ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

তাজরিন ট্র্যাজিডি

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়েও আদালতে আনা যাচ্ছে না সাক্ষীদের

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৫, ২৪ নভেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৬:৩৭, ২৪ নভেম্বর ২০২৩
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়েও আদালতে আনা যাচ্ছে না সাক্ষীদের

তাজরিন ফ্যাশন গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জন শ্রমিক মারা যান

১১ বছর আগের এই দিনে রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরিন ফ্যাশন গার্মেন্টস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে ১১১ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যান। আহত হন শতাধিক। পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম একটি মামলা করেন। ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক এ কে এম মহসিনুজ্জামান খান আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। আট বছর আগে বিচার শুরু হলেও এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে কচ্ছপ গতিতে। রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারছে না। সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জামিনঅযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তবু, তাদের আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না।

১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ১১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের ১৮ মে তাজরিন ফ্যাশন গার্মেন্টসের দুই কর্মী সাক্ষ্য দেন। গত দেড় বছরে আর কোনো সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।

মামলাটি বর্তমানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ শফিকুল ইসলামের আদালতে বিচারাধীন। সর্বশেষ গত ১ নভেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু, ওই দিন কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির হননি। এজন্য আদালত আগামী ২৫ মার্চ পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিধ ধার্য করেছেন। ছয় সাক্ষীর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।

সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মো. মুর্শিদ উদ্দিন খাঁন বলেছেন, রাষ্ট্রপক্ষ যথেষ্ট তৎপর মামলাটির বিচার শেষ করতে। কিন্তু, সাক্ষী না আসায় মামলাটির বিচার শেষ হচ্ছে না। সাক্ষীদের সমন পাঠানো হয়, ফোন দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে জামিনঅযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। তারপরও তারা আসেন না। আদালত মামলাটি শেষ করতে জোর দিচ্ছেন। কয়েকজন মূল সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়ার পর সাক্ষ্য গ্রহণ ক্লোজ করা হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরিন গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লাগে। এতে ১১১ জন পোশাক শ্রমিক দগ্ধ হয়ে মারা যান। আহত হন ১০৪ জন শ্রমিক। কারখানাটিতে ১ হাজার ১৬৩ জন শ্রমিক কাজ করতেন। দুর্ঘটনার সময় ৯৮৪ জন শ্রমিক সেখানে কর্মরত ছিলেন। নিহত ১১১ জনের মধ্যে তৃতীয় তলায় ৬৯ জন, চতুর্থ তলায় ২১ জন, পঞ্চম তলায় ১০ জন, পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন হাসপাতালে মারা যান ১১ জন। শনাক্ত করা ৫৮টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি ৫৩ লাশ অশনাক্ত অবস্থায় জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। ওই ঘটনায় আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর জন্য দণ্ডবিধির ৩০৪(ক) ধারা যুক্ত করা হয়। মামলাটি তদন্তের পর ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক এ কে এম মহসীনুজ্জামন।

কারখানা ভবনের নকশায় ত্রুটি ও জরুরি নির্গমনের পথ ছিল না। আগুন লাগার পর শ্রমিকরা বাইরে বের হতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মীরা অগ্নিকাণ্ডকে অগ্নিনির্বাপণ মহড়া বলে শ্রমিকদের কাজে ফেরত পাঠিয়ে কলাপসিবল গেট লাগিয়ে দেন বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়।

এ মামলায় মোট ১০৪ জনকে সাক্ষী করা হয়। এখন পর্যন্ত ১১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। বাকি এখনও ৯৩ জন। আদালত সাক্ষীদের প্রতি অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান এ মামলার চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন এবং পরবর্তী বিচারের জন্য অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে স্থানান্তর করেন। সর্বশেষ গত ১ নভেম্বর সাক্ষী দিতে না আসায় আদালত ছয় সাক্ষীর বিরুদ্ধে জামিনঅযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। তারা হলেন—পুলিশ পরিদর্শক এসএম বদরুল আলম, মঞ্জুর পাল, তাজরিন গার্মেন্টস কারখানার লোডার সর্দার ধলা মিয়া, অপারেটর আকলিমা, রাবেয়া খানম ও আলী হোসেন।

মামলাটিতে চার্জশিটভুক্ত ১৩ জন আসামির মধ্যে চার আসামি পলাতক ও ৯ জন জামিনে। আসামিরা হলেন—প্রতিষ্ঠানের মালিক দেলোয়ার হোসেন, চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, লোডার শামীম, স্টোর ইনচার্জ (সুতা) আল আমিন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল আমিন, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনোয়ারুল, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জুর ও কোয়ালিটি ম্যানেজার শহীদুজ্জামান দুলাল। তাদের মধ্যে আল আমিন, মো. রানা ওরফে আনারুল, শামীম মিয়া ও মোবারক হোসেন মঞ্জু পলাতক। অপর আসামিরা জামিনে আছেন।

আসামি দেলোয়ার হোসেন ও মাহমুদা আক্তারের আইনজীবী হেলানা পারভীন বলেছেন, মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন আছে। রাষ্ট্রপক্ষ ঠিকমতো সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পারছেন না। এজন্য সাক্ষ্য গ্রহণও শেষ হচ্ছে না। 

রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সাক্ষীদের অধিকাংশই পোশাক শ্রমিক। অধিকাংশ সাক্ষীর ঠিকানায় গিয়ে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না বলে আদালতকে অবহিত করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। আমরাও চাই, মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। দীর্ঘদিন ধরে মামলাটি চলমান থাকায় আসামিরাও মানসিক ও আর্থিকভাবে কষ্ট পাচ্ছে। মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হলে আসামিরা ন্যায়বিচার পাবে।

আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী রোকেয়া বেগম বলেন, দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়েছে। সাক্ষীরা আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। সত্য কথা হচ্ছে, ঘটনাস্থলে আসামিরাও ভিকটিমাইজ ছিল। কে বা কারা এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে, আদালতে সাক্ষীর মাধ্যমে ওইভাবে প্রমাণিত হয়নি। এখন পর্যন্ত এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও লাশ শনাক্তকারী কারোরই সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। যেহেতু বিলম্ব হচ্ছে, এজন্য সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধের জন্য আমরা আবেদনও করেছি। কিন্তু, আদালত আরও একবার সময় দিয়েছেন সাক্ষীদের উপস্থিত করার জন্য। এ পর্যন্ত  ১১ জনের সাক্ষ্য হয়েছে। এদের মধ্যে কেউই আসামিদের বিরুদ্ধে কিছু বলেনি। কোনো সাক্ষী প্রমাণ করতে সক্ষম হননি যে, আসামিরা ওইখানে ছিলেন বা আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে। আসলেই আমরাও ওখানে ভিকটিমাইজ হয়েছি। এটা একটা দুর্ঘটনা ছিল। দুর্ঘটনার কারণে আগুনটা লেগেছিল বলে সব সাক্ষীই মন্তব্য করেছেন। 

তিনি বলেন, মামলার রায়ে আসামিদের খালাস আশা করছি। কারণ, আসামিরাই ওই সময় ভিকটিমাইজ ছিল। কারো কোনো দায় ছিল না। এটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র।

মামুন/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ