ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বেকারদের ঈদ

রাসেল পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৫, ২০ জুলাই ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বেকারদের ঈদ

মানিব্যাগ শূন্য (ফাইল ফটো)

রাসেল পারভেজ : ঈদ মানে খুশি। আনন্দ-উৎসব। এ উৎসব উদ্‌যাপনের জন্য আগে থেকে সবাই কিছু-না-কিছু প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। নতুন পোশাক, খাওয়াদাওয়া, বেড়াতে যাওয়া, আড্ডা দেওয়া- সবকিছুতেই থাকে আগাম পরিকল্পনা।

কিন্তু যারা বেকার, তাদের ঈদ-পরিকল্পনা কেমন হয়, জানার আগ্রহ হলো। বেকাররা কি ঈদের কেনাকাটা করে? কাউকে কিছু উপহার দেয়? ঈদের দিন তারা কী কী করে সময় কাটায়? আরো কিছু প্রশ্ন নিয়ে আলাপ হলো আমার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে, বন্ধুতুল্য ছোট ভাই, বড় ভাইয়ের সঙ্গে।

মুঠোফোনে তাদের সঙ্গে দীর্ঘসময় কথা বলেছি। সে অনেক কথা, অনেক গল্প। স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নে টালমাটাল জীবনের গল্প, ন্যূনতম প্রয়োজন মিটিয়ে বেঁচে থাকার গল্প। তাদের গল্প শুনে আমার মনে হয়েছে, কোনো এক ঔপন্যাসিক দক্ষ হাতে নির্মাণ করেছেন এসব বেকার চরিত্র। তাদের গল্প এ লেখায় আমি বলব না। কারণ তারা জানেই না, আমি তাদের নিয়ে লিখব। জানি, লেখাটি তাদের মধ্যে সবাই পড়বে। এও জানি, তারা বিশ্বাস করে, আমি তাদের সহমর্মী। তাদের বাস্ততা নিয়ে কিছু কথা লিখে সময়ের ছোট্ট ফ্রেমে বেকারদের ঈদের পরিকল্পনা চিত্রিত করার চেষ্টা করছি।

আমাদের সমাজের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, পারস্পরিক সহমর্মিতার ভিত্তিতে একে অপরের প্রতি নির্ভরশীলতা। বাবা-মা ছেলেমেয়েকে বড় করে তোলেন, আয়-রোজগারের ব্যবস্থা হলে ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে দেখে। ভাইবোনের মধ্যেও এমন নির্ভরতার সম্পর্ক আছে। ফলে বেকার ছেলেমেয়েকে বাবা-মা, ভাইবোনেরা চাকরি-বাকরি না হওয়া পর্যন্ত সহযোগিতা করে থাকে। ঈদেও তাদের বঞ্চিত করতে চায় না তারা।

কিন্তু কত দিন? একদিন একমাস, বছর, বছর ঘুরে ঈদ! তারপর? হতাশা। জীবনটা তেতো হয়ে আসতে থাকে। বছরের পর বছর যখন বলতে হয়, ‘আমি কিছু করি না। বেকার।’ তখন তার অবস্থা কেমন হয়? যে বেকার নয়, সে তা বুঝবে কী করে। ঈদে অন্যরা যখন পরিবারের সদস্যদের উপহার দিচ্ছে, তখন নিজের ঈদ-খরচের জন্য কারো কাছে হাত পাতা কতটা বেদনার, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মা-বাবার বিমর্ষ মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, চাকরি না হওয়া পর্যন্ত আর ঘরে ফিরব না! কিন্তু চাকরি পাওয়া কি সহজ কম্মো যে চাইলাম আর হয়ে গেল!

আমার এক বন্ধু দেশের দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানের একটি দামি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছে। শিক্ষার চারটি স্তর উত্তীর্ণ হয়েছে প্রথম শ্রেণি নিয়ে। এসএসসিতে সেন্টার ফার্স্ট। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চার বছর হলো সে বেকার- ফোর্থ ফার্স্ট ক্লাস বেকার! স্বপ্ন তার আকাশ-কুসুম কল্পনা নয়। প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদার একটি সরকারি চাকরির জন্য তার যত প্রচেষ্টা। শেষ পর্যন্ত ব্যাংক-বিমাতেও চেষ্টা করেছে। কথায় কথায় সেদিন বলল, চার বছরে না-হলেও ৩০টি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছে। ভাইভা দিয়েছে ১০ জায়গায়। কিন্তু কোথাও যোগদান করতে পারেনি। অবশ্য অনেক ‘এলেবেলে’ প্রার্থী নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে চাকরি জুটিয়েছে। কিন্তু তার ভরসা মেধা, জ্ঞান ও পরিশ্রম। বড় খেদ নিয়ে সে আমাকে বলল, ‘জানিস তো, বেকারদের বৈশিষ্ট্য কী?’ আমি বললাম কী? বলল, ‘বেকারদের চোখভরা স্বপ্ন আর বুকভরা দীর্ঘশ্বাস।’ আরো বলল, ‘চারপাশে অনেকেই ঈদের কেনাকাটা করছে কিন্তু আমার শুধু দীর্ঘশ্বাস, বুঝলি তো?’

এ বন্ধুর কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম তার ঈদের পরিকল্পনা। বলল, ‘সারা দিন ঘুমাব। আর এখন তো দু-একজন ছাড়া কোনো বন্ধু ফ্রি নেই। সবারই প্রায় সংসার হয়েছে। জামাইরা এখন শ্বশুরবাড়ি যায়, ফাও আড্ডা দেওয়ার সময় কই? আমার আর কী, যে লাউ সেই কদু!’

আরেক ছোট ভাই, সেও বন্ধুতুল্য। বছর দুয়েকের বেকার সে। ঈদে তার শপিং বাজেট ২০০ টাকা! ভার্সিটিতে পড়াকালীন দিনে ১০০ টাকা যার চা-সিগারেটে যেত, তার ঈদের বাজেট নাকি ২০০ টাকা। অবাক কাণ্ড! সে তার কেনাকাটার তালিকা শোনাল। একটি স্যান্ডো গেঞ্জি, একটি আন্ডারওয়ার আর একটি টুপি। ব্যস, ঈদের কেনাকাটা শেষ। আমাকে টিপ্পনী কেটে বলল, ‘তুই চাইলে গেঞ্জিটা তোকে গিফট করতে পারি। কারণ লোকে জানে, আমি বেকার। ওই যে কথায় আছে না, ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর আকাঁড়া! বেকারের জন্য নতুন-পুরোনো সবই এক।’ প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, ‘তোদের সরকার তো আর চাকরি-বাকরি দেবে না। চিন্তা করছি, এবার কিছু একটা করা চাই। প্রতিদিন একই চিন্তা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। তাই ঈদের দিনে নাক ডেকে ঘুমাব বলে ঠিক করেছি।’

ঈদের লেখা হয় আনন্দের, মজার। কিন্তু আমি এমন এক বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি, সারা দিন-রাত লিখলেও এখান থেকে মজা করার দুবাক্য বের করা যাবে না। যদি যায়, তবে তা হবে প্রহসন। দেশের ৩ কোটি বেকারের সঙ্গে প্রহসন। দেশে যখন ঈদ-উৎসবের মহা আয়োজন চলছে, তখন এই ৩ কোটি বেকারের দীর্ঘশ্বাস আমরা পাথরচাপা দিতে পারি না। তাদের কথা আড়াল করতে পারি না। যদি এই ৩ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হতো, তাহলে ঈদের বাজার আরো বড় হতো। হয়তো ৩ কোটি কেজি সেমাই বেশি বিক্রি হতো, চিনির বাজার চাঙ্গা হতো, পোশাকের বাজার আরো বেশি জাঁকজমক হতো। রাজস্ব বাড়ত। দেশ এগিয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। আমাদের দেশ এক হাত কেটে ফেলে সামনে এগোনোর চেষ্টা করছে। দেশের প্রায় অর্ধেক নাগরিককে বেকারের খাতায় রেখে সাফল্যগাথা রচনা করা যেকোনো সরকারের জন্য খোয়াব ছাড়া কিছু নয়।

লেখার মূল স্রোতে এসে যাওয়ায় বেকারদের নিয়ে কিছু বাড়তি কথা বলা গেল। পরিকল্পনায় ছিল না। তবে যে সম্পর্কে বলছিলাম, বেকারদের ঈদ-পরিকল্পনা, তা দিয়ে লেখার শেষে পৌঁছতে চাই। বলছি সেই ৩ কোটি বেকারের কথা, যার মধ্যে উদাহরণ হয়ে আছে আমার কয়েকজন বন্ধু। চাকরি যাদের কাছে সোনার হরিণ। ঈদের দিনে যদি তাদের পরিকল্পনা হয়, মাথা নিচু করে হাঁটা, নিজেকে গোপন করা, আড্ডার খরচের জন্য দু-এক শ টাকা কারো কাছ থেকে হাত পেতে নেওয়া- তাহলে গোটা দেশ ঈদের আনন্দে হাসবে কী করে? কিন্তু ঈদ এলে দেশ হাসে, হাসবেও। ক্ষণিকের জন্য হাসির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় বেকারদের হতাশামাখা অসংখ্য মুখ। আর সব পাওয়ার দল বলে- কী সুখ, আহা রে, কী সুখ!


 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জুলাই ২০১৪/রাসেল পারভেজ/কমল কর্মকার

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়