাজিত হলেও রাশিয়ার পুতিন সিরিয়াতে আমেরিকাকে পরাজিত করে। চীন, ইরান, পাকিস্তান ও ভারতের মতো দেশগুলোকে কাছে টানে। মাথা গরম হয়ে যায় মার্কিন প্রধানের। ন্যাটোকে সক্রিয় করতে একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি চাই-ই চাই যুক্তরাষ্ট্রের। 

এদিকে জার্মানির সঙ্গে ফ্রান্সও ন্যাটোকে কম গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছে। আফ্রিকার দেশগুলোতে ফ্রান্সের সঙ্গে মার্কিন শত্রুতা দীর্ঘদিনের। অকাস চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে মিথ্যাবাদী বলতেও দ্বিধা করেনি ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রো। তাই ন্যাটোকে ধরে রাখতে ইউক্রেনকে বেছে নিলেন ন্যাটো প্রধান ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে যুদ্ধের মাঠে ন্যাটো থাকার আশ্বাস দিয়েছে এক শর্তে- ইউক্রেনকে ন্যাটোর সক্রিয় সদস্য রাষ্ট্র হতে হবে। 

এদিকে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ খেলোয়াড় পুতিনের সঙ্গে লড়াই করতে নামলে নিজের উপর ভরসা করতে হয় তা ভুলে গেছেন এক সময়ের কৌতুক অভিনেতা ও ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। যুদ্ধের মাঠে ন্যাটোর বাহিনীর ছাত্রছায়া এ কারণে পাননি তিনি। উল্টো কৃষ্ণসাগর থেকে ন্যাটোর দুটি যুদ্ধজাহাজ ছাড়া বাকিগুলো সরিয়ে নিয়েছে। সুযোগে রাশিয়া অতিরিক্ত যুদ্ধজাহাজ ভাসিয়েছে কৃষ্ণসাগরে। ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ লাগার আগেই কথার যুদ্ধ চালিয়ে সমাধানে পৌঁছুতে হয় তা হয়তো বুঝতে পারেননি জেলেনস্কি। যুক্তরাজ্য সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও সহযোগিতা করছে না। আবার ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়া না-হওয়া দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কিছুই যাবে আসবে না। কারণ মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর দরকার একটা যুদ্ধ, যেখানে বলির পাঠা হবে ইউক্রেন। আর এখানেই বাইডেনের লাভ। 

তাহলে বলতেই হয়, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জনএফ কেনেডির ছায়া বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওপর ভর করেছে। অন্যদিকে সাবেক রাশান প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুশ্চেভের ছায়া যেন ভ্লাদিমির পুতিন। সেই ১৯৬২ সালের মতো সমঝোতা চুক্তির টেবিলে জেলেনস্কির হয়ে বাইডেনকে হয়তো মেনে নিতে হবে রাশিয়ার নতুন আরো কিছু শর্ত।

জো বাইডেন অনেক কারণেই রাশিয়ার উপর সরাসরি আক্রমণের সাহস দেখাবে না। এর প্রধান কারণ হলো এখানে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ নেই, সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে সরাসরি হস্তক্ষেপের পক্ষপাত নেই, গত বিশ বছর ধরেই আমেরিকান সাধারণ মানুষ যুদ্ধবিরোধী মনোভাব দেখিয়ে আসছে। দুই পরাশক্তির মধ্যকার যুদ্ধে পৃথিবী দুইভাবে বিভক্ত হয়ে যাবে, যা হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধে যুদ্ধে বিধ্বস্ত ন্যাটোর সব সক্রিয় দেশগুলোও আগ্রহ দেখাবে না। কারণ আগেই বলেছি, ইউক্রেন এখনো ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র না। এসব কারণে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সরাসরি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবে না। অন্যদিকে পুতিন এটা ভালো করে জানেন ধমক ও কৌশল দিয়ে অধিকার আদায় করা গেলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার কেবল অপচয়। 

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়