ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

১৫ই আগস্টের বিপর্যয়: পেছন ফিরে দেখা

নাসির আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৭, ১৫ আগস্ট ২০২২  
১৫ই আগস্টের বিপর্যয়: পেছন ফিরে দেখা

বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এবং কলঙ্কিত একটি দিন ১৫ই আগস্ট। সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মর্মস্পর্শী শোকের স্মৃতিবহ দিন ১৫ই আগস্ট। ১৯৭৫ সালের এই দিনেরই সুবেহ সাদিকে আক্রান্ত হয় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের ঐতিহাসিক বাড়ি। সেই ভয়াবহ স্মৃতি নিয়েই প্রতিবছর ফিরে আসে ১৫ই আগস্ট। রাজধানীর মসজিদে মসজিদে যখন ফজরের আযান ধ্বনিত হচ্ছে: আসসালাতূ খাইরুম মিনান নাউম- এই পবিত্র ধ্বনিতে যখন ‘ঘুম অপেক্ষা নামাজ উত্তম’ ঘোষণা হচ্ছিল, তখনই গুলি-বৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বাড়িটিতে আর্তনাদের ঝড় বয়ে যায়।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের (দুই কন্যা ছাড়া) সব সদস্যকে অবিরাম ব্রাশ ফায়ারে ঝাঝড়া করে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বিশ্বাসঘাতক খুনিচক্র। সেই মর্মান্তিক শোকের স্মৃতি নিয়ে আগস্ট ফিরে এলে বারবার আমরা মুখোমুখি হই সেই নৃশংস ইতিহাসের।

১৫ই আগস্টের শোকাবহ এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি নিয়ে বাংলা ভাষায় অসংখ্য কবিতা রচিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কেমন ছিল ১৫ই আগস্টের সেই ভয়ঙ্কর দিনটি? জবাব খুঁজে নিতে পারি কবির উচ্চারণ থেকে: 

"সেদিন আকাশ কেঁদেছিলো
সেদিন বাতাস কেঁদেছিলো। বৃষ্টি নয়, আকাশের চোখে ছিল জল
গাছের পাতার শোকে সেদিন ঝরেছে অবিরল!
এসেছিলো সেই এক ভয়াবহ দিন!
চারদিকে ঘাতকের উদ্ধত সঙ্গিন!
মুছে দিতে চেয়েছিল রক্তের চিহ্নসহ জনকের লাশ
ভয়ার্ত বাংলায় ছিল ঘরে ঘরে চাপা দীর্ঘশ্বাস!
এদেশ নিস্তব্ধ ছিল বুকে চেপে শোকের আগুন!
নির্ভয়ে প্রকৃতি শুধু উচ্চারণ করেছিল: ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন!
সেই শোক জেগে আছে রক্তরাঙা ঐ পতাকায়।
সেই শোক অনির্বাণ এখনো বাংলায়
নদীর স্রোতের মতো চির বহমান
চরাচরে উচ্চারিত অমর শোকার্দ্র সেই নাম।
কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে এ শোকের আগুন।
পড়ো প্রিয় বাংলাদেশ- ইন্নালিল্লাহি
ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন!’’

সেই শোকবিহ্বল ১৫ই আগস্টের অবিস্মরণীয় স্মৃতি বারবার ফিরে আসে আমাদের কাছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তাঁদের শিশু সন্তান রাসেলসহ তিন পুত্র, দুই পুত্রবধূসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোরে শাহাদাত বরণকারী তাঁদের সকল স্বজন পরিজন শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রতিবছর শোক দিবসের স্মরণাঞ্জলি। যথারীতি এবারও জাতি গভীর শোক আর শ্রদ্ধায় পালন করছে ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। 

আগস্ট এলেই সপরিবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার ভয়াবহ স্মৃতি ফিরে আসে। সেই মর্মান্তিক স্মৃতি বিবেকবান মানুষ মাত্রকেই মর্মাহত করে। একইসঙ্গে ঘাতকদের প্রতি প্রবল ঘৃণাও জাগিয়ে তোলে। একথা আজ সর্বজনবিদিত যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শুধু একজন রাষ্ট্রপ্রধানকেই হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে স্বাধীনতার স্থপতিকে এবং মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তেভেজা একটি নবীন রাষ্ট্রের প্রগতিশীল অস্তিত্বকেই। যে কারণে জাতির পিতার হত্যাকারীরা ১৫ আগস্ট ভোরবেলায় ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণা দিয়ে পরিচয় পাল্টে দিয়েছিল। যদিও শহীদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ তা মেনে নেয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক দর্শনে বিশ্বাসী ঘাতকরা একাত্তরের ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করে দিয়ে গেল, তার বিষফল আজো ভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। যে কারণে আগস্ট আমাদের কাছে এক অবিস্মরণীয় শোক আর লজ্জার গ্লাণিতে নিমজ্জিত একটি মাস। 

আগস্ট মাসটি নানামাত্রিক নেতিবাচক ঘটনায় পূর্ণ। শুধু ১৫ই আগস্টের জাতীয় বিপর্যয়ই নয়, ১৯৭৫-এর এই আগস্টেরই ২৪ তারিখ বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্য কূশীলব জেনারেল জিয়া নিজেই নিজেকে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধানের আসন দখল করেন। ১৫ই আগস্টের হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের বিচার রুদ্ধ করার জন্য অমানবিক বর্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, পরবর্তী মাসের ৯ তারিখ, যা ১৯৭৯ সালে জেনারেল জিয়ার সরকার জাতীয় সংসদে অনুমোদন করিয়ে আইনে পরিণত করেছিল।

শোকের মাস আগস্ট এলেই মনে পড়ে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সারাদেশে মৌলবাদী জঙ্গিদের উত্থানের কথা, ১৭ই আগস্ট এক যোগে দেশের ৬৩টি বোমা হামলার ঘটনা, একুশে আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় বহু মানুষের প্রাণনাশের সেই ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কথাও! আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যার নীলনকশা কীভাবে তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল জঙ্গিগোষ্ঠী আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীকে ব্যবহার করে, তা আজ কারো অজানা নেই। আদালতের রায়ে সেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বহু নেতাকর্মীকে হতাহতকারী সেই খুনিচক্রের বিচারও শেষ হয়েছে। চিহ্নিত হয়েছে অপরাধীরা।

এরকম অনেক দুর্যোগময় ঘটনা জড়িয়ে আছে শোকাবহ আগস্টের সঙ্গে। কিন্তু এতো শোক, এত দুঃখের মধ্যেও জীবন সতত বহমান। বহমান বলেই শোককে শক্তিতে পরিণত করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ এত দ্রুত নানারকম প্রতিবন্ধকতার কন্টকিত পথ পেরিয়ে সাফল্যের পথে এতটা এগিয়ে যেতে পেরেছে। দারিদ্র্যে জর্জরিত যুদ্ধবিধ্বস্ত কপর্দকহীন অর্থনীতির বাংলাদেশকেই বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সুখী সমৃদ্ধশালী মর্যাদাবান একটি জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে। অনেক বিলম্বে হলেও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আরাধ্য বাংলাদেশ আজ বাস্তবায়নের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে মুছে যায়নি ১৫ই আগস্ট-এর সেই ভয়াল ক্ষতির ক্ষতচিহ্ন।

১৫ই আগস্ট এলেই জাতি তার আপন দর্পণে দেখতে পায় বিশ্বাসঘাতকতার এক জঘন্য ইতিহাসের প্রতিবিম্ব। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ঘাতকের গুলিতে অকালে না-ফেরার জগতে চলে যাবার মধ্য দিয়ে যে মানুষটি সমস্ত প্রভাবের উর্ধ্বে, তাঁরই অবর্তমানে প্রায় দুই যুগ পর বিবিসির জরিপে তিনিই হলেন হাজার বছরের ইতিহাসে সর্বশেষ্ঠ বাঙালি! বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মর্মান্তিক স্মৃতিবিজড়িত ১৫ই আগস্ট বছর ঘুরে বারবার ফিরে আসে আর আমাদের ইতিহাসের সেই কলঙ্কিত অধ্যায় স্মরণ করিয়ে দেয়, তা বঙ্গবন্ধুর তো বটেই, বাংলার সাধারণ মানুষের কাছেও ছিল অকল্পনীয় ঘটনা।

যে বঙ্গবন্ধু তাঁর আজন্ম স্বপ্নে লালিত জন্মভূমিকে ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে কৈশোর থেকে টানা তিন দশক লড়াই করলেন, বছরের পর বছর জেল জুলুম নির্যাতন সহ্য করে সোনার যৌবন কারাগারেই কাটিয়ে দিলেন, সেই মহাপ্রাণ মানুষটিকে তাঁরই লড়াই সংগ্রামের ফসল এই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রাণ দিতে হবে, তাঁরই নিজ হাতে গড়া সশস্ত্র বাহিনীর কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী জুনিয়র অফিসারের গুলিতে! এও কি কল্পনা করা যায়?

সেই অকল্পনীয় নৃশংসতার শিকার হয়েছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান! ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ভোরের আলো ফোটার আগেই বঙ্গবন্ধুর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছিল সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী কতিপয় বিশ্বাসঘাতক। তাঁর সঙ্গে নিহত হন বঙ্গবন্ধুর জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রেরণাদায়ী স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসার দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেল, ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী সেরনিয়াবাত, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, ভ্রাতুষ্পুত্র শহীদ সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল আহমেদ এবং ১৪ বছরের কিশোর আব্দুল নইম খান রিন্টুসহ ১৮জন মানুষ!

সেই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুধু বঙ্গবন্ধু-শেখ মুজিবুর রহমান নামের একজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা কিংবা আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দলকেই ক্ষমতাচ্যুত করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের রক্তে অর্জিত একটি ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক দর্শনের প্রগতিশীল আধুনিক রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে। ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড আসলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির প্রগতিশীলতার অস্তিত্বকেই পরিকল্পিতভাবে মুছে ফেলার পরিকল্পনাজাত। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিলেন, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যারা এই হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত, তাদের মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী লোকও ছিলেন। ফলে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র যে তাকে হত্যা করেছে, এ নিয়েও বিভ্রান্তির কুয়াশা সৃষ্টিরও একটা অপচেষ্টা হয়েছে।

যেমন জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার, তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সমর্থন করেছেন, প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে তাদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশনে পুনর্বাসিত করেছিলেন, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি সংসদে সংবিধানে লিপিবদ্ধ করিয়েছিলেন। জিয়ার প্রসঙ্গে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও অনেকেরই স্খলন পরবর্তীকালে আমরা লক্ষ্য করেছি। যে কারণে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক মুক্তিযোদ্ধা (!)দের সমাবেশ সম্মেলনও আমরা ঢাকায় দেখেছি। অথচ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত শুধু বিরোধিতাই করেনি, পাকবাহিনীর সশস্ত্র সহায়ক হিসেবে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে বাংলার মাটি সিক্ত করেছে। সুতরাং তাদের সমর্থক মুক্তিযোদ্ধারা কেমন মুক্তিযোদ্ধা সেটা দেশবাসী বিবেচনা করবেন।

যে কর্নেল ফারুক-রশিদরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিল বটে কিন্তু ছিল পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা চক্রের অনুচর। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তান থেকে তারা ভারতে ঢুকেছিল এবং তাদের সম্পর্কে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদসহ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল। যে কারণে সন্দেহভাজন বাংলাভাষী এই তরুণ সামরিক চরদের গ্রহণে দ্বিধা এবং অসম্মতিও ছিল। শেষ পর্যন্ত এরা মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন জেড ফোর্সে সংযুক্ত হয়। পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীতে তাদের ভূমিকা, এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে এদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা আজ সকলেরই জানা।

১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস সারারাত ছিল সজাগ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানের সমর্থক তৎকালীন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা, পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাসহ বহু বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী ও দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের যোগসাজশ যে ছিল, তা বহু গোপন নথিপত্র প্রকাশে এবং বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিচারণমূলক প্রকাশনার মধ্য দিয়ে গত ৪০ বছরে প্রমাণিত।

দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যায় মূলত সেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীই জড়িত ছিল যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেমন বিরোধী ছিল, তেমনই বাংলাদেশ রাষ্ট্র মেনে নিতেও পারেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্বাপর ঘটনার দিকে তাকালে দেখা যাবে ঘাতকচক্র তাকে তখনই হত্যার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেছে, যখন তিনি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক সমাজকাঠামোয় বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে শুরু করেন, অর্থাৎ কৃষক এবং শ্রমিকের রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের মধ্য দিয়ে প্রশাসন এবং অর্থনীতি নতুন বিন্যাসে পুনর্গঠন করছিলেন। পুঁজিপতি, ভূস্বামী, সামরিক- বেসামরিক আমলা থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক শাসন- শোষণে বিশ্বাসীরা বঙ্গবন্ধুর এই কৃষক-শ্রমিকের ক্ষমতায়ন বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা মেনে নিতে পারেননি। আর মার্কিন পরাশক্তি তো আগাগোড়া ছিল বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে।

এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময়-পরিকল্পনার আলোকে অনুসন্ধান করলে বেরিয়ে আসে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর স্বজন-পরিজনদের প্রতি ভয়ঙ্কর ক্রোধের কারণও। ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে গত চার দশকে অনেক অনুসন্ধানী গবেষণা হয়েছে, তাতে দেশের অভ্যন্তরের স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ভূমিকা যেমন স্পষ্ট, তেমনি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মুখোশও অনেকখানিই উন্মোচিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তৎকালীন বহু গোপন নথিপত্র এবং বিধিমাফিক ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের অনেক গোপন প্রতিবেদন ইতোমধ্যে উন্মুক্ত হয়েছে। তাতে ১৫ই আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনে কীভাবে কারা যুক্ত ছিল এবং হত্যার মূল উদ্দেশ্য কী ছিল, তার অনেকটাই উন্মোচিত।

কেন বঙ্গবন্ধুর সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠন শান্তিপূর্ণভাবে করতে পারছিলেন না, স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেশের অভ্যন্তরে নানামুখি সন্ত্রাস এবং নৈরাজ্যের কেন এত ডামাঢোল বেজে উঠেছিল? সেসবের কারণও অনেকটাই এখন স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধু আমাদের সংবিধানে যে মূল চারটি স্তম্ভ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্ধারণ করেছিলেন তার একটি ছিল সমাজতন্ত্র। সেটি থাকা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও কেন ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নামে জাসদের মতো রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি করতে হলো বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মধ্যে, নিশ্চয়ই উদ্ভাবনের সময় এসে গেছে। কেন সিরাজ সিকদার, আবদুল হক, তোহা প্রমুখ অতিবাম রাজনীতিকেরা নানারকম বাহিনী সৃষ্টি করে সারাদেশে ‘শ্রেণিশত্রু’ খতমের নামে গলাকাটার রাজনীতি শুরু করেছিল? এসব ঘটনার পেছনে সুদূরপ্রসারী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র যে ছিল, তাও বেরিয়ে আসছে ক্রমান্বয়ে!

অকাল প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের গবেষণামূলক একটি গ্রন্থে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নীলনকশা ঢাকায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সিআইএর প্রত্যক্ষ মদদে এবং ভূমিকায় যে প্রণীত হয়েছিল, তার বহু তথ্য পাওয়া যায়, যা পড়লে চমকে উঠতে হয়। বইটিতে দালিলিক তথ্য প্রমাণসহ এসব ষড়যন্ত্র তুলে ধরা হয়েছে। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজের গ্রন্থেও এ সংক্রান্ত বহু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

আজ সময় এসেছে বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে একটি ট্রুথ কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে এই হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের মুখোশ জাতির সামনে উন্মোচন করা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও জানা দরকার হাজার বছরের পরাধীন জাতিকে যিনি প্রথম একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকারী করলেন, কী ছিল তাঁর স্বপ্ন এবং জীবন সাধনা? জানাতে হবে এ দেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতির ৫৫ বছরের স্বল্পপরিসর জীবনের চরম ত্যাগ স্বীকার আর অসামান্য অবদানের কথাও।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর বাংলাদেশের দু’তিনটি তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ে ছিল অন্ধকারে। বহুল ইতিহাসের মধ্য দিয়ে চালিত হয়ে প্রকৃত ইতিহাস আজ অনেকে গ্রহণ করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। তাদের কাছে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন নেই। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নৌকা প্রতীক নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমগ্র জাতির প্রতিনিধি হিসেবে যে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছিল সেই ইতিহাস নেই। সেই প্রজন্ম জানে না নির্বাচনের বিজয়ী হওয়ার পর বাংলার মানুষকে বঞ্চিত করার জন্য জেনারেল ইহাহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো কী গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং ২৫শে মার্চের ভয়াল গণহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছিলেন!

ওই ২১ বছর কাল পরিসরে যে ক'টি তরুণ প্রজন্ম বেড়ে উঠেছিল তাদের কাছে পহেলা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু আহুত অসহযোগ আন্দোলন নেই, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ নেই, এমন কি নেই ২৫ই মার্চের ভয়াল গণহত্যার ইতিহাসও। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু যে ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) বাহিনীর অয়্যারলেসে পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণা এবং শেষ নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে, তাও বহু কাল জানতে দেওয়া হয়নি জাতিকে। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র সংবলিত ইতিহাস পর্যন্ত সংশোধন করে ফেলেছে তারা!

সুতরাং এমন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যে জাতিকে যেতে হয়েছে, সে জাতির বিভাজন মোচন করা সম্ভব নয়। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিনই এই বিভাজন থেকে যাবে। লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত এই স্বাধীন দেশ, দুর্ভাগ্যক্রমে স্বাধীনতা বিরোধীচক্রের প্রবল অস্তিত্ব মেনে নিতেই হবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতার শত্রুদের পরাস্ত করতে পারলেও, ৭৫ পরবর্তী ২১ বছরে তাদের যে পুনরুত্থান ঘটেছে, তার বিষফল ভবিষ্যতেও ভক্ষণ করতে হবে বাংলাদেশকে। সে কারণে ১৫ই আগস্টের হত্যাকারীদের সমর্থকদের অস্তিত্বও রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতাতেই টিকে থাকবে। এর চেয়ে চরম দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে!

মাঝে মাঝে রাজপথে উচ্চকণ্ঠ স্লোগান শোনা যায় ‘৭৫-এর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’! এর মধ্যে দিয়ে তারা পরিষ্কারভাবে বোঝাতে চাচ্ছে যেভাবে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছে, সেভাবেই তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। সেই চাওয়ারই পরিণাম ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধানকে হত্যার চেষ্টা করা না হলেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে ২৬ বছরে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।

এই একটি দৃষ্টান্ত থেকেই স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি আর বিপক্ষের শক্তিতে বিভাজিত বাংলাদেশের চেহারা চরিত্র স্পষ্ট হয়ে যায়। তাই উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ আমরা দেখতে পাই। অতি সম্প্রতি মফস্বল কলেজের একজন পেনশনভোগী অধ্যাপক যিনি আমার আত্মীয়, প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলেন আমার ওপর। বললেন: তাদের সম্পর্কে এমন বাজে কথা বলেন কেন? জামায়েতে ইসলাম সমর্থন করে যারা তারা কি মানুষ না?

কিছুই বলিনি। মুখে কোনো কথা সরেনি। মর্মাহত চিত্তে শুধু তাকিয়েছিলাম তার দিকে। ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে গেছে চিন্তা করে দেখুন। যে অনন্য ঐক্য অর্জন করেছিল বাংলাদেশ ১৯৭০-এর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাঙালিকে বঙ্গবন্ধু বীরের জাতিতে পরিণত করেছিলেন কেবল ঐক্যের শক্তিতে, সেই জাতির প্রায় অর্ধেক মানুষ আজ স্বাধীনতাবিরোধীদের সহযোগীর ভূমিকায়! এই চিত্রের মধ্য দিয়ে ১৫ই আগস্ট এর সর্বনাশের মাত্রা যে কী ভয়ানক পর্যায়ের তা অনুভব করা যায়।

লেখক: কবি; উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক দেশের কণ্ঠ; সাবেক পরিচালক, বার্তা, বাংলাদেশ টেলিভিশন
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়