ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

দুর্বল আইন ক‌ঠোর শা‌স্তির অন্তরায়

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০৯, ৭ জুন ২০২২  
দুর্বল আইন ক‌ঠোর শা‌স্তির অন্তরায়

ছবি: সংগৃহীত

বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, মজুতদার ব্যবসায়ী এবং অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। এসব নিয়ন্ত্রণে এবং জনগণের কষ্ট লাঘবে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা প্রতিদিনই অভিযান পরিচালনা করছে। দাম বৃদ্ধি, অতিরিক্ত চাল-তেল মজুত করার অভিযোগে বিভিন্ন ব্যবসায়ী-প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার পাশাপাশি তাদের গুদাম সিলগালা করা হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে প্রচলিত আইনের সাজাও।

কিন্তু এতকিছুর পরও বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যার কারণে সীমিত আয় দিয়ে অল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবন চালানোই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। সর্বত্রই নিত্যপণ্য নিয়ে একটা নৈরাজ্য চলছে। চাল, তেল, পেঁয়াজ, চিনি, ডালসহ প্রায় সব পণ্যের দামই চড়া। একটা কোনওভাবে সামাল দেওয়া গেলেও অন্যটার দাম বাড়ায় ব্যবসায়ীরা। খুচরা ব্যবসায়ীরা দোষ দেয় পাইকারদের। আর পাইকাররা খুচরা ব্যবসায়ীদের।

তবে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান চালের বাজারের কারসাজি রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হলেও তাদের বড় ধরনের কোনও সাজা দেওয়া যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে এদের বিচার করা যায়। সেক্ষেত্রে কঠোর সাজার বিধান রয়েছে। তা প্রয়োগ করলে অবশ্যই মজুতদাররা সতর্ক হবে। 

তাহলে সেই আইন প্রয়োগ করে সাজা দেওয়া হচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(১)-এ ধারায় বলা হয়েছে, মজুতদারি অথবা কালোবাজারের কারবারের অপরাধে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১৪ বছর পর্যন্ত যেকোনও মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তাকে জরিমানাও করা যাবে।

কিন্তু ২০০৯ সালের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে কোনও পণ্য গুদামজাত করার অপরাধে কারখানা, দোকান, গুদাম সাময়িক বন্ধ করার; পণ্য যথাযথভাবে বিক্রি ও সরবরাহ না করলে সর্বোচ্চ এক বছরের শাস্তি ও জরিমানার বিধান রয়েছে। এ আইনে মজুতদার ও কালোবাজারি বিষয়ে কিছুই বলা নেই। এরকম দুর্বল আইন দিয়ে কখনও শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে না বলেই মনে করেন এই আইনজীবী।

তিনি বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এসব অসৎ ও মজুতদার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাতে কোনও সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। এটি শুধু ভুক্তভোগী জনগণকে দেখানোর জন্য মজুতদারির বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিচ্ছে। মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যদের অনেকেই ব্যবসায়ী বা তাদের আত্মীয়স্বজন। তাই তারা তো ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না। যে আইনে তাদের জরিমানা করা হচ্ছে, এ আইনের সর্বোচ্চ শাস্তিও তো দেওয়া হচ্ছে না। কারণ এ আইনে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া যায়। ব্যবসায়ীরা দেখছে যে, মজুতদারি করে যা মুনাফা করবে, ধরা পড়লে তার থেকে সামান্য কিছু জরিমানা বাবদ দিলেই মজুতদারি অব্যাহত রাখা যায়।

আরেকটি বড় ধরণের সমস্যা হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা। ড্রাইভারদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ফিটনেসহীন গাড়ি রাস্তায় চলা, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালানো, মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচলসহ বিবিধ কারণে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে কয়েক গুণ। প্রতিদিন শত শত মানুষ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন এবং পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। এসব দুর্ঘটনা রোধে সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপের মুখে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেয় সরকার। সেই উদ্যোগটিও গত ৪ বছর ধরে সংশোধনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় সড়কে প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলছে।

অপরদিকে, স্বাস্থ্যখাতে সারাদেশে গজিয়ে ওঠা অসংখ্য অবৈধ ও নিম্নমানের ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক-হাসপাতালের ব্যাপারে জিরো টলারেন্সে গিয়েছ সরকার। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে সারাদেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়ে গত কয়েকদিনে অন্তত ১২০০ অবৈধ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করা হয়েছে। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রোধে দেশে বর্তমানে কোনও আইন নেই। ৪০ বছরের পুরোনো একটি অর্ডিন্যান্সের আওতায় হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানের তদারকি চলছে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সরকারি স্বাস্থ্যখাতের বিপুল সংখ্যক প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দেশে উপযুক্ত কোনও আইন নেই। বেসরকারি চিকিৎসাসেবা আইন প্রণয়নে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও নীতিনির্ধারকদের অনেকের স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় আইনের খসড়াটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দি হয়ে আছে। ৪০ বছরের পুরোনো ‘দ্য মেডিক‌্যাল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস (রেগুলেশনস) অর্ডিন্যান্স ১৯৮২’-এর আওতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার স্বল্পসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনদের দিয়ে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানের তদারকি করা হচ্ছে। ফলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলেও মনে করেন এই কর্মকর্তা।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল আজিজ বলেন, স্বাস্থ্যসেবা আইনটি এতদিনেও না হওয়াটা দুঃখজনক। এটার প্রধান কারণ আসলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এই আইনটি বাস্তবায়িত হলে স্বাস্থ্যসেবার মান আরও বৃদ্ধি পাবে। এ আইনে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার একটি নীতিমালা থাকবে। রোগীরা হয়রানির শিকার হলে আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। আবার চিকিৎসকরা যদি কোনও কারণে মনে করেন, তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়নি- তারাও আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। এটা একটা ভালো আইন। আমরা চাই আইনটি দ্রুত পাশ করে কার্যকর করা হোক।

ঢাকা/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়