ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন

আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৬, ১৫ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১১:৫৯, ১৬ আগস্ট ২০২১
বঙ্গবন্ধু ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের; পুরো জাতি অর্থাৎ এ দেশের মানুষকে একটা সুযোগ দিয়েছেন যেন ক্রীড়াঙ্গনে অবদান রাখার মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে নিজেদের তুলে ধরতে পারি। ক্রীড়াঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর অবদান অপরিসীম। নিজে খেলতেন, খেলোয়াড় ছিলেন, তাঁর পুত্র, পরিবারের প্রত্যেকেই খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত। দেশ গড়ার লক্ষ্যে জাতির সামনে এমন উদাহরণ তৈরি করেছেন যার কল্যাণে বাংলাদেশের যুব সমাজ আজও উপকৃত হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু নিজে ওয়ান্ডার্স ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। শেখ কামাল ভাইয়ের একটা ঘটনা আমার মনে আছে। একদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাসায় বসে আছেন। বিভিন্ন সময় তাদের মধ্যে অনেক বিষয়ে গল্প ও আড্ডা হতো। বঙ্গবন্ধু যেহেতু ওয়ান্ডার্সে খেলেছেন তাই নিজের ক্লাব নিয়ে কথা বলতেন। কামাল ভাই আবাহনীর কথাই বলতেন। হাসি ঠাট্টা করতেন অনেক। দুজনের দুই ক্লাব পছন্দ। নিজের ক্লাবের সেরা অংশ ও গৌরব নিয়ে মধুর বিতর্কের আড্ডা জমতো ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সেই বাড়ির ড্রইংরুমে, চিলেকোঠায়।

এতোটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা

বঙ্গবন্ধুর আমলের একটা কথা অজানা রয়ে গেছে অনেকের কাছে। কামাল ভাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক আলোচনায় বলছিলেন, আমাদের দেশের জন্য একটা ক্রীড়া একাডেমি করার জন্য। সেটা তাৎক্ষণিকভাবেই বঙ্গবন্ধু গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন প্রফেসর ইউসুফ আলী। সঙ্গে সঙ্গে ডেকে তিনি শিক্ষামন্ত্রীকে দায়িত্ব দেন। তখন শিক্ষামন্ত্রীর কথা বলছি; কারণ তখন ক্রীড়ামন্ত্রীর আলাদা কোনো মন্ত্রণালয় ছিল না। শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ছিল ক্রীড়া কর্মকাণ্ডের অংশবিশেষ। তাদের তত্ত্বাবধানে চলতো স্পোর্টসের কাজ। ক্রীড়া একাডেমির জন্য স্থান নির্ধারণ করে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শিক্ষামন্ত্রীকে সেদিন নির্দেশ দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু তো মাত্র সাড়ে তিন বছর এ দেশের দায়িত্বে ছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের চারদিকে সে সময় নানান সমস্যা ছিল। সবকিছু চাইলেই করতে পারতেন না। দুইশ বছরের গোলামি, ২৫ বছর পাকিস্তানের পরাধীনতা, তার ওপর ঝড়-বন্যা, একটার পর একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই ছিল। নয় মাসের মহান সংগ্রাম ও গর্বের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের হারিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তানিদের অত্যাচার, শোষণে পুরো দেশ ধ্বংসস্তূপ প্রায়।  এক কোটির বেশি লোক গৃহহীন। আমাদের ব্যাংকে একটা ডলার পর্যন্ত ছিল না। রাস্তাঘাট, এয়ারপোর্ট, বন্দর সবই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল।

সেখান থেকে একটা দেশকে আবার অর্থনীতিতে সচল করার কাজটা কিন্তু সহজ ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই সময়ও পেলেন কই? সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে পরিবারসহ হত্যা করা হয়। সামান্য পাওয়া সেই সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য যা করেছেন তা লিখে শেষ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু ও কামাল ভাইয়ের সেদিনের আলাপচারিতায় বিকেএসপির মতো ক্রীড়া একাডেমি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তী সময়ে বিকেএসপি গড়ে ওঠে। আজ বিকেএসপিতে আমরা বিশ্বসেরা সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি। বিকেএসপির কারণে অনেকে দেশে ও বিদেশে কর্মদক্ষতা দেখিয়ে যাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু প্রিয় বন্ধু ও রাজনৈতিক সতীর্থ মহিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে 

 

৩২ নম্বর বাড়িটা যেন খেলাধুলার জগৎ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্রীড়াঙ্গনে সম্পৃক্ততা ও তাঁর অবদান নতুন করে বলার কিছু নেই। দেশবাসী জানে, পৃথিবী জানে। বঙ্গবন্ধুর বড় দুই ছেলে শেখ কামাল ও শেখ জামাল কিন্তু খেলাধুলার সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে জড়িত ছিলেন। শেখ কামাল ভাই তো পুরোপুরিই ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ। ভালো বাস্কেটবল খেলতেন, ক্রিকেট খেলতেন এবং দক্ষ ক্রীড়া সংগঠকও ছিলেন। তিনি এমন একটা সংগঠন রেখে গেছেন যে সারা পৃথিবীতে সেটা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। বাংলাদেশের জন্য তো অবশ্যই। আবাহনীর মতো একটি ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। সেই সময়ে যা বিশ্ব অঙ্গনে মডেল হিসেবে রয়ে গেছে। শেখ জামাল ভাইয়েরও খেলাধুলার প্রতি বাড়তি আগ্রহ ছিল। আমরা একই স্কুলে পড়তাম। তিনি আমার সিনিয়র ছিলেন। তিনিও খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন। স্কুলে যত ধরনের খেলা ছিল সবগুলোতে অংশ নিতেন। পরবর্তী সময়ে ক্লাব পর্যায়েও খেলেছেন শেখ জামাল।

শেখ রেহানা আপার কথা বলতে হয়। রেহানা আপাকে একবার বলেছিলাম, হাসিনা আপা তো মাঠে আসেন, খেলা দেখেন। আপনি আসেন না কেন? তিনি বললেন, ‘আমার খুব ইচ্ছা করে। আমি দেখিও মাঝেমধ্যে টিভিতে। কিন্তু মাঠে গিয়ে খেলা দেখলে আমার কামাল-জামালের কথা খুব মনে পড়ে। ওরা দুজন আমাদের দুই বোনকে নিয়ে যেত লেকের পাড়ে। ওরা ব্যাটিং করতো সারাদিন, আর আমাদের দিয়ে বোলিং করাতো। এগুলো মধুর স্মৃতি। মনে পড়লেই খুব খারাপ লাগে! এ জন্য মাঠে যাওয়া আমি একটু এড়িয়ে যাই।’ 

এখনও ৩২ নম্বরের বাড়িতে গেলে কিন্তু দেখা যায় খেলাধুলার সরঞ্জাম পড়ে রয়েছে। ডিসপ্লেতে আছে। ব্যাট-বলসহ খেলার অন্যান্য সরঞ্জামাদি। সেগুলো দেখলে বোঝা যায়, খেলাধুলার প্রতি কি অনুপম ভালোবাসা ছিল ধানমন্ডির ঐ বাড়িটায়।

পারিবারিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের মেলবন্ধন

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব গভীর ছিল। খুব আদর করতেন আমাদের। আমরা একই রাস্তার বাড়িতে ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর দুই-তিনটা বাড়ির পর আমাদের বাড়ি। আমার বাবা (জাতীয় নেতা সাবেক সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদ) ও বঙ্গবন্ধু ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের একদম তুই-তুই সম্পর্ক ছিল। তারা একই সময়ে একই আন্দোলন করেছেন। হাঙ্গার স্ট্রাইক করেছেন। কারাভোগ করেছেন। সেখানে তাদের সত্তা ছিল এক ও অভেদ্য। 

৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তারা দুজনই গ্রেফতার হন এবং দুজনকেই ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়। এটা বঙ্গবন্ধুর বইতেও আছে। আমার বাবার বইয়েও লেখা আছে সেই অধ্যায়। বাইরে ভাষা আন্দোলন চলছে তাঁরা জেলে। তাঁরা কীভাবে ভেতরে বসে আন্দোলন বেগবান করতে পারেন, কীভাবে মোমেনটাম দিতে পারেন, কীভাবে এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা ঘোষণা করতে পারেন, কীভাবে অনুপ্রাণিত করতে পারবেন সেসব নিয়ে চিন্তা করতেন। তারা দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন জেলে বসে হাঙ্গার স্ট্রাইক করবেন। জেলে হাঙ্গার স্ট্রাইকে তাদের দুজনেরই শারীরিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি শাষকরা ১৬ দিন পর মুক্তি দিতে বাধ্য হলো। আর আমার বাবা মুক্তি পেলেন ১৮ দিন কারাভোগের পর। নাক দিয়ে মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল এমন অবস্থায় দেখেছি বাবাকে। তাদের ওই সময়কার আন্দোলন কার্যক্রম সাধারণ জনগণের মধ্যে বড় প্রভাব ফেলে। আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক যেটা ছিল সেটা তো আছেই। আমাদের রাজনৈতিক সম্পর্কটা সবচেয়ে বড় ও মুখ্য। দেশের জন্য ও সমাজের জন্য বড় ভূমিকা রেখেছিল এই সম্পর্ক।

আলোকচিত্র: আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি

 

বঙ্গবন্ধু ও বাবা দুজন দুই ভাই

আমরা ভাই-বোনরা ছোটবেলা মনে করতাম, বঙ্গবন্ধু ও বাবা দুজন দুই ভাই। ছোটবেলা জিজ্ঞেস করলেই বাবা বলতো, দুজনে মিলে মিটিংয়ে গিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের পরিবারের অনেক স্মৃতি আছে। আমাদের বাড়িতে আসতেন, নিয়মিত যাতায়াত ছিল। হৃদয়বিদারক ঘটনার মাধ্যমে এ সম্পর্ক শারীরিকভাবে ছিন্ন হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমাদের মনে-প্রাণে মানসে, স্মৃতিতে সব সময় থাকবেন। এখনও আছেন, আজীবন থাকবেন।

শেষ সেই স্মৃতি ভোলার নয়

তাঁর সঙ্গে আমার শেষ স্মৃতি, জানুয়ারি মাসে ১৯৭৫ সালে। তখন ছবি তোলার শখ ছিল আমার। ক্যামেরা নিয়ে ঘুরতাম। পশু-পাখি থেকে শুরু করে প্রকৃতি, উচুঁ দালান সব কিছুর ছবি তুলতাম। সম্ভবত, মাসের শেষ সপ্তাহে, তখন মনসুর আলী চাচা প্রধানমন্ত্রী হলেন। সেদিন আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেকগুলো ছবি তুলেছিলাম। ওইটাই ছিল আমার প্রথম কালার রোল। তখন তো আবার রোলে ছবি তুলতে হতো। ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ লেন্স দিয়ে দেখি তিনি চা খাচ্ছেন। লেন্স দিয়েই তাঁকে দেখতে থাকি। এরপর দেখি তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। এসে গালে হাত দিয়ে বললেন, ‘অ্যা ই তুই ববি না।’ আমরা তো ওদিকে বাচ্চা হিসেবে খেলেছি। খেলে চলে এসেছি। কিন্তু তাঁর সব কিছু নজরে থাকতো। আমার নাম বলার পর আমি কিছুটা নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম। ওইদিনই আমার সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা। 

তারপর কেউ তো আমরা বুঝিনি বাংলাদেশে এরকম একটা দুর্যোগ নেমে আসবে। এরকম একটা হৃদয়বিদারক ঘটনার মাধ্যমে বাঙালি জাতি তার অবিসংবাদিত নেতাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। তিনি শারীরিকভাবে নেই। কিন্তু তাঁর কাজ রয়ে গেছে। তাঁর দর্শন রয়ে গেছে। আদর্শ রয়ে গেছে। যেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। দেশবাসী সেটাই অনুসরণ করছে। আমি বিশ্বাস করি, আমরা বাংলাদেশকে তাঁর অভিষ্ঠ লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারবো। সেটা ক্রীড়াঙ্গনেই হোক বা সামাজিকভাবে হোক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিকভাবে হোক।

‘জয়বাংলা’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ আমাদের জাতীয় জীবনের অনুপ্রেরণার অন্য নাম। 
 
লেখক:  বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক, আবাহনী লিমিটেডের কর্মকর্তা
অনুলিখন: ইয়াসিন হাসান

 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়