অতিঝুঁকিপূর্ণ ২০ মার্কেটে চলছে বেচাকেনা, দুর্ঘটনার আশঙ্কা

অতিঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় আছে গুলশান দক্ষিণ পাকা মার্কেট
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) করা ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ ভবনের তালিকায় আছে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ২০টি মার্কেট। এসবের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণে ১১টি এবং ঢাকা উত্তরে ৯টি। এসব মার্কেটে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঝুঁকি উপেক্ষা করেই এসব মার্কেটে চলছে বেচাকেনা। প্রতিদিন হাজার হাজার ক্রেতার সমাগম ঘটছে মার্কেটগুলোতে। বুয়েট তালিকা করার পরও অতিঝুঁকিপূর্ণ এসব মার্কেট ভাঙার বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।
যদিও দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টদের দাবি, তাদের উদ্যোগ ঠিক ছিল, এখনও আছে। ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে তারা সেটা এখনো কার্যকর করতে পারেননি। শিগগিরই তারা এসব মার্কেট থেকে ব্যবসায়ীদের সরিয়ে মার্কেট ভেঙে ফেলবেন।
অতিঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকায় শীর্ষে আছে রাজধানীর কারওয়ানবাজার কাঁচা বাজার (মূলত আড়ত) মার্কেট। বড় দুর্ঘটনা ঘটার আগেই মার্কেটটি বন্ধ করতে তৎপরতা শুরু করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গত ১১ মে কারওয়ানবাজার কাঁচা বাজার (আড়ত) মার্কেটে বিশেষ অভিযান চালায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এই অভিযানে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছিল। কিন্তু, ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে অভিযান অসমাপ্ত রেখেই চলে আসে ডিএনসিসি সংশ্লিষ্টরা। এর পর আর সেখানে দোকান উচ্ছেদ বা মার্কেট ভাঙার কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি।
১১ মে’র অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া ডিএনসিসি অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতাকাব্বীর আহমেদ বলেছেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল মার্কেটটির ১৭৬টি দোকানের বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। বুয়েট ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পর গত এপ্রিল মাসে মার্কেট ছাড়তে ব্যবসায়ীদের নোটিস দেওয়া হয়েছিল। তারা সেটি না মানায় অভিযান চালানো হয়। অভিযানকালে মার্কেটের ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। নির্ধারিত সময় এরইমধ্যে পেরিয়ে গেছে। এখন যেকোনো দিন ডিএনসিসির পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে মার্কেটটি সিলগালা করে দেওয়া হবে।
বুয়েটের প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা উত্তরে ৯টি মার্কেট অতিঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো হলো—কারওয়ানবাজার কাঁচাবাজার মার্কেট, কারওয়ানবাজার ১ নম্বর ভবন মার্কেট, কারওয়ান বাজার ২ নম্বর ভবন মার্কেট, গুলশান উত্তর কাঁচাবাজারের হলুদ মার্কেট, গুলশান দক্ষিণ পাকা মার্কেট, মোহাম্মদপুর টাউন হল পাকা মার্কেট, মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজার এবং মোহাম্মদপুর রায়েরবাজার মার্কেট।
এসব মার্কেটে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার প্রতীক লাল সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতার কারণে মার্কেটগুলো এখনো বন্ধ করা যায়নি। ব্যবসায়ীরা যেমন ঝুঁকির মধ্যে আছেন, তেমনই ঝুঁকিতে আছেন কেনাকাটা করতে আসা মানুষরা।
ঢাকা দক্ষিণে ১১টি অতিঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট আছে। এসবের মধ্যে বঙ্গবাজারও ছিল। গত রমজানে পুরো বঙ্গবাজার মার্কেট পুড়ে যায়। অন্য অতিঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলো হলো—নিউ সুপার মার্কেট, আজিমপুর কবরস্থান মার্কেট, আজিমপুর এতিমখানা মার্কেট, দেবীদাস ঘাট সংলগ্ন বরিশাল হোটেল ভবন, জিন্দাবাহার প্রথম লেনের ভবন, দয়াগঞ্জ ট্রাকস্ট্যান্ড রোড সাইড ভবন, নয়াবাজার নওয়াব ইউসুফ মার্কেট কমপ্লেক্স, ঠাটারিবাজার মার্কেট, খিলগাঁও রেলওয়ে কাঁচাবাজার এবং সিদ্ধেশ্বরীতে লিলি প্লাজা মার্কেট। এই ১০ মার্কেটেও ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে বেচাকেনা।
এদিকে, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে দুই দফায় রাজধানীর বিভিন্ন ভবন পরিদর্শন করে ২ হাজার ৫২৮টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে তারা।
এছাড়াও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব জরিপে উঠে এসেছে, ডিএসসিসির ১০টি অঞ্চলের মধ্যে ৫টি অঞ্চল পরিদর্শন করে তারা ৪৬টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
অতিঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিটি মার্কেটকে ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য যা যা করা দরকার, পর্যায়ক্রমে আমরা সেসব উদ্যোগ নিচ্ছি। কারওয়ানবাজার স্থানান্তরের কাজ ইতোমধ্যে আমরা শুরু করেছি। ব্যবসায়ীরা আমাদের সহযোগিতা করলে এ কাজটি করা অনেক সহজ হবে। ক্রেতাদেরকে আপনাদের মাধ্যমে অনুরোধ করব, তারা যেন ঝুঁকিপূর্ণ এসব মার্কেটে কেনাকাটা করতে না যান। তাহলে ব্যবসায়ীরা এসব ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবেন।
ডিএসসিসি এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ঝুঁকিপূর্ণ যেসব মার্কেট আছে, সেগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য আমরা ডিএসসিসি থেকে সম্মিলিত দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ নিয়েছি। ডিএসসিসির কমিটি মার্কেটগুলোতে নিয়মিত তদারকি করবে। এর মধ্যে কিছু মার্কেট বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলোর ব্যবসায়ীদের সরিয়ে পর্যায়ক্রমে তা ভেঙে ফেলা হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেছেন, ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট থেকে ব্যসায়ীদের সরে যাওয়ার জন্য শুধু নোটিস দিয়েই দায় এড়াতে পারবে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। যেকোনো দিন এসব মার্কেটে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই, সিটি করপোরেশন এসব মার্কেটের ব্যাপারে আরও কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব মার্কেট থেকে ব্যবসায়ীদের অন্য কোথাও পুনর্বাসন করে মার্কেট সিলগালা করে দিতে হবে। এর পর ভেঙে নতুন করে মার্কেট বানাতে হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার পরও মার্কেট ছাড়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতার বিষয়টি দোকান মালিক সমিতি বা ব্যবসায়ীরা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। এ অবস্থা থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সেটা না হলে আগামীতে এসব মার্কেট ধ্বসে পড়া কিংবা অগ্নিকাণ্ডসহ অন্যান্য দুর্ঘটনা বেড়ে জানমালের ক্ষতি আরও বাড়তে পারে।
মেয়া/রফিক
আরো পড়ুন