ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সীমাবদ্ধতা ও দূরদৃষ্টিহীনতায় ফিরে দেখা বইমেলা

আদিত্য অন্তর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৪, ১০ মার্চ ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সীমাবদ্ধতা ও দূরদৃষ্টিহীনতায় ফিরে দেখা বইমেলা

আদিত্য অন্তর, প্রকাশক

আদিত্য অন্তর : বাঙালি হিসেবে আমাদের গর্ব করার অনেক বিষয়-ই আছে। কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বে ভাষা আন্দোলন অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি, যার হাত ধরেই আমাদের গর্বিত একাত্তর, মহান স্বাধীনতা। একটা জাতিতে মত পার্থক্য খুবই সাধারণ একটি বিষয়। কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে সবাই এক। এখানে কোনো মত পার্থক্য নেই, থাকে না। আর এ কারণেই অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে মানুষের এত আগ্রহ, এত অপেক্ষা বছরজুড়ে। মানুষ স্রোতের মতো ছুটে আসে বই মেলায়। পৃথিবীর কোথাও এমন আর দেখা যায় কিনা সন্দেহ, বিশেষ করে এই মেলাকে কেন্দ্র করে যে জাতীয় আবেগের সঞ্চার হয় তা অতুলনীয় এবং অবশ্যই ব্যতিক্রম।


দীর্ঘদিন থেকে শুরু হওয়া অমর একুশে গ্রন্থমেলার অতীত এবং বর্তমান অবস্থার মধ্যে বিস্তর ফারাক। শ্রদ্ধেয় চিত্তরঞ্জন সাহা নিজ উদ্যোগে যে মেলার আয়োজন করে এ দেশের প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার এবং পাঠকের হাতে বই তুলে দেওয়ার যে ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছেন, কালের বিবর্তনে তা এই মেলার মাধ্যমে প্রসার লাভ করেছে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও বলা যায় যে, আমরা কি এই মেলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারছি? একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এই মেলা এখন আর সাধারণ কোনো মেলা না। এটা আমাদের   জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ। একুশের চেতনার সাথে মিলে একাকার হয়ে গেছে। তাই সমস্ত সীমাবদ্ধতা আর দূরদৃষ্টিহীনতা থেকে বাঙালির প্রাণের এই মেলাকে সতেজ প্রাণে বাঁচিয়ে রাখা সময়ের দাবি বলে মনে করি।


একটা সময় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সম্পূর্ণ মেলার আয়োজন করা হতো। কিন্তু স্থান সংকুলান না হওয়ায় এর প্রসার বিভিন্ন সময় বড়েছে। একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সংলগ্ন রাস্তা মেলার আওতায় নেয়া হয়। তাতেও যখন আয়োজনের সীমাবদ্ধতা দেখা দেয় তখন প্রকাশক ও বিজ্ঞমহলের পক্ষ থেকে দাবি ওঠে একটা বৃহৎ পরিসরে মেলাকে স্থানান্তরিত করার। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সাল থেকে মেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরিয়ে নেওয়া হয়। যদিও মেলার একটা অংশ বাংলা একাডেমিতেই রয়ে যায়। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়  প্রকাশক ও প্রকশনা শিল্প। দ্বি-খণ্ডিত মেলায় চরমভাবে বিভ্রান্ত হন আমাদের পাঠক ও দর্শক। আশা ছিলো, এ অবস্থা মেলা আয়োজক কর্তৃপক্ষ আমলে নিয়ে ২০১৫-তে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তরিত মেলাকে আরো প্রসারিত করে, দুই খণ্ডকে একত্র করে সবাইকে বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করবেন। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম তা হয়নি।


এই না হওয়ার সপক্ষে যে খুব জোড়ালো যুক্তি আছে এমনও মনে হয় না। তারপরও কোন ধরনের চিন্তাবোধ থেকে কিংবা কিসের স্বার্থে মেলার আয়োজক কর্তৃপক্ষ আমাদের এই যৌক্তিক বিবেচনা আমলে নিলেন না তা বোধগম্য নয়। অথচ পাঠক, প্রকাশক এবং বিজ্ঞজনেরা মনে করছেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে মেলা তার অতীত ঐতিহ্য হারাবে। প্রকাশকরা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। আর তা হলে অপূরণীয় ক্ষতি হবে এ দেশের পট্রকাশনা শিল্পের। কারণ বলতে দ্বিধা নেই এ দেশের প্রকাশনা শিল্পে এই মেলার একটি ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব মেলার একত্রীকরণ করা উচিত। এটা সময়ের দাবি।


মেলার একটা অংশকে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে ধরে রেখে শিশু কর্নার নামে চালানো হচ্ছে। কিন্তু পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে নাম না জানা মৌসুমী প্রকাশকরা সেই জায়গাটুকু দখল করে রাখছে। তাদের ভরপুর বাণিজ্যে  একাডেমি প্রাঙ্গণ মুখর। বইমেলা চলাকালীন ছুটির দিন অর্থাৎ শুক্রবার ‘শিশুপ্রহর’ ঘোষণা করা হয়। পাঠক লক্ষ্য করুন, শিশুপ্রহর কিন্তু একাডেমি এবং উদ্যান দুই জায়গাতেই। অথচ শিশুদের বইয়ের জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছে শুধু একাডেমি প্রাঙ্গণটুকু। তাহলে শিশু কর্নার নামে এই কর্নার কোন চিন্তা থেকে করা হলো এটা সাধারণ অনেক পাঠকেরই প্রশ্ন। বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্বে শতকরা ৮৮% প্রকাশক শিশুতোষ বইসহ সব ধরনের বই প্রকাশ করে। পৃথিবীর কোথাও এমন দ্বি-খণ্ডিতকরণ নেই। তাহলে আমাদের প্রাণের মেলাকে নিয়ে এমন কেন? সব ধরনের বই যে সব প্রকাশক করেন তাদের শিশুতোষ বইগুলো কি তাহলে শিশুদের নাগালের বাইরেই থেকে যাবে? এটা কি আমাদের কর্তা ব্যক্তিদের দূরদৃষ্টিহীনতা নয়? এটা কি আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা! এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার মতো মনস্তাত্বিক অবস্থা কর্তৃপক্ষের তৈরি হোক এটাই প্রত্যাশা।


মনে রাখতে হবে, একটা বড় পরিসর নিয়ে মেলার আয়োজন করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। নান্দনিকতা বলেও একটা শব্দ আছে, সেটা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।


লেখক : স্বত্বাধিকারী, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ মার্চ ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ