ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কোয়াড ইস্যুতে বাংলাদেশকে ঘিরে আলোচনা তুঙ্গে

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:২৮, ১৪ মে ২০২১   আপডেট: ১৯:৫৬, ১৪ মে ২০২১
কোয়াড ইস্যুতে বাংলাদেশকে ঘিরে আলোচনা তুঙ্গে

যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের পতাকা

যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের জোট ‘কোয়াড’-এ বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার বিষয়ে চীনের প্রচ্ছন্ন হুমকি এবং এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে ঘিরে গত কয়েক দিন ধরে আলোচনা জমে উঠেছে। বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক অবস্থানের দিকে তাকিয়ে আছে জোটে থাকা চার দেশের পাশাপাশি চীনও। তবে, বাংলাদেশ শুরু থেকেই এ বিষয়ে কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে।

গত মাসে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঢাকা সফরে এসে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে প্রথমে এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। এরপর গত সপ্তাহে দেশটির রাষ্ট্রদূতের আক্রমণাত্মক মন্তব্যের পর মূলত কোয়াড ইস্যু নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে ওঠে। চীনের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের পর এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র নজর রেখেছিল বলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে দেশটি। এরই মধ্যে বাংলাদেশের সমর্থনে মন্তব্যও করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে নৌ চলাচল ‘অবাধ ও স্বাধীন’ রাখার উপায় খোঁজার যুক্তি দেখিয়ে ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যে ‘কোয়াড’ (কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ) এর সূচনা হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত মাসেই কোয়াড ইস্যুতে চীন তাদের উদ্বেগের কথা বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন অব্যাহত রাখার স্বার্থে বাইরের শক্তির এমন ‘সামরিক জোটের’ বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে পাশে পেতে চায় তারা। তবে, চীনের প্রস্তাবে বাংলাদেশ এখনো কোনো মতামত জানায়নি। এরপর চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গহি ঢাকা সফরের সময় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে কোয়াড নিয়ে বেইজিংয়ের অস্বস্তির কথা জানান। সেই সঙ্গে এ অঞ্চলে কোয়াড যাতে আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে, সেজন্য দুই দেশের একসঙ্গে কাজ করার বিষয়েও বেইজিংয়ের প্রত্যাশা তুলে ধরেন।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।

২৭ এপ্রিল রাতে চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া ‘বাংলাদেশ, চীন সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, 'দক্ষিণ এশিয়ায় বাইরের কোনো শক্তির সামরিক জোট গঠনের চেষ্টা এবং আধিপত্য বিস্তার রুখতে এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে দুই পক্ষের যৌথ প্রয়াস চালানো উচিত।'

তবে বিষয়টি প্রকাশ্য আলোচনায় আসে সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং-এর একটি মন্তব্যের পর। ‘কোয়াডে যোগ দিলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে’ বলে তিনি বাংলাদেশকে সতর্ক করেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের সরাসরি জবাব না দিলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন চীনের উপহারের ৫ লাখ টিকা গ্রহণের দিন বলেছিলেন, ‘কোয়াড নিয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলেছে চীন।’ মন্ত্রী এ সময় বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেন, ‘কোয়াড নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এছাড়া, বাংলাদেশ স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ হিসেবে সিদ্ধান্ত নেবে।’

মন্ত্রী আরও বলেন, ‘এমনিতে চীন কখনো অন্যের বিষয়ে নাক গলায় না। আর এ রকম অ্যাগ্রেসিভ কখনো কাউকে বলতে শুনিনি। এটা খুবই দুঃখজনক। চীনের কাছ থেকে আমরা এ ব্যবহার আশা করিনি।’

মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর চীনের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের কাছে নিজের বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন বলে মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে।

কিন্তু এর মধ্যে আলোচনার পালে হাওয়া লাগে, যখন  চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সমর্থন করে। বুধবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনইং এক নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তবে চীন মনে করে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে চীনের বিরুদ্ধে উসকে দেওয়ার জোট হিসেবেই চীনবিরোধীরা কোয়াড তৈরি করছে।’ চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও এটি বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে হুয়া চুনইং বলেন, ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, চীন ও বাংলাদেশ খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও প্রতিবেশী। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাঁচটি মূল নীতির উপর ভিত্তি করে আমাদের সম্পর্ক তৈরি করেছি। আমরা একে অন্যকে সব সময় সম্মানের দৃষ্টিতে দেখি এবং মৌলিক স্বার্থ এবং উদ্বেগের মূল বিষয়গুলোতে পরস্পরকে সহযোগিতা করি।’

চীনা মুখপাত্র বলেন, ‘কোয়াড কোন ধরনের জোট, সেটি আমরা সবাই জানি। নির্দিষ্ট কিছু দেশ এ ধরনের ছোট ছোট বাবল তৈরি করে চীনকে আটকানোর যে পাঁয়তারা করে, চ্যালেঞ্জ জানায়, প্রতিবেশীদের উসকে দিয়ে গোল বাধানোর চেষ্টা চালায়, চীন নিশ্চয়ই তার বিরোধিতা করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কোয়াডে বাংলাদেশের যোগ না দেওয়ার প্রশ্নে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা হুমকি হিসেবে দেখছে না বেইজিং। কারণ, বেইজিং মনে করে, ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাংলাদেশ ও চীন সব সময় একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’

চীনা রাষ্ট্রদূতের ওই মন্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য লক্ষ করেছি। আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। একই সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারের বিষয়েও আমরা শ্রদ্ধাশীল।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত শক্তিশালী সম্পর্ক আছে। আমাদের অংশীদারদের সঙ্গে আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে জলবায়ু পরিবর্তন, মানবিক ইস্যুসহ বিস্তৃত পরিসরে নিবিড়ভাবে কাজ করি।’

কোয়াডের প্রসঙ্গ টেনে আমেরিকান পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা আগেও বলেছি, কোয়াড হচ্ছে একটি অনানুষ্ঠানিক ও জরুরি বহুপক্ষীয় উদ্যোগ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো সমমনা গণতান্ত্রিক দেশগুলো ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে সমন্বিতভাবে কাজ করে। যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে অবাধ ও মুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা।’

প্রসঙ্গত, সোমবার এক অনুষ্ঠানে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছিলেন, ‘চীন মনে করে, কোয়াড গ্রুপটি চীনবিরোধী। আমি এটা পরিষ্কার করে বলতে চাই, কোয়াড নিজেকে অর্থনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত বলে দাবি করলেও তা সত্য নয়। এটা একটি সামরিক জোট এবং মূলত এটা করা হয়েছে চীনের বিরোধিতার জন্য।'

তিনি বাংলাদেশকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘এই চার সদস্যের ক্লাবে যোগ দেওয়াটা বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে না। কারণ, এর ফলে চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুক্রবার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমাদের কূটনৈতিক লক্ষ্য সব সময়ই ইতিবাচক এবং পরিষ্কার। কোয়াড নিয়ে সরকারের নিজস্ব পরিকল্পনা আছে। আমরা আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে সিদ্ধান্ত নেব।’

ঢাকা/হাসান/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়