যুগপূর্তি সংখ্যা
গণমাধ্যমের কর্কট রোগ
তুষার আবদুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

গণমাধ্যম কি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি? প্রকৃতির অদল-বদল কিংবা মানুষের হাতে গোলক ধ্বংসের তাণ্ডব দেখে, সুপ্ত আগ্নেয়গিরি হয়তো জেগে ওঠে ক্ষোভে এবং প্রতিবাদে। গণমাধ্যমকে ‘সুপ্ত আগ্নেয়গিরি’ বলছি এজন্য যে, এর অন্দরে ক্ষোভের তুফান বহুদিনের। একটা সময় অবধি এই তুফানের জন্ম-মৃত্যুর সীমানা অন্দরেই সীমিত ছিল। এখন প্রতিবাদ ও ক্ষোভের আফালের ঝাপটার প্রথমটিই বাইরে চলে আসে। এতে সামষ্টিকভাবে গণমাধ্যমের একটি বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে বা গেছে। পারিবারিক মতবিরোধ, ঝগড়ার খবর যখন প্রতিবেশী বা গলির মোড়ের ধোপার ঘরে গিয়ে পৌঁছে, তখন দম্পতি যতোই বেলিফুল সমেত রিকশায় ঘুরে বেড়িয়ে আসুন না কেন, সেই প্রেম ও সুখে প্রতিবেশীদের আস্থা, বিশ্বাস থাকে না। একই কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে গণমাধ্যমে।
এখন গণমাধ্যমের প্রযুক্তি-বান্ধব রূপান্তরকাল চলছে। এই সময় প্রাতিষ্ঠানিক ঘের থেকে বেরিয়ে গেছে সাংবাদিকতা। প্রতিষ্ঠান এককভাবে নিজেকে ‘গণমাধ্যম’ বলে দাবি করার মুরোদ ধরে রাখতে পারছে না। এখন ব্যক্তি এককভাবে গণমাধ্যমের দাবিদার হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তি এককভাবে উপস্থিত হচ্ছেন নিজের মতামত নিয়ে; একান্তই নিজের কোনো গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের নয়। এখানে তিনিই সংবাদ বা তথ্য পরিবেশন করছেন নিজস্ব সম্পাদকীয় বিবেচনা দিয়ে। ফলে ব্যক্তিকে তার মতামত জানানোর জন্য এখন প্রাতিষ্ঠানিক কোনো মাধ্যমের কাছে যেতে হচ্ছে না। এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক গণমাধ্যমের বিস্ফোরণ ঘটেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এখানে যে ঘটনার তাৎক্ষণিক স্থিরচিত্র, ভিডিও সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে ব্যক্তির মাধ্যমে, এদের কাছে ‘মূলধারা’ বলে আত্মচিৎকার করা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো কুপোকাত হচ্ছে নিত্য। যে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা বা ইভেন্ট পত্রিকা, বেতার, ওয়েব পোর্টাল এবং টেলিভিশনের আগেই তারা সম্প্রচার করছেন। বাস্তবতা হলো, খবরের ভোক্তারা এখন প্রাতিষ্ঠানিক গণমাধ্যমের ভরসায় থাকছেন না। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়ানো ‘ব্যক্তি’ মাধ্যমগুলোকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এক বা একাধিকের কাছ থেকে ভোক্তারা ঘটনার অসম্পাদিত তথ্য এবং চিত্র পেয়ে যাচ্ছেন। তাই মূলধারার লেবেল আঁটাদের পাত্তা দিচ্ছেন না ভোক্তারা।
এখানে বলে রাখা ভালো, এই ব্যক্তি মাধ্যমগুলো নির্ভেজাল তথ্য বা ছবি দিচ্ছেন একথা বলা যাবে না। তারাও দলমাধ্যম হিসেবে কাজ করছেন। যে যেই দল বা মতের, সেই চিন্তা ও চোখে ঘটনা পরিবেশন করেন। একেবারে বিপণীবিতানের আগুন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি, সর্বত্রই তার ব্যক্তিগত পক্ষপাতের প্রভাব সুস্পষ্ট। এই ব্যক্তি মাধ্যমগুলো মুহূর্তেই ভোক্তা কেড়ে নিচ্ছে। বাজারে খবরের যে ভোক্তা সেখানে সিংহভাগ তারা দখল করে নেয়াতে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে ভোক্তা সংকটে। দিশেহারা অবস্থা তাদের। প্রতিষ্ঠান এখন নেমেছে ব্যক্তির সঙ্গে ভোক্তা কাড়াকাড়ির লড়াইয়ে। এই লড়াই করতে গিয়ে যে কনাখানিক দায়িত্ববোধ বা নৈতিকতা পাতিলে আটকে ছিলো, সেটুকুও খসে পড়েছে।
প্রশ্ন হলো- ব্যক্তি যেমন দলমাধ্যম বা দলকানা, প্রতিষ্ঠানও তাই। তাহলে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তির দিকে ছুটছেন কেন ভোক্তারা? প্রথমত প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে কোনো গণমাধ্যমই পরাধীন। লগ্নি যিনি করেছেন, তার নির্দেশনা ও মতের বাইরে যাওয়া চলে না। তার স্বার্থ দেখে খবর সংগ্রহ ও পরিবেশন করতে হয়। গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, তাদের নির্দেশনা বা পরামর্শের প্রতি সর্বোপরি সরকারের কাছে নানা নিষেধাজ্ঞার তালাচাবি থাকায়, সরকারের প্রতি নতজানু থাকতেই হয়। সরকারের নানা দেখা-অদেখা ‘যন্ত্র’ আছে। সেই যন্ত্রভীতিও কাজ করে। তার ওপর আছে গণমাধ্যমের কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুরক্ত থাকা। এই গুচ্ছ কারণগুলোকে তুষ্ট করে যে খবরটি বেরিয়ে আসে সেটা প্রক্রিয়াজাত। খবরের ভোক্তারা এক সময় নিরুপায় হয়ে এই প্রক্রিয়াজাত খবর গিলে ফেলতেন। কিন্তু এখন যেহেতু উপায় আছে অপেক্ষাকৃত সতেজ, টাটকা খবর পাওয়া বা দেখার, ভোক্তারা এই মাধ্যমে ঝুঁঁকছেন।
ভোক্তারা ব্যক্তি মাধ্যমে ঢুকে পড়ার কারণে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ধারা বা মোড়ক বদলে ফেলছে। ফলে পত্রিকা শুধু কাগজের হরফ সর্বস্ব থাকলো না, তার মূল মনোযোগ চলে গেল দৃশমাধ্যম বা ডিজিটাল কন্টেন্ট বা আধেয়তে। টেলিভিশন ‘বাক্সো’গুলোও ভোক্তার কাছে পাঠানোর জন্য আর ভরসার জায়গা তৈরি করতে পারছে না। তাদেরও আন্তর্জালে ডুব দিতে হলো। আদর পরলো বেশি ডিজিটাল কন্টেন্টের দিকেই। ওয়েব পোর্টাল এবং ধুঁকে ধুঁকে চলা এফএম বেতারের গন্তব্যও একই দিকে ছুটলো। এই ছুটতে গিয়ে যে বিপত্তি বাঁধলো, সেটা হচ্ছে ভুল, গুজব এবং চটকদার খবর তৈরি করা। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে গণমাধ্যম কর্মীদের একটি বড় অংশ মনস্তাত্বিকভাবে যুক্ত হতে পারছেন না। তারা রাজনৈতিক বা শিল্পগোষ্ঠীর প্রভাবে প্রক্রিয়াজাত খবর কখনও মেনে নেয়নি। কিন্তু বাজারে চাকরি সুলভ না থাকায় বা সব প্রতিষ্ঠান একই ‘কারখানা’য় পরিণত হওয়ায় নিরুপায় হয়ে সাংবাদিকতার চেয়ে চাকরিটাই করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ডিজিটাল কন্টেন্ট বা আধেয়তে এসে বানোয়াট ও যৌনতার রস দেয়া খবর প্রক্রিয়াজাতকরণকে তারা মেনে নিতে পারছেন না। প্রতিবাদে প্রথমে প্রতিষ্ঠান, এবং অনেকে গণমাধ্যম ছেড়ে বিকল্প চাকরিতে পাড়ি জমাতে শুরু করেন।
এই যে প্রতিবাদ বা অভিমান গণমাধ্যমের প্রতি কর্মীদের; আরো যে কারণে সেটি হলো- দলমাধ্যম হয়ে পড়া। গণমাধ্যমে যারা কাজ করতে এসেছিলেন, বিশেষ করে ১৯৯০ বা ২০০০ সালের পর, তারা সকলে রাজনৈতিক দলের কর্মী থেকে সরে এসে এই মাধ্যমে কাজ করতে আসেননি। যেটা এর আগে রেওয়াজ ছিল। বাম বা ডান রাজনৈতিক দলের যে কর্মীরা ফুল টাইমার ছিলেন বা হাফ টাইমার, তারা পার্টির মুখপত্র বা আদর্শিক পত্রিকায় কাজ করতেন। ১৯৯০ বা তার কিছু আগে থেকে, বিশেষ করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় বের হওয়া পত্রিকাগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজপড়ুয়ারা যোগ দিতে শুরু করেন। সেই ধারা এখনও অব্যাহত আছে।
এদের বড় অংশটি যেমন সাংবাদিকতা করতেই এসেছিলেন, ‘এসেছিলেন’ বলছি এ কারণে, এখন এই দলের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। আবার সাংবাদিকতা করতে এসে বিদ্যায়তনে যুক্ত থাকা রাজনীতিকেও ভুলতে পারেননি একটি অংশ। এই অংশটি সাংবাদিকতায় ক্রমশ বড় হচ্ছে। এখানে দলের প্রতি যারা আনুগত্য দেখাচ্ছেন, সেটা দলীয় আদর্শের প্রতি ভালোবাসা বা দলীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য যতোটা না, তারচেয়েও বেশি ব্যক্তিস্বার্থে। পদ, পদবি, পদক ও সম্পদ হাতিয়ে নিতেই দল ও নেতা বন্দনায় সরব এই প্রকারের গণমাধ্যমকর্মীরা। এই গণমাধ্যমকর্মীরাই বার্তাকক্ষ বা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে দলীয় মেরুকরণে প্রভাব রাখছেন। ভিন্ন মত বা মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা গণমাধ্যমকর্মীদের শুধু বিরোধী ভাবাই হয় না, সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী বলেও চিহ্নিত করা হয়। সরকার বা সরকারের সহায়ক যন্ত্রের কাছে তথ্য বা তালিকা দেয়ার কাজটিও গণমাধ্যমকর্মীরাই করছেন। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তি বা মালিকপক্ষ নিজেদের নিরাপদ রাখতে এই প্রক্রিয়ায় নীরব সম্মতি দেন। কখনও কখনও অতি আগ্রহী হয়ে ভিন্ন মতের গণমাধ্যমকর্মীদের কর্মস্থলে নিষ্ক্রিয় রাখা, কর্মস্থল থেকে সরিয়ে দেয়া, অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের গণ্ডির বাইরে পাঠানোরও ছক আঁকা হয়।
গণমাধ্যমের ভেতরের এই রাজনৈতিক মেরুকরণ, সাংবাদিকতার জন্য অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে। গণমাধ্যম আক্রান্ত কর্কট রোগে। এই রোগটি ভেতরে বাসা বেঁধেছিল। লোকেরা জানতে পারেনি। কিন্তু একপক্ষের সাংবাদিকতা করতে না-পারার চাপা দীর্ঘশ্বাস যখন প্রতিবাদ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন উপায়ে ভোক্তার কাছে পৌঁছালো, অন্যদিকে আরেক পক্ষ তাদের রাজনৈতিক মত ও বিশ্বাসের প্রকাশ সাংবাদিকতা ও তার বাইরে ঘটাতে থাকলো, তখন সেই কর্কট রোগ ভোক্তাদের কাছেও দৃশ্যমান হতে শুরু করল। কর্কটে আক্রান্ত হয়েছে সব পক্ষের গণমাধ্যমকর্মীর মগজ। কারণ বন্দনার বাইরে গিয়ে তারা আর কোনোভাবেই সাংবাদিকতা করতে পারছেন না। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের বাইরে, যে কোনো কৃষিজ উৎপাদন, স্বাস্থ্য, বিনোদন বা পর্যটনের খবর পরিবেশন করতে গিয়েও অঙ্ক কষে দেখে নেয়, সরকারের পক্ষে না বিপক্ষে গেল। কারণ খবরটি বার্তাকক্ষের কাছে ‘বিক্রি’ করতে হলে সরকারমনস্ক হতে হবে। ব্যতিক্রম আছে। কয়েকটি গণমাধ্যম বরাবরই সরকারবিরোধী একটি অবস্থান নিয়ে রাখে। তাদের কাছে এ ধরনের খবরপণ্য সহজে বিক্রি হয়। বা তারা তৈরি করে নেয়। এদের আবার সরকারবিরোধী অবস্থানের সূক্ষ্ম একটি কারণ সাধারণের কাছে নিরপেক্ষ ‘ইমেজ’ তৈরি করে রাখা। এবং বড়শীতে ভোক্তা আটকানো। এরাও নিজস্ব মতলবের খবর তৈরি করে। মতলব বুঝে সহ্য করে যান গণমাধ্যমকর্মী। কখনও উষ্মা প্রকাশ যে হয় না, তা নয়। যাদের শারীরিক ভাষা প্রতিবাদের, তাদের প্রতিষ্ঠান ছাড়তে হয়, হয়েছে।
গণমাধ্যমের অন্দর তপ্ত হয়ে ওঠার আধুলী পরিমাণ কারণ হচ্ছে, চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা। ১৯৯০-এর পর থেকে আমরা দেখতে পাই সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ও দৈনিকের নামে সারাদেশেই সহস্র পত্রিকা বাজারে এসেছিল। বিনিয়োগ করেছিলেন রাজনীতি-ঘনিষ্ঠ মানুষেরা। এবং ব্যবসার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগ করেন। সেই বিনিয়োগ টেলিভিশন, আইপি টিভি হয়ে অনলাইন পত্রিকায় পৌঁছেছে। এদের ৮০ ভাগই শুরু বা মাঝপথে গিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পুরো ইনিংস খেলার ইচ্ছেটা মরে যায়। কারণ যে প্রভাব দেখাতে পারবেন বলে ভেবেছিলেন, সেটা দেখাতে না পারা এবং বিনিয়োগ করার সক্ষমতা ও ইচ্ছে হারিয়ে ফেলা। তারা গণমাধ্যম বিক্রি করে দেন, বন্ধ রাখেন বা কোনোভাবে এক-দু’জন দিয়ে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেন, ভবিষ্যতে কোনো সুযোগ আসার অপেক্ষায়। ১০ ভাগের লক্ষ্যই হচ্ছে বিজ্ঞাপন ব্যবসা বা নিজের ব্যবসার ঢাল হিসেবে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা। জমি দখল, চাঁদাবাজ প্রতিরোধেও ব্যবহৃত হয় গণমাধ্যম। বিরুদ্ধ পক্ষের বিরুদ্ধে নিজের কর্মী বাহিনীকে নামিয়ে দেয়া হয় সংবাদ বোমা তৈরি করতে। ৫ ভাগ প্রথমে গর্জন করে আসলেও, বর্ষণ সেভাবে হয় না। অল্পতেই ফুরিয়ে যায়। বড় বিনিয়োগের মুলো বা পূর্বাভাস দেখালেও, কিছু সময় পরেই তাদের কৃপণতা ও সামর্থ বুঝে যায় সংবাদকর্মীসহ গণমাধ্যমের ভোক্তারা। বাকি পাঁচ ভাগ চলে আবহাওয়ার সঙ্গে আপোস করে। কখন ছাতা আর কখন রেইনকোট পরতে হবে, এটা বুঝে না চললেই বিপদ!
তাহলে গণমাধ্যমের আত্মপ্রকাশ, বিনিয়োগ ও আবহাওয়ার মূল নির্যাস হলো- যেভাবে গণমাধ্যমে যুক্ত হচ্ছে, সেই গতিতে তাদের কাজ ছাড়া হতে হচ্ছে। কতোদিন কাজ থাকবে, বেতন, পদোন্নতি হবে কিনা, নিশ্চয়তা নেই। বলে রাখা ভালো, বেতন বাড়ানো, পদোন্নতির বিষয়টিও চলে কর্তার ইচ্ছেখুশীতে, গণমাধ্যমের ভেতরের মেরুকরণ অনুসরণ করে। দুই একটা ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না। যোগ করতে হয় বেতন কাঠামোর বিষয়টিকেও। পত্রিকার দাপুটে যুগের স্বল্প বেতনের মনস্তত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি কর্পোরেট লেবাসে মুখ ঢাকা গণমাধ্যম। পরিচয়পত্র, আঙুল বা অবয়ব দেখিয়ে অফিসে প্রবেশ-প্রস্থানেই কর্পোরেটের ষোলো আনা শেষ অধিকাংশ গণমাধ্যমের। বেতন কাঠামো বাজারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা খাতের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা হয় না, ওয়েজ বোর্ড, উৎসবভাতা, প্রফিডেন্ট ফান্ড, ছুটির টাকা দেয়ার অভ্যাস তৈরি হয়নি। কোথাও কোথাও তৈরি হলেও অভ্যাসের আয়ু ক্ষণিকের।
গণমাধ্যমের নীরব আরেকটি শোষণ বেতনের মাইলফলক ঠিক করে দেয়া। একটি সময়ের পর যোগ্যতা থাকার পরও বেতন না বাড়ানো, কর্মীকে সোনালি করমর্দন বা বাধ্যতামূলক অবসরে প্ররোচিত করা; চাকরির এমন একটি সময়ে কাজটি করা হয়, যখন কর্মীর কোনো বিকল্প চাকরি খুঁজে পাওয়া প্রায় কঠিন। অথচ অন্য গণমাধ্যমের কর্মী ছিনিয়ে আনা, নিজ পক্ষে বন্দনা জিকির করা কর্মীকে অপ্রত্যাশিত ও নতুন নতুন তৈরি করা পদে তুলে দিয়ে অসময়ে বেশি বেতনে পৌঁছে দেয় গণমাধ্যমই। যখন স্বার্থ শেষ, তখন পৌঁছে দেয়া হয় প্রস্থানের মাইল ফলকে।
গণমাধ্যমের অন্দরের গোত্র বিভক্তি এখানে কাজ করা মানুষদের সবসময় মানসিক অস্থিরতার মধ্যে রাখে। কখন কোন পক্ষে যাবে, কোন পক্ষে যাওয়া ঠিক হবে কিনা, নিরপেক্ষ থাকাটাও কতোটা নিরাপদ এ নিয়ে মানসিক বৈকল্য তৈরি হয়। সেই সঙ্গে কাজের অতিমূল্যায়ন ও অবমূল্যায়নও মনস্তাত্বিক সংকটের কারণ। এর সঙ্গে নারী সহকর্মীদের যৌন হয়রানীর বিষয়টি উল্লেখ করতেই হবে। নারীকে কাজ দেয়ার প্রচ্ছন্ন শর্ত থাকবে সহকর্মী বা তাকে যিনি পরিচালিত করেন, তার সঙ্গে একটি সম্পর্ক রক্ষা করে চলা। সেই সম্পর্ক উঠোনের কোন চৌকাঠে নিয়ে যাবে, সেটি কখনও নারী কর্মীর প্রত্যাশা ও লোভের ওপর যেমন নির্ভর করে, তেমনি তার প্রয়োজন ও অসহায়ত্বের সুযোগে বাধ্যও করা হয়। এসব বিষয় এক সময় ফিসফাসে আটকে থাকলেও, এখন বেশ চড়া কণ্ঠে বলা হচ্ছে। প্রতিবাদ হচ্ছে জোড়ালো। কিন্তু রায়ে এখনও পুরুষ মনস্কতা!
গণমাধ্যমের এই কর্কট রোগ শরীরে বাহ্যিকভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠায়, এই মাধ্যমকে ‘গুড বাই’ জানাচ্ছেন মেধাবীরা। নতুন করে মেধাবীরা এ পেশায় আসছেনই না। যারা আছেন, তারাও বিদায় বলতে শুরু করেছেন। সব হিসেব-নিকেষের পরও সাংবাদিকতাকে ভালোবেসে রয়ে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা এখনও ঈর্ষণীয়। তারা চাপা ক্ষোভ নিয়ে টিকে আছেন। কেউ কেউ প্রতিবাদ করছেন। ক্রমশ এই প্রতিবাদ উচ্চকণ্ঠ হচ্ছে। কিন্তু মুশকিল হলো সেই উচ্চকণ্ঠের সঙ্গে দলমাধ্যম ও মতলবের গণমাধ্যমকর্মীদের কণ্ঠও মিশ্রিত হয়ে যাচ্ছে। তারা অপ্রাসঙ্গিক, তথ্যহীন মন্তব্য সামনে নিয়ে এসে অস্থিরতা তৈরি করছেন। যা সাধারণ ভোক্তাদের বিভ্রান্ত করছে।
সাংবাদিকদের পেশাজীবী সংগঠনগুলোও রাজনৈতিক মতে বিভক্ত। এখন তো আবার দপ্তরভিত্তিক লোভের গুড়ের সংগঠনও তৈরি হচ্ছে। এসব কোনো সংগঠনই পুষ্টিকর সাংবাদিকতা বা গণবান্ধব সাংবাদিকতার জন্য কাজ করছে না। সাংবাদিকতার গুণগত মান বাড়ানোর বেলাতেও তাদের মন নেই। মন তাদের প্লট, ফ্ল্যাট, ফ্যামিলি ডে ও বিদেশ ভ্রমণে। ফলে প্রকৃত গণমাধ্যমকর্মী মূলত একা। প্রকৃত তাকেই বলছি, যিনি সাংবাদিকতাকে ভালোবেসে বা নেশা হিসেবে নিয়ে এই পেশায় আসেন এবং টিকে থাকার চেষ্টা করেন। তাকে একাই পেশায় টিকে থাকার লড়াইটি করে যেতে হচ্ছে।
গণমাধ্যমকে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির সঙ্গে তুলনা করেছি গোড়াতে। বলেছি জেগে ওঠার কথাও। অন্দরের যে অস্থিরতার কথাগুলো বলা হলো, সেগুলো নিয়ে এই রূপান্তরকালে গণমাধ্যমকর্মীরা দমে থাকবে এ আমি বিশ্বাস করি না। তাদেও মনোজগতের রূপান্তরও ঘটবে। এই রূপান্তর প্রয়োজন এখানে মেধাবীদের আগমন ও টিকে থাকার জন্য। পত্রিকা, বেতার, টেলিভিশন, ওয়েবপোর্টাল বা ইউটিউব, যে আকার-প্রকারের হোক না কেন, গণমাধ্যমকে অবশ্যই ভোক্তার আস্থায় পৌঁছাতে হবে। রাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বও সুষম গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল।
গণমাধ্যমকে সুষম থাকার কথা বলা হলেও, নিজে থেকেই গণমাধ্যম নিজের স্বাস্থ্যহানী ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশে নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি এই অবিচারটি পত্রিকার সময় থেকেই শুরু। কিছু পত্রিকা তো অবশ্যই দলীয় মুখপত্র পরিচয়েই প্রকাশ পেয়েছিল। কোনো কোনো পত্রিকার মালিকানা ছিল দল সমর্থিত ব্যক্তির। এমনটা এখনও আছে। পত্রিকার মতো করে ওয়েব পোর্টাল এবং টেলিভিশনের মালিকানাও এভাবেই দেয়া হয়েছে বা আদায় করা হয়েছে। এদের মধ্যে কোনো কোনো গণমাধ্যমে নিজ সমর্থিত দলের খবর যেমন করে প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, অন্য দল বা মতের খবর সেভাবে হয় না। এ নিয়ে অবশ্য বিরোধী পক্ষের উষ্মা ছিল, আছে। এক সময় হয়তো সেই উষ্মার প্রকাশ ছিলো না। বা প্রকাশের কৌশলটিও ছিল সহিষ্ণু। এখন আর সেটি নেই। এই যে এখন কথাটি বললাম, তার শুরু আড়াই দশক আগেই।
নিজে মাঠের রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা যদি বলি, তাহলে ‘একুশে’ টেলিভিশনের শুরুর সময় থেকেই একে বলা হতো তখনকার ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদপুষ্ট। সেটা বলা যেতেই পারে। কারণ সরকারের আনুকুল্য ছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশনের মতো টেরিস্টোরিয়াল সুবিধা নিয়ে কোনো বেসরকারি টেলিভিশনের আত্মপ্রকাশ সম্ভব ছিলো না। এটুকু ঠিক ছিল। কিন্তু এর সঙ্গে মাঠে-ঘাটে বলা হতো টেলিভিশনের মালিকানার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সভাপতির বোন যুক্ত। বিরোধী রাজনৈতিক দলই না শুধু, তাদের সমর্থিত দর্শকরাও একথা বলতেন। ফলে সাধারণ দর্শকদের মাঝেও এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ছিলো। একুশে টেলিভিশন সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন ছিলো না। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা এবং রাত সাড়ে এগারোটায় দুটো খবর প্রচারিত হতো। কিন্তু বিটিভির বাইরে নতুন আঙ্গিকে খবর প্রচার করায়, এই দুই খবর দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। পরে খবরের সংখ্যা বাড়ে। দুপুর দুইটায় আরেকটি খবর বাড়ানো হয়। একুশে টেলিভিশনের বিএনপির কর্মসূচি কভারেজের ক্ষেত্রে আড়ষ্টতা ছিলো। দলটির উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের অনুরোধও রক্ষা করা হতো না। ফলে মাঠে আমরা যে রিপোর্টাররা যেতাম, তাদের বিএনপির কর্মীদের ভর্ৎসনার শিকার হতে হতো। নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করতেন মুখে। তবে খুব একটা খারাপ আচরণ করতেন না। তবে কর্মীদের হাতে নয়াপল্টন বা অন্য কর্মসূচিতে একাধিকবার লাঞ্ছনার শিকার আমি নিজেই হয়েছি।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে দেয়া কভারেজে পেশাদারিত্ব ছিলো না। স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব ছিল নির্বাচনভিত্তিক বিভিন্ন আয়োজনে, এমন মনোভাব শুধু বিএনপি সমর্থকদের নয়, একুশের সকল মতের কর্মীদের মাঝেও ছিল। ভোটে বিএনপি জয়ী হয়ে আসার পর মন্ত্রীদের কাছ থেকে কোনো নেতিবাচক আচরণ না পেলেও, বোঝা যেত বিরোধী দলে থাকাকালীন আচরণ তারা ভোলেননি। তবে বিএনপির রাজনীতি ও মন্ত্রীসভার নতুন মুখ, অপেক্ষাকৃত বয়সে তরুণ ছিলেন যারা, তারা কটাক্ষ করতেন। কর্মীরাও করেছেন। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরে যিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন তিনি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কর্মদিবসের শেষ দিনেও কটাক্ষ করেছেন। অফিস কক্ষে অবস্থানরত কর্মীরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। বলে রাখা ভালো নির্বাচনী প্রচারণার সময় এই মন্ত্রীপুত্রের ভর্ৎসনার শিকারও হতে হয়েছিল। অর্থাৎ অসহিষ্ণুতার তখন থেকেই শুরু। সরাসরি একুশে টেলিভিশনকে বয়কট না করলেও, কভারেজের সময় ক্ষমতাসীন দল বিএনপির নেতা-কর্মীরা কখনও কখনও কভারেজে বাধা দিয়েছেন। বের করে দিয়েছেন। কিন্তু একুশে টেলিভিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বর্জন করেননি।
তবে একুশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা গড়ালে বিএনপি বা সরকারকে তুষ্ট করার নানা কৌশল নেয়া হয়। কিন্তু সরকারকে ভোলানো সম্ভব হয়নি। বন্ধ হয়ে যায় একুশে টেলিভিশন। নীতিনির্ধারক ও মালিক পক্ষের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের দায় গিয়ে চাপে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর। চাকরিহারা হতে হয় তাদের। স্মরণে রাখতে হবে একুশে টেলিভিশন বন্ধের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সহকারীর মালিকানায় সম্প্রচারে আসে ‘এনটিভি’। এখানে একুশের প্রায় ৯৮ শতাংশ কর্মীকে নিয়োগ দেয়া হয়। একুশে টেলিভিশনের কুড়ি-একুশজনকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। তাদের বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফ্যাক্স করে জানানো হয়, তারা আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক। ফ্যাক্সে পাঠানো তালিকাটি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়নি। পাঠিয়েছেন সাংবাদিকদেরই একটি পক্ষ। তারা চাননি ঐ কুড়ি-একুশজন এনটিভিতে যোগ দেন।
প্রসঙ্গটির অবতারণা করা হলো এজন্য যে, ২০০২ সালের এই ঘটনাটিকে যদি প্রারম্ভ বলি, তবে দেখতে পাবো কুড়ি বছর পরে এসেও সাংবাদিকরা ‘বিভীষণ’-এর ভূমিকায়। নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে বসে আছে। এখন এই আচরণ গণমাধ্যমকর্মীদের অনেকটা সহজাত হয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি রাজনৈতিক দল, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কাজ অনেকটাই কমিয়ে এনেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। ঠিক পাশে বসা সহকর্মীর বিরুদ্ধে দিস্তা দিস্তা তথ্য বিলি করার কাজটি কাঁধে তুলে নিচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীই। এই কাজ শুরু করেছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা। তাদের এক দুইজনকে তো কাছ থেকেই দেখেছি কীভাবে দপ্তরে দপ্তরে নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরের প্রতিষ্ঠানের কর্মী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে বিলি করছেন। এবং মাঠে কর্মীদের পাঠিয়েও তথ্য সংগ্রহ করার মতো কাজও করতে দেখেছি গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তিদের। তাদের প্ররোচনাতে এই গণমাধ্যমে সদ্য পা রাখা কর্মীরাও এই দোষে দুষ্ট হয়ে উঠেছেন। যখনই কারো সঙ্গে পেশাদারিত্বে পেরে ওঠা যাচ্ছে না, কাজ ও প্রতিভা দিয়ে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না কিংবা একই মতের কেউ যদি স্বার্থ পূরণে দেয়াল হয়ে দাঁড়ান, তখন তাকেও বিপরীত শিবিরের মানুষ বলে আখ্যা দেয়া হচ্ছে। এই কাজটি যে শুধু আওয়ামী লীগ বা বিএনপিপন্থী সাংবাদিকরা করছেন তা নয়। এটা এক প্রকার ফ্যাশন হয়ে উঠেছে। যে ছেলেটি বা মেয়েটি কোনো দিন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, রাজনৈতিক মতাদর্শের কোনো গড়ন তৈরি হয়নি তার মগজে, কিন্তু গণমাধ্যমে প্রবেশ করেই প্রতিষ্ঠান প্রধানের মন ও প্রতিষ্ঠানের আবহাওয়া এবং ব্যক্তিগত প্রাপ্তিযোগের বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে কোনো না কোনো পক্ষে ভিড়ে যান। কেউ কেউ আবহাওয়া বুঝে পক্ষ বদল করে নেন। এই প্রকারের গণমাধ্যমকর্মীদের রাজনৈতিক মনস্কতার ভনিতা পেশাদার সাংবাদিকতার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কোনো রিপোর্টে বা লেখায় সরকারের সমালোচনা করলেই বলা হচ্ছে, ঐ সাংবাদিক সরকার বা রাষ্ট্রবিরোধী। সাংবাদিক ইউনিয়নের মাধ্যমে বিভক্তি তো আগে থেকে তৈরি হয়েই আছে। এখন সেটি ব্যক্তি পর্যায়ে নেমে এসেছে। ফলে বার্তা কক্ষতেও কেউ নিরাপদ বোধ করছেন না। সরকারি, বিরোধী কোনো দলের বিষয়ই খোলাখুলি কথা বলা, রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল আচরণ সকল গণমাধ্যমকর্মীর। কারণ, কে কখন কার কথা রেকর্ড করে বা লেখা ছবি তুলে নিয়ে আগ্রহী ব্যক্তি বা দপ্তরে সরবরাহ করেন! ফলে বার্তাকক্ষে এক সময় সকল মতের যে হৃদয় খোলা আড্ডা, তর্ক-বিতর্ক চলতো, সেটি এখন উধাও প্রায়। সাধারণ কর্পোরেট কর্মীর মতো চাকরিজীবীমাত্র। বার্তাকক্ষ চেনা পরিবেশ, স্বাভাবিক আবহাওয়া হারিয়ে ফেলায় কর্মীদের দীর্ঘশ্বাস বাড়ছে। এভাবেই কাজের জায়গাটির বাতাস তপ্ত হয়ে ওঠে। গণমাধ্যমকর্মীদের ক্ষোভের প্রকাশ, কিছু কিছু সরাসরি ভাবে বা কৌশলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে আসে। এতে সাময়িকভাবে হয়তো ক্ষোভের মেঘ হালকা হয় কিন্তু প্রশান্তির বাদল ঝরে না। নিজের সঙ্গে, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মনস্তাত্বিক লড়াই করে টিকতে না পেরে, অভিমানে কেউ কেউ প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যায়। মিডিয়া এবং দেশ ছেড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।
গণমাধ্যমকর্মীদের শুধু খবরের পেছনে ছোটা, খবরের গভীরে পৌঁছানোর জন্য মেধা বা মনোযোগে বিনিয়োগ করলে হচ্ছে না, তাকে বার্তাকক্ষ এবং গণমাধ্যমের রাজনীতি নিয়েও সতর্ক থাকতে হচ্ছে। সেই রাজনীতি সামাল দিতে গিয়ে হচ্ছে মেধার অপচয়। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো আগেও তাদের কর্মীদের পরোক্ষ এবং কিছুটা প্রত্যক্ষভাবে বিজ্ঞাপন জোগাড়ের জন্য ব্যবহার করেছে। রিপোর্ট বা প্রতিবেদন তৈরি করে বিজ্ঞাপনের আবদার রাখা গণমাধ্যমের এক প্রকার বিনীত চরিত্র ছিল। দেয়া-নেয়ার এই রীতিতে গণমাধ্যমকর্মী ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ ছিল। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিকরা তো আগে থেকেই সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপন সংগ্রহের বিনিময়ে কমিশন পেতেন। এ বিষয়গুলো ছিল বোঝাপড়ার মাধ্যমে অলিখিত। সাম্প্রতিক সময়ে আর অনানুষ্ঠানিকতা রক্ষা করা হচ্ছে না। প্রত্যক্ষভাবে তাদের প্ররোচিত বা তাগিদ দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না গণমাধ্যমগুলো, এক প্রকার বাধ্যই করা হচ্ছে।
সাংবাদিকদের এখন উপায় কী? খবরের টার্গেট নাকি বিজ্ঞাপনের টার্গেটের দিকে ছুটবেন? ছুট দিতে হয় বিজ্ঞাপনের টার্গেট মেটাতেই। কারণ বিজ্ঞাপনের তৃষ্ণা মিটলে তার বেতন হবার সম্ভাবনা আছে। খবরের পাতা বা পোর্টাল ভরিয়ে দিলেও বেতনের দাবিটি করার মুরোদ বা সাহস হবে না। বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দিয়েও অবশ্য নিস্তার নেই। বিজ্ঞাপনের বিল আদায় করে দেওয়ার তাড়ায় থাকতে হয়। এই চাপ তো গণমাধ্যমকর্মী, সাংবাদিকের কাঁধে ওঠার কথা ছিলো না? কিন্তু উঠেছে গত প্রায় ৩৫ বছরে, ধীরে ধীরে। এজন্য প্রথমত গত শতকের নব্বই দশকের গণমাধ্যম বিস্ফোরণ দায়ী, পরবর্তীতে ওয়েব পোর্টাল ও বেতার-টেলিভিশনের বাজার জরিপ ছাড়া আত্মপ্রকাশ দায়ী। এখন নয়, সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই খবর নয়, সরকার নয়, গণমাধ্যমের কাছে প্রভু হয়ে উঠেছে বিজ্ঞাপন। এই প্রভুকে নিজেদের ঘরে নিয়ে আসার কাজটি বিপণন বিভাগ একা যখন করে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন প্রথমে তাদের সহযোগী হিসেবে রিপোর্টারদের যুক্ত করে দেওয়া হয়। পরে সরাসরি রিপোর্টারের হাতেই গুঁজে দেয়া হয় বিজ্ঞাপনের দরের তালিকাটি। সুতরাং গণমাধ্যমকর্মীর মগজে খবরের পথচিত্রের বদলে বিজ্ঞাপনের ফন্দিপথ রেখাটি এখন প্রভাব বিস্তার করছে।
লেখক: সম্পাদকীয় প্রধান, এখন টেলিভিশন
তারা//