ঢাকা     সোমবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৮ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বন্ধুর বই পড়ে প্রস্তুতি, প্রথমবারেই বিজেএসসি জয়

আবু নাঈম, পঞ্চগড় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:১৫, ১০ অক্টোবর ২০২৩   আপডেট: ১৯:১৬, ১০ অক্টোবর ২০২৩
বন্ধুর বই পড়ে প্রস্তুতি, প্রথমবারেই বিজেএসসি জয়

সহকারী জজ পদে সুপারিশপ্রাপ্ত আসাদুজ্জামান নুর

হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে আসাদুজ্জামান নুর। আর্থিক সঙ্কট ছিলো যার মাথার বোঝা। সামর্থ্য ছিল না বই কেনারও। তবে কোনো প্রতিকূলতা দমাতে পারেনি তাকে। সদ্য প্রকাশ হওয়া ১৬তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) নিয়োগ পরীক্ষায় সহকারী জজ পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন পঞ্চগড়ের এই ছেলে। সারাদেশে উত্তীর্ণ ১০৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে তার মেধাক্রম ৪০তম। 

পঞ্চগড় সদর উপজেলার ব্যারিস্টার বাজার এলাকার মৃত নুর বাদশার ছেলে আসাদুজ্জামান নুর। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৭-১৮ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। বর্তমান একই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ছেন। তিনি ২০১৪ সালে পঞ্চগড় বিপি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি এবং ২০১৬ সালে পঞ্চগড় এমআর সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ- ৪ দশমিক ৩৩ পেয়ে এইচএসসি পাশ করেন। সে বছর কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না হওয়ায় একই কলেজে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তির সুযোগ হাত ছাড়া করেননি।

আরো পড়ুন:

২০১২ সালে নবম শ্রণিতে পড়াকালীন বাবাকে হারান আসাদুজ্জামান নুর। বিপর্যয় নেমে আসে পরিবারে। সহায় সম্বল বলতে ৬ শতকের ভিটেমাটি। জড়িয়ে পড়েন জীবনযুদ্ধে। তবে হাল ছাড়েননি, মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম আর প্রচেষ্টায় এ পর্যন্ত আসা তার। পেশাগত জীবনে একজন ন্যায় বিচারক হয়ে নিপীড়িত মানুষের সহায়ক হতে চান তিনি।

আসাদুজ্জামান নুর বলেন, ‌‘জীবনে সবচেয়ে বেশি মুখোমুখি হয়েছি অর্থনৈতিক অনটনের। সবচেয়ে বেশি পরিবারের সমস্যা উপলব্ধি করেছি করোনাকালীন লম্বা ছুটিতে। সেসময় মানুষের দোকানে কর্মচারী হিসেবেও কাজ করেছি। করোনা পরবর্তী সময়ে আবারও অনিশ্চয়তায় পড়ে যাই। অনেক নিকটজনের কাছে হাত পেতেছি। কাছের অনেকেই ভালোভাবে সাড়া দেননি। কেউ আশ্বাস দিয়েছেন, কেউ হতাশ করেছেন। তবে এক পর্যায়ে অনেক প্রিয়জনের সহযোগিতা পেয়েছি। তাদের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। সব থেকে বেশি কৃতজ্ঞ থাকবো আমার মায়ের কাছে। ছোট থেকেই আমার প্রতিটা সিদ্ধান্তে তিনি সব সময়ই আমার পাশে ছিলেন, সাহস যুগিয়েছেন। আমার আজকে যা অর্জন তার পুরোটাই আমার মায়ের অর্জন বলে আমি মনে করি।’

তিনি আরও বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুই বছর ‘সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট’ এর সহযোগিতায় পার করেছি। করোনার পরে এসে যখন আর্থিক অবস্থাটা নিয়ে দিশেহারা হয়ে পরেছিলাম ঠিক সেই মুহূর্তে খোঁজ পেয়েছিলাম ‘পে ইট ফরওয়ার্ড বাংলাদেশ’ গ্রুপের। আমি অনেক অনেক বেশি কৃতজ্ঞ থাকবো এই সংস্থাটির কাছে। তারা আমাকে আমার লক্ষে পৌঁছাতে আমার মাথায় বোঝাস্বরূপ চেপে বসা আর্থিক দিকটা নিরসনের মাধ্যমে চূড়ান্ত সহযোগীতা করেছে। যার ফল আমি পড়াশুনায় মনোনিবেশ করতে পেরেছিলাম। পরবর্তীতে আমার বন্ধু হোসনে মোবারক সাগর এবং মোহাম্মদ নাজ্জাসির বই নিয়ে আমি পড়াশোনা শুরু করি। বিজেএসসির প্রিলি হতে লিখিত পুরোটা সময় আমি তাদের বই পড়েছি। বিষয়টি আমার বন্ধু-সহপাঠী ও কাছের মানুষজন জানে। জুডিশিয়ারির দিক নির্দেশনায় আমি সব থেকে বেশি সহায়তা পেয়েছি সাকিব আহমেদ ইমন ভাইয়ের কাছ থেকে। যিনি ১৫তম বিজেএসসি পরীক্ষায় সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশ প্রাপ্ত। এছাড়া ডিপার্টমেন্টের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরাও সব ধরনের সহযোগীতা করেছেন এবং সর্বদাই অনুপ্রাণিত করেছেন।”

আইন পেশায় যাদের স্বপ্ন তাদের উদ্দেশ্যে আসাদুজ্জামান নুর বলেন, ‘আমার একাডেমিক রেজাল্ট খুব ভালো ছিল না। আমি জুডিশিয়ারি এবং অ্যাডভোকেসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে বেশি ভাবতাম। অনেকেই পড়ালেখা শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নেয়, এটা আমার দৃষ্টিকোণ থেকে একটু কঠিন মনে হয়। কারণ, একাডেমিক পাঠ শেষ হলে মাথায় অর্থনৈতিক চাপ শুরু হয়। তখন চাকরির প্রস্তুতি সেভাবে নেওয়া যায় না। যারা আইন পেশায় স্বপ্ন দেখছেন তাদের প্রতি আমার পরামর্শ- অনার্সের শুরু থেকেই প্রস্তুতি শুরু করবেন। প্রচুর অধ্যয়নেও মনযোগী হতে হবে।’

আগে থেকেই কি বিচারক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে দৃঢ়ভাবে বিচারক হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। তবে একটা সময় স্বপ্ন দেখতে শুরু করি, সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিতে থাকি। আমি ন্যায় বিচারক হতে চাই, নিপীড়িত মানুষের সহায়ক হতে চাই। ন্যায় বিচারকের সম্মান দুনিয়া এবং আখিরাতেও। আল্লাহ যেই সাত শ্রেণির মানুষকে তার আরশের ছায়ায় আশ্রয় দিবেন, তাদের মধ্যে প্রথম হলো ন্যায় বিচারক। মহান আল্লাহ আমাকে যে দায়িত্বে মনোনীত করেছেন। দায়িত্ব যেন আমি সঠিকভাবে পালন করতে পারি সেজন্য সবার কাছে দোয়াপ্রার্থী। আমাকে দিয়ে যেন অন্যায়ভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য আমি আমার আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই।’

এত বড় সাফল্যেও একটা দুঃখ বারবার মনে নাড়া দিচ্ছে উল্লেখ করে আসাদুজ্জামান নুর বলেন, ‘আজ আমার এই অর্জনে যে মানুষটা সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন, যে মানুষটা গর্ব করে বলতেন আমার ছেলে বিচারক হিসেবে মনোনীত হয়েছে, সেই মানুষটাই নেই। এটাই আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ। বারবার মনে নাড়া দিচ্ছে। আপনাদের সবার কাছে আমার বাবার জন্য দোয়া চাই। আল্লাহ যেন আমার বাবাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন।’

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়