ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উপকূলে বেড়েছে জীবনের সংকট

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১৯, ২২ মে ২০২১   আপডেট: ১৫:৪১, ২২ মে ২০২১
উপকূলে বেড়েছে জীবনের সংকট

একটি রাস্তা ভেঙে তিন টুকরো হয়েছে। যাতায়াতে এখন ভরসা নৌকা

এ যেন এক অন্য বাংলাদেশ! অচেনা এক গ্রাম। কোথাও সবুজ নেই। পোড়া গাছপালা। বিধ্বস্ত বাড়িঘর। পুকুর, ডোবা, ফসলি মাঠ, শখের বাগান- সব পানির নিচে! রাস্তাঘাট ছিন্নভিন্ন। ধ্বসে যাওয়া বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে জোয়ারের পানি বাধাহীন প্রবেশ করছে গ্রামে। বেড়িবাঁধ, সড়কে যতটুকু উঁচু জায়গা আছে, সব মানুষের দখলে। বাড়িঘর বানিয়ে থাকছেন তারা। কারণ মাথা গোজার অন্য কোনো ঠাঁই নেই।

কপোতাক্ষ নদের তীরে টিকে থাকা বেড়িবাঁধের দিকে তাকালে চোখে পড়ে সারিবদ্ধ ঘর। এক একটি গ্রাম ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এলাকায় কাজ নেই। আয় রোজগারের নেই কোনো পথ। ফলে তিনবেলা খাদ্য সংগ্রহ এক একটি পরিবারের জন্য এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা।

চলতি বছরের শুরুর দিকে কোভিড-এর প্রভাব নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন-জীবিকায় বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। লকডাউনের কারণে কর্মহীন বহু মানুষ। বাইরে কর্মরত মানুষগুলো লকডাউনের কারণে এলাকায় ফিরে এসেছিলেন। এরই মধ্যে আঘাত করে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। এদের জীবনযাপন দ্বিমুখী চাপে পড়ে।

গ্রামের মাটি ধুয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে। এখন বেড়িবাঁধেই কাটে বারো মাস 

উপরের হৃদয়ছোঁয়া বাক্যগুলো বলে দেয় বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলের আম্ফান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষগুলো  কেমন আছেন। ২০২০ সালের ২০ মে আম্ফান এই এলাকায় আঘাত করেছিল। কিন্তু এক বছরেও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেননি বহু মানুষ। তারা সম্পদ হারিয়েছেন। ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। আয় রোজগারের সব পথ বন্ধ। কৃষক বছরের দুটি ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। লোকসান দিয়েছেন চিংড়ি চাষিরা। জোয়ারের পানি আটকানো সম্ভব হলেও বহু এলাকা এখনও পানির তলায়।

আম্ফানে বড় ক্ষতি হলেও সহযোগিতার পরিমাণ খুব কম। স্থানীয়রা বলছেন, রিলিফ যা এসেছে, তাতে সর্বোচ্চ একমাসের খাবার হয়েছে। বাকি পাঁচ মাস অনেক কষ্টে অতিবাহিত হয়েছে। ধারদেনা করে দিন পার করছেন অনেকেই। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? উপকূলে দীর্ঘমেয়াদে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কী প্রভাব পড়ছে? তার খোঁজখবর সরকারের উপর মহলে কি পৌঁছাচ্ছে?

ঋণের টাকায় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা

আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সাধারণ চিকিৎসার কথা প্রায় ভুলেই গেছেন। জীবন ধারণের জন্যই তাদের সব অর্থ এবং শ্রম ব্যয় করতে হচ্ছে। কিন্তু জরুরি স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনে তাদের চিকিৎসকের কাছে যেতেই হয়। এজন্য নিতে হয় ঋণ। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক জার্নাল হিলিয়নে প্রকাশিত ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ইমপ্যাক্টস অ্যান্ড অ্যাডাপ্টেশনস অন হেলথ অব ইন্টারনালি ডিসপ্লেজড পিপল (আইডিপি): অ্যান এক্সপ্লোরেটরি স্টাডি অন কোস্টাল এরিয়াস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে বিষয়টি উঠে এসেছে।

গবেষণায় বলা হয়, গত ১০ বছরে নদীভাঙনের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ, জীবনযাত্রার মান হারিয়ে ১৯ শতাংশ, কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংসের কারণে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং বিশুদ্ধ পানির অভাবে ২ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। স্থানান্তরিত হওয়ার পর নতুন পরিবেশে বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়েছে ৭৮ শতাংশ পরিবার। নতুন পরিবেশে গিয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছেন। মূলত পানিবাহিত এবং রক্তচোষা কীটবাহিত বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ আগের তুলনায় বেশি হচ্ছে। ডায়রিয়া, কলেরা, জন্ডিস, পাতলা পায়খানা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের হার বেড়েছে।

গবেষণায় আরো দেখা গেছে, বাস্তুচ্যুত মানুষ চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। অর্থের স্বল্পতার কারণে ৯৩ শতাংশ, স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতায় ৯১ শতাংশ, যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসকের অভাবে ৮৮ শতাংশ, দুর্বল সামাজিক ব্যবস্থার কারণে ৭৭ শতাংশ, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে ৩৩ শতাংশ, লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে ২৬ শতাংশ এবং ধর্মীয় চর্চার ভিন্নতার কারণে ১৭ শতাংশ মানুষ স্বাভাবিক সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন।

পানি সরে যাওয়ার পরে ঘরে বসবাস শুরু করেছেন। তবে বিধ্বস্ত ঘর সংস্কারে প্রয়োজন অর্থ

গবেষণাটির চার গবেষকের মধ্যে অন্যতম যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক মো. আরিফ চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। আপদকাল মোকাবিলার জন্য তাদের সঞ্চয় করার মতো উপার্জন নেই। কাছাকাছি সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বলতে ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা তারা পান না। এসব কারণে তারা ঋণ নিয়ে উপজেলা-জেলা বা বিভাগীয় শহরে এসে চিকিৎসকের ফি দেন, রোগী নিরীক্ষণ এবং ওষুধ ক্রয়ে খরচ করেন। অনেক সময় সচেতনতার কারণে তারা ওষুধ গ্রহণেও অবহেলা করেন। ফলে তাদের খরচ আরো বেড়ে যায়। এই ব্যয় মেটাতে তাদের ঋণ নিতে হয়।

সংকটের ডালপালা

আম্ফান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মানুষের বহুমূখী সংকট অনেক আগে থেকেই। সংকটগুলো ডালপালা বিস্তার করেছে। যেমন:

পরিবেশ বিপর্যয়: এলাকার মানুষের কাছে পরিবেশ বিপর্যয়ের দৃশ্যগুলো খুবই সহনশীল হয়ে গেছে। কেননা তারা দীর্ঘ সময় ধরে এই সমস্যার মধ্যে আছেন। কিন্তু বাইরে থেকে যে কেউ এলে অবাক হবেন! যেদিকে ক্যামেরা ঘোরাবেন, সবদিকেই পাবেন খবরের ফটোফ্রেম। এলাকার গাছপালাগুলোও যেন কাঁদছে। সেই কান্না কেউ শুনছে না। সবুজ নেই কোথাও। অনেক জায়গায় আগামরা গাছগুলো পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। এ যেন মৃত্যুর প্রতীক্ষা।  

আবাসন সংকট: পশ্চিম উপকূলের অনেক স্থানে আবাসন সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। নদী ভাঙন বেড়ে যাওয়ায় অনেকের বাড়ি নতুন করে ভাঙনের মুখে পড়েছে। কেউ কেউ ঘরের মধ্যে উঁচু পাটাতন দিয়ে বসবাস করছেন। অনেকে চলে গেছেন আত্মীয় স্বজনের বাড়ি অথবা নিরাপদ আশ্রয়ে। বেড়িবাঁধ কিংবা রাস্তার উপরে তৈরি হচ্ছে থাকার ঘর। 

বাস্তুচ্যুত মানুষ: বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। কিছু মানুষ এলাকা ছেড়েছেন স্থায়ীভাবে; কিছু মানুষ ছেড়েছেন অস্থায়ীভাবে। প্রধানত বসবাস এবং আয় রোজগারের ব্যবস্থা না থাকায় মানুষগুলো এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।        

কর্মসংস্থানের অভাব: এলাকায় কর্মসংস্থানের অভাব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আম্ফান আঘাতের সময় এলাকায় ছিল ইরি ধান। সেই ধান আম্ফানে ভেসে গেছে। ফসলি জমি পানিতে ডুবে থাকায় অনেক স্থানে গত মৌসুমে আমন ধানের আবাদ হয়নি। এ বছরও অনেক স্থানে আমন আবাদ হবে না। অনেক স্থানের চিংড়ির খামারগুলো এখনও পানির তলায়। রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় সেখানে রিকশা, ভ্যান, মোটরবাইক চলছে না। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বহু মানুষ কাজের সন্ধানে শহরের দিকে ছুটছে। 

মরা গ্রাম, মরা প্রকৃতি। খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি গ্রাম থেকে তোলা ছবি

পানি সংকট: এলাকায় সুপেয় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। অধিকাংশ গভীর নলকূপ পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ আগে এলাকায় সুপেয় পানির সংকট ছিল না। এখন পানি সংগ্রহ করতে হয় অনেক দূর থেকে। শুধু সুপেয় পানি নয়, গোসলসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত পানির অভাবও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। 

বিপর্যস্ত রাস্তাঘাট: সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। অনেক স্থানে রাস্তাঘাটই নেই। পিচঢালা রাস্তা ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে। ব্রিক সোলিং রাস্তার ইট ভেসে গেছে জোয়ারের পানিতে। গোটা এলাকা যেন দুর্গম গ্রামে পরিণত হয়েছে। রাস্তাঘাটের অভাবে দেখা দিয়েছে আরও নতুন নতুন সমস্যা। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার জন্য ডুবে থাকা রাস্তার উপরে তৈরি হয়েছে বাঁশের সাঁকো।  

দুর্বল বেড়িবাঁধ: ঘূর্ণিঝড় আম্ফান দেখিয়ে দিয়ে গেছে, একমাত্র দুর্বল বেড়িবাঁধের কারণেই এই এলাকায় মারাত্মক সংকট তৈরি হয়েছে। এলাকাবাসীর দাবি সত্ত্বেও বেড়িবাঁধ শক্ত করা হয়নি। এই এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল ষাটের দশকে। এরপর শুধু বাঁধের সংস্কার কাজ হয়েছে। ফলে বেড়েবাঁধ ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েছে।

আরও পড়ুন :
*মহামারিতে ঘূর্ণিঝড়: মরার উপর খাঁড়ার ঘা
*এখনও স্পষ্ট ধ্বংসের চিহ্ন

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়