‘সন্তান হারিয়েছি, এখন কারো ওপর বিশ্বাস নেই’
মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম
ফারদিন নূর পরশ (ফাইল ফটো)
তিন ছেলের মধ্যে বড় ছিলেন ফারদিন নূর পরশ। পড়ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। তাকে নিয়ে বড্ড আশা ছিল পরিবারের। কিন্তু, সেই আশায় গুড়েবালি। এক বছর আগে মারা গেছেন ফারদিন নূর পরশ। তার মৃত্যু নিয়েও তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। ফারদিনের বাবা অভিযোগ করেছেন, তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি ছেলের বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরার নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত কয়েকজনের বিরুদ্ধে রাজধানীর রামপুরা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। থানা পুলিশের পর মামলাটি তদন্ত করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বুশরার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি মর্মে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে ডিবি। এর তীব্র বিরোধিতা করেছে ফারদিনের পরিবার।
ফারদিনের বাবা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রভাবিত হয়ে মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। বুশরার প্রত্যক্ষ মদদ না থাকতে পারে। তবে, সে তথ্য গোপন করেছে। সন্তান হারিয়েছি, এখন আর কারো ওপর বিশ্বাস নেই। তবু, আশায় আছি।
নিখোঁজের তিন দিন পর গত বছরের ৭ নভেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের লাশ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। ৯ নভেম্বর রাতে তার বাবা নুর উদ্দিন রানা বাদী হয়ে রামপুরা থানায় মামলা করেন। মামলায় নিহতের বান্ধবী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বুশরাসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়।
গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র্যাব জানায়, ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন। এর সঙ্গে বুশরার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। পরে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি বুশরার অব্যাহতি চেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি’র পরিদর্শক ইয়াসিন শিকদার। গত ১৬ এপ্রিল ডিবি’র দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মামলার বাদী নুর উদ্দিন রানার নারাজির আবেদন মঞ্জুর করে সিআইডিকে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। সর্বশেষ গত ৩০ অক্টোবর এ মামলায় অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু, ওইদিন মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আলী হায়দারের আদালত আগামী ২৭ নভেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন।
এদিকে, তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির ঢাকা মেট্রো (পূর্ব) পরিদর্শক বেলায়েত হোসেন আসামি বুশরাকে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেন। আদালত আগামী ধার্য তারিখে বুশরাকে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হাজিরের নির্দেশ দেন। বুশরা বর্তমানে জামিনে আছেন।
মামলা সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন বলেছেন, মামলাটির অদিকতর তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছি। তদন্ত চলছে। তবে, এখনো উল্লেখযোগ্য বা চাঞ্চল্যকর কিছু পাইনি। বুশরাকে আদালতের নির্দেশ মোতাবেক জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কিছু তথ্য পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে।
ফারদিনের বাবা নুর উদ্দিন রানা বলেছেন, সন্তান হারিয়ে টিকে থাকা কষ্ট। তবুও আছি। ছেলেটার গ্লোরিয়াস ক্যারিয়ার ছিল। সবদিক থেকে এক্সপার্ট ছিল। এভাবে একটা মেধাবী ছেলেকে হত্যা করা হলো। এখন বলা হচ্ছে, সে আত্মহত্যা করেছে। স্ট্রাগল করে বড় হয়েছি। ছেলেদের তা-ই শিখিয়েছি।
তিনি বলেন, মামলাটি নিয়ে কেমন যেন লুকোচুরি চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সত্য গোপন করেছে। ঘটনা অন্যদিকে প্রভাবিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ফারদিন ৫ ঘণ্টা ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করেছে। সেই পাঁচ ঘণ্টার ভিডিও ফুটেজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রকাশ করছে না কেন? ওইটা প্রকাশ করলেই তো সব ক্লিয়ার হয়ে যায়। আমাদের দেশে দুষ্টুকে লালন আর শিষ্টকে দমনের ট্রেন্ড চলছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বলেছেন, আঘাতে মৃত্যু হয়েছে আর পুলিশ বলছে, আত্মহত্যা করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা বলতে চাচ্ছে, সবই গসিপ। তবু আশায় আছি, সন্তান হত্যার সুষ্ঠু বিচার পাবো।
বুশরার বিষয়ে তিনি বলেন, বুশরার হয়ত প্রত্যক্ষ মদদ নেই। তবে, সে তথ্য গোপন করছে। সে আর ফারদিন ৫ ঘণ্টা একসাথে ছিল। সে বিষয়ে সে কিছু বলছে না। কী আর বলব! আমি আমার সন্তান হারিয়েছি। এখন আর কারো ওপর বিশ্বাস নেই।
বুশরার বাবা মঞ্জুরুল ইসলাম সবুজ বলেন, আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম, বুশরা ঘটনার সাথে জড়িত না। তারপরও তাকে মামলায় জড়ানো হলো। পরে তো ডিবি পুলিশ তদন্ত করে দেখলো, বুশরা জড়িত না। আবার মামলাটা অধিকতর তদন্তে গেছে। টেনশন কাজ করছে। নির্দোষ মেয়েটা শুধু শুধু হয়রানির শিকার হলো। সিআইডি তাকে ডেকেছিল। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তারা সবকিছু যাচাই-বাছাই করছে। আশা করছি, এবারের তদন্তেও মেয়েটা নির্দোষ প্রমাণিত হবে।
তিনি বলেন, সবকিছু ভুলে মেয়েটা লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা তার পাশে আছি। মানসিকভাবে তাকে সাপোর্ট দিচ্ছি।
মামুন/রফিক