ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

প্রান্তিক পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের মজুত কম, ভোগান্তি

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ৮ মার্চ ২০২৩  
প্রান্তিক পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের মজুত কম, ভোগান্তি

ছবি: ইন্টারনেট

বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। উচ্চ রক্তচাপের এই প্রকোপ মোকাবিলায় বিগত কয়েক বছর ধরে দেশে চলমান রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি। যার আওতায় সেবা গ্রহণ করার মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সফল হয়েছেন প্রায় ৫২ শতাংশেরও বেশি রোগী। তবে রোগীর সংখ্যার তুলনায় ওষুধের মজুত কম হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়ছেন রোগীরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনসিডিসি) ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে যৌথভাবে উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয়, বিনামূল্যে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ প্রদান, চিকিৎসা ও ফলো-আপ সেবা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সিলেট, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের ৫৪টি উপজেলায় কাজ করছে। এই কাজে সহায়তা প্রদান করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা রিজলভ টু সেইভ লাইভস (আরটিএসএল)।

উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এই কর্মসূচি। তবে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে প্রায়ই ওষুধের মজুত দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক রোগীকেই উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে এসে ওষুধ ছাড়াই ফিরে যেতে হচ্ছে।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সাথে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ উৎপাদন, ক্রয় এবং উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সগুলোতে ওষুধ পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দেরি হওয়ার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিনামূল্যে প্রদানের জন্য উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সগুলোতে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে এই কর্মসূচির মাধ্যমে উপকৃত হবে প্রান্তিক পর্যায়ের আরও অনেক মানুষ। ওষুধের এই নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন এ খাতে সরকারের বাজেট বৃদ্ধি।

এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ-এর হাইপারটেনশন কন্ট্রোল প্রোগ্রামের ম্যানেজার ডা. শামীম জুবায়ের রাইজিংবিডিকে বলেন, বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এনসিডি কর্নার (নন কন্টামিনেটেড ডিজিজ কর্নার) থেকে উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ওষুধ প্রদান করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট উপজেলার লাখ খানেক লোক নিয়মিত ওষুধ পাচ্ছে, এবং নিয়মিত ওষুধ সেবনের ফলে তাদের শারিরীক অবস্থাও ভালো ছিলো। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে ওষুধ পাওয়ার বিষয়ে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মাঝে মাঝে ওষুধ পৌঁছাতে ২ থেকে আড়াই মাস লেগে যায়। ফলে নিয়মিত ওধুষ গ্রহণ বাধা হচ্ছে।

তিনি বলেন, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ঠ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই প্রোগ্রামটি ৬ বছর ধরে চলছে। কর্মসূচির আওতায় যেহেতু ওষুধটি ফ্রি পাওয়া যায়, তাই চাহিদাও বেড়ে গেছে। কিন্তু দীর্ঘসময় যদি ওষুধ না পাওয়া যায়, যারা একেবারেই কিনে খেতে পারেন না, তাদের বড় ধরনের ক্ষতি এবং মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকে।

তিনি আরও বলেন, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই কর্মসূচির সেবাগ্রহীতা। তাদের সেবা নিতে উপজেলা সদরে আসতে হয়। এতে অনেক সময় ভোগান্তিতে পড়েন তারা। তাই এই সেবা যদি কমউিনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেওয়া হয়, তাহলে সেবাগ্রহীতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ওষুধ সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাকির হোসেন জানান, তারা চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ওষুধ সরবরাহের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করা হবে।

বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে পলিসি অ্যাডভোকেসির ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করছে আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর। গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের কান্ট্রি লিড মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস রাইজিংবিডিকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে নানা রোগে যেসব মৃত্যু হয়, এর ৬৭ শতাংশই অসংক্রামক রোগে। যেখানে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি পাঁচজনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (২১ শতাংশ) উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। ফলে এখনই এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসা সেবার সুযোগ যেহেতু কম, তাই বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপিত এনসিডি কর্ণারের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হচ্ছে। রোগীদের অনেক সময় উপজেলা সদরে আসা ব্যয় সাপেক্ষ। এজন্য কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে প্রকল্পটির বিস্তৃতি ঘটাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাথে কাজ চলছে। তবে বিদ্যমান প্রকল্পে নিরবচ্ছিন্ন ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা খুবই জরুরি।

জানা গেছে, বর্তমানে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধগুলো কমিউনিটি ক্লিনিকের বিদ্যমান ওষুধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নয়। এই কর্মসূচির আওতায় সিলেট জেলায় প্রাথমিকভাবে চারটি উপজেলার আটটি কমিউনিটি ক্লিনিকে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ দেওয়া শুরু হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ মহামারি মোকাবিলায় এই কর্মসূচির সম্প্রসারণের মাধ্যমে সকল কমিউনিটি ক্লিনিকে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল বিভাগের লাইন ডিরেক্টর প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ রোবেল আমিন রাইজিংবিডিকে বলেন, প্রকিউরমেন্ট বিভাগে যেহেতু নিয়মমাফিক একটু সময় লাগে, মাঝে মাঝে নির্দিষ্ট সময়ে চাহিদা না জানালে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়। তবে কমিউনিটি ক্লিনিকের বিদ্যমান ওষুধের সাথে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ যোগ করার বিষয়ে ভাবছি, তাহলে এই সমস্যা অনেকটা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। এর বাইরেও ওষুধের মজুত এবং সরবরাহ নিয়ে কাজ চলছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজন প্রাপ্ত বয়স্কের মধ্যে একজনের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, যাদের অধিকাংশ, অর্ধেক নারী (৫১%) এবং দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষ (৬৭%), জানেই না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে তরুণদের মধ্যেও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বে ১.২৮ বিলিয়ন মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে, যার দুই—তৃতীয়াংশ বাস করে বাংলাদেশসহ নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশে।

/হাসান/সাইফ/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়