ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৯ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৬ ১৪৩১

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন

নারী প্রার্থী ৯৪ জন, রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা কতটা চ্যালেঞ্জের

জাহাঙ্গীর আলম বকুল  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৫৬, ৬ জানুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ২০:০১, ৬ জানুয়ারি ২০২৪
নারী প্রার্থী ৯৪ জন, রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা কতটা চ্যালেঞ্জের

গাজীপুর-৫ আসনের নৌকার প্রার্থী মেহের আফরোজ চুমকি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর অন্য জেলা থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম। এ জেলায় সংসদীয় আসন পাঁচটি। যেখানে তিনটিতেই নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ দল আওয়ামী লীগ। 

তবে, শুধু গাজীপুর নয়, এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ১ হাজার ৮৯৫ প্রার্থীর মধ্যে নারী ৯৪ জন। যদিও পুরুষের তুলনায় তা মাত্র ৫ শতাংশ। তবে, নারী প্রার্থীর মনোনয়ন এবার বেড়েছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থী ছিল ৬৮ জন।

আসন্ন নির্বাচনে ২৭টি দল অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে ১৪টি দল ৬৮ জন নারীকে মনোনয়ন দিয়েছে। ২৬ জন নারী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ২৪ জন নারীকে মনোনয়ন দিয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল-৪ আসনে শাম্মী আহমেদের প্রার্থিতা বাতিল করেছেন আদালত। 

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর দেশের রাজনীতিতে যে ধারা শুরু হয়, সেখানে দুটি বৃহৎ দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে চলে আসেন নারী। পরবর্তীতে অন্যতম বৃহৎ দল জাতীয় পার্টির গুরুত্বপূর্ণ পদেও নারীরা সুযোগ পান। তবে, তৃণমূল পর্যায়ের অবস্থা ভিন্ন। সেখানে নারীদের উঠে আসা পুরুষের মতো সহজ নয়। যেসব নারী স্থানীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছেন, তাদের অধিকাংশই উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনীতিতে এসেছেন।

গাজীপুর-৩, ৪ ও ৫ নং আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া তিন নারী প্রার্থী পিতার পরিচয়ে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। গাজীপুর-৩ আসনের প্রার্থী রুমানা আলী টুসি বাবা অ্যাডভোকেট রহমত আলীর মৃত্যুর পর রাজনীতিতে এসেছেন। রহমত আলী গাজীপুর থেকে পাঁচ বার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। বাবার সূত্রে গোছানো ফিল্ড পেলেও অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। 

রুমানা আলী টুসি বলেন, ‘অনেকেই এ জায়গাগুলো তৈরি করে নিতে পারে না। সুযোগটা তৈরি হয় না। পুরুষরাই তো আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। তারা কাজ করার সুযোগ দেয় না। কাজ করতে চাইলেও পাশে এসে দাঁড়ায় না।’ 

দেশের জাতীয় নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের মনোনয়নের ক্ষেত্রে পারিবারিক রাজনীতির সংস্কৃতি বেশি প্রাধান্য পায় কি না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা এ উপমহাদেশের ট্রেন্ড। বিভিন্ন দেশে এ প্র্যাকটিস আছে।’ বাবার কারণে তৈরি করা মাঠ ও কর্মীদের পেয়েছেন বলে জানান তিনি। 

গাজীপুর-৪ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি এখন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী কমিটি সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তিনি শহিদ জাতীয় চার নেতার অন্যতম বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। তিনি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন তার মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন।

রাজনীতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে রাজনীতি নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা পরিবার থেকে পেয়েছেন বলে মনে করেন সিমিন হোসেন রিমি। তিনি বলেন, পরিবার আমাকে শিক্ষা দিয়েছে, কীভাবে মানুষের জন্য কাজ করতে হয়। কাজের ক্ষেত্রে সব সময় আমি মানুষকে পাশে পেয়েছি। তাদের সহযোগিতায় উন্নয়নমূলক কাজগুলো সঠিকভাবে করার চেষ্টা করতে পেরেছি।

গাজীপুর-৫ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ও মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী মেহের আফরোজ চুমকি শহিদ ময়েজ উদ্দিনের মেয়ে। ময়েজ উদ্দিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা করার জন্য গঠিত ‘মুজিব তহবিলের’ আহ্বায়ক ছিলেন। ছিলেন সংসদ সদস্যও। সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে মিছিলে তিনি নিহত হন।

উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনীতিতে আসা এবং সুবিধা পাওয়ার কথা অকপটে স্বীকার করেন মেহের আফরোজ চুমকি। তিনি বলেন, ‘বাবাকে দেখেই মূলত রাজনীতিতে আসার আগ্রহ। যেহেতু, ওই সময় থেকেই অনেকে আমাকে চেনেন, তাই স্থানীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি। বাবার সহকর্মী বা সহযোদ্ধা যারা ছিলেন, তারা সহযোগিতা করেছেন।’

তবে, রাজনীতির মাঠ গুছিয়ে নেওয়া তার জন্য সহজ ছিল না। চুমকি বলেন, নতুন প্রজন্মকে সংগঠিত করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। রাজনীতির মাঠে সবাই যে বন্ধু তাও নয়। অনেকে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করেছেন।

আরও পড়ুন: কী ভাবছেন তৃণমূলের ভোটাররা

জনগণের নেতৃত্ব দেওয়া সব সময় চ্যালেঞ্জের। আর নারীর ক্ষেত্রে তা আরও কঠিন। নেতাদের নেতৃত্বের জায়গাটা প্রস্তুত করে নিতে হয়। দেশের রাজনীতিতে তৃণমূল থেকে উঠে আসা নারী নেতৃত্বও হাতেগোনা।

দলের নেতৃত্বও ভোটে জয়-পরাজয়ের হিসাব, পারিবারিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনায় নিয়ে মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়। তবে, তৃণমূল পর্যায়ের ভোটারদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই বদলেছে। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, প্রার্থী নারী নাকি পুরুষ, সেটা তাদের বিবেচনার বিষয় নয়। 

সেখানকার একজন ভোটার জানান, পছন্দের দলের প্রার্থী যিনি হবেন, তাকেই ভোট দেবেন। সেখানে নারী বা পুরুষ প্রার্থী বিষয় নয়।  

তবে, সেখানকার একজন নারী ভোটার জানান, তিনি প্রার্থী দেখে ভোট দেবেন। যিনি শিক্ষিত, এলাকার উন্নয়ন করবেন; তাকেই ভোট দেবেন।

বিভিন্ন পেশার নারীদের তাদের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা হওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে। এবারের নির্বাচনে এমন কয়েকজন প্রার্থী আছেন। পেশাগত জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে রাজনীতিতে ভালো করাও যে সহজ নয়, তা স্বীকার করেছেন পাবনা-২ (সুজানগর-বেড়ার একাংশ) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ডলি সায়ন্তনী। 

ডলি সায়ন্তনী বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ নারী বলে নয়। চ্যালেঞ্জ একটাই, আমি একা লড়ছি। আমাকে কেউ সহযোগিতা করছে না। আমার পাশে শুধু আমার গ্রামবাসী। নারী হলে অনেক কিছু মোকাবিলা করতে হয়।’ 

মিথ্যা তথ্য ছড়ানোকে রাজনীতিতে বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন ডলি সায়ন্তনী। তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে একটাই বাধা বা প্রতিবন্ধকতা, সেটা হলো—মিথ্যা বলা ও মিথ্যা ধারণা দেওয়া। মানুষ রাজনীতি করে খুব বেশি মিথ্যা বলে। কেন বলে, জানি না। এখনকার রাজনীতিতে খুব ধোঁকাবাজি চলে। এটাই বড় বাধা আমার কাছে।’ 

গ্রামের মানুষরা খুব সহজ-সরল হয়। নেতাদের কাছে যেতে হয় এবং কাছের করে নিতে হয় বলে জানান রাজনীতির মাঠে নতুন এই প্রার্থী।  

ভোটের মাঠ সরগরম করে রেখেছেন রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী মাহিয়া মাহি। প্রচারণা শুরুর পর থেকে ছুটে চলেছেন দুই উপজেলায়। তবে, নানা বাধা-বিপত্তির মুখে পড়তে হচ্ছে তাকে। মাহি মনে করেন, এসব সামলে টিকে থাকাটা একজন নারীর জন্য চ্যালেঞ্জের।

সম্প্রতি তানোর উপজেলার কৃষ্ণপুর বাজারে গণসংযোগ করেন তিনি। সেখানে সাংবাদিকদের বলেন, রাজনীতি যতটুকু ভয়ঙ্কর, বাস্তবে আরও বেশি ভয়ঙ্কর, আরও বেশি জটিল।

মাহির স্বামী রাজনীতিবিদ। এ কারণে বিভিন্নভাবে তার সহযোগিতা পাচ্ছেন মাহি। তিনি বলেন, ‘আমার হাজবেন্ড রাজনীতিবিদ, ওর জন্যই এখন পর্যন্ত টিকে আছি।’

তবে, নারী প্রার্থী হিসেবে কিছুটা সুবিধা পাওয়ার কথাও জানান মাহি। বিশেষ করে নারী ভোটারদের কাছাকাছি যেতে পারছেন। ‘আমি যখন মানুষের কাছাকাছি আসি, নারীরা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। তারা আমাকে আপন করে নেয়,’ বলেন মাহি। 

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন রাজশাহীর প্রতিনিধি শিরীন সুলতানা কেয়া, পাবনার প্রতিনিধি শাহীন রহমান, গাজীপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক রেজাউল করিম) 
 

/রফিক/

ঘটনাপ্রবাহ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়