ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পথ রোধ করলো প্রাচীন নিদর্শন

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫০, ১৫ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৬:১৫, ১৫ জানুয়ারি ২০২১
পথ রোধ করলো প্রাচীন নিদর্শন

বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: পঞ্চম পর্ব

এরই মধ্যে হারিয়ে ফেলেছি আমার পথে পাওয়া দুই সাথীকে। দুর্গ প্রাচীরের ভেতর থেকে বেরিয়ে ধরতে হলো ফিরতি পথ। প্রাচীরের পাশ দিয়ে পথ। বেশ খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর পথ রোধ করে দাঁড়ালো আরো একটি স্থাপনা নিদর্শন। ভবনের উপরিভাগ ও চারপাশে রয়েছে দশ-পনেরটি মঠ। কারুকাজগুলো ঝরে পড়েছে অনেক আগেই। অবস্থাও নড়বড়ে, যেন জোরসে একটা ধাক্কা দিলেই ভেঙে পড়বে।

প্রতিটি মঠের চারদিকে চারটি করে মানব মুখাবয়বের প্রকাশ এখনও বিদ্যমান। মুখের ধরন অথবা আদল দেখে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা যায় তা গৌতম বুদ্ধের। জরাজীর্ণ স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ করায় আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই তা বোঝা যায় রক্ষণাবেক্ষণের সার্বিক আয়োজন দেখে। দর্শনার্থীদের জন্য কাঠ দিয়ে আলগা পথ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, যাতে পদচারণার ভারে সামন্যতম ক্ষতিটুকু না হয়। তবে আমার মনে হয়েছে, ইতিহাসের এই মহামূল্যবান উপাদানগুলোর সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণে আরও অত্যাধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

বিরতিহীন ভ্রমণে সমস্ত চেহারায় যে ক্লান্তির ছাপ পড়েছে বুঝতে পারলাম টুকটুক চালকের কথায়। সারাদিনে সে আমাকে আরও একাধিক জায়গায় দেখেছে। প্রস্তাব করে বসলো সিয়াম রেপ পর্যন্ত দুই ডলার। আমি বললাম সাইকেলের কী হবে? এক গাল হেসে বলে, ওটাও উঠিয়ে নেব। তবুও সে আমাকে যাত্রী হিসেবে পেতে চায়। তার আন্তরিকতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে যথারীতি এগিয়ে চললাম।

কেউ বলে সিয়াম রেপ পৌঁছতে এক ঘণ্টা তো, কেউ বলে দুই ঘণ্টা লেগে যাবে। অরণ্য ঘেরা পথ, উন্মুক্ত বানরের দল স্বাধীন মতো বিচরণ করছে। সাইনবোর্ডে লেখা- হরিণ পাস। কিছু দূর পর আর একটা বোর্ডে লেখা- এলিফেন্ট পাস। মনের মধ্যে রোমাঞ্চকর অনুভূতি; একাকি পথে হঠাৎ কানে ভেসে এলো গানের মিষ্টি সুর। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই সুর আমাকে পিছনে ফেলে চলে গেল। গানের উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে আবিষ্কৃত হলো, ষাট/পয়ষট্টি বছরের এক বৃদ্ধ সাইকেলের হ্যান্ডেলে রেডিও বা ক্যাসেট প্লেয়ার ঝুলিয়ে মনের আনন্দে এগিয়ে চলছে। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বেশ খানিকটা পথ তার পিছে পিছে চললাম।

যেমন প্রবেশদ্বার দিয়ে সিটির ভিতরে প্রবেশ করেছিলাম ঠিক অবিকল আর একটা দ্বার দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তার নিচ দিয়ে কৃত্রিম হ্রদ, তার পাড়ে লোকেদের সমাগম দেখে নিজেও খানিকটা বিরতি টানলাম। তৃষ্ণা নিবারণে আপাতত কাঠিওয়ালা রঙিন আইসক্রীমই ভরসা। কোনো এক স্কুলের শিক্ষার্থীরা বাস থেকে নেমেই আইসক্রীমওয়ালাকে ঘিরে ধরল। ভিড়ের মাঝ দিয়ে নিজের জন্য একটা হাতিয়ে নিলাম।

আমার মানচিত্র বলে দিলো পথ এগিয়েছে আঙ্কোর ওয়াটের সামনে দিয়ে। বিশ মিনিটের মধ্যেই মানচিত্রের নির্দেশনা সঠিক প্রমাণিত হলো। প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম ঘটেছে। হ্রদের পানিতে ভাসমান সেতু, পারাপার করছে অনেক মানুষ। সবকিছু ছাপিয়ে মন্দিরের মঠগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পর সন্ধ্যা নামবে। শেষ বিকেলের সোনালি রোদে সমস্ত এলাকায় নেমে এসেছে অপরূপ সৌন্দর্য। ঘুরে দেখানোর জন্য গাইডরা এসে বিভিন্ন রকম অফার করছে। কেউ বলছে দশ ডলার তো কেউ পনের ডলার। ভাবলাম আর একবার ঢুঁ মারলে দোষ কি?

যানবাহনের ভিড়ে আমার ছোট্ট সাইকেলখানা নিয়ে চিন্তায় পরে গেলাম। একজন গাইডের কাছে জানতে চাইলে বলল, সাইকেল রাখার কোনো নিরাপদ ব্যবস্থা নেই। তবে তাকে ভাড়া করলে রাখার একটা বন্দোবস্ত করে দেবে। পাশে দাঁড়ানো পুলিশ সদস্যকে বললে তিনি অভয় দিয়ে বললেন, গাড়িগুলোর পাশে রেখে যান, কোনো সমস্যা হবে না। ঠিক তাই, ঘুরে এসে দেখি সাইকেলটা যেখানে থাকার সেখানেই আছে। এরপর নতুন আর কোনো গন্তব্য নয়, বরং সোজা হোটেল।

বুনো পথ শেষে প্রবেশ করলাম লেকালয়ে। তবে এবার আর আগের পথ নয়, আমার মানচিত্র অন্য পথে নিয়ে যাচ্ছে। ক্রমেই কাছে চলে এলো সিয়াম রেপ শহর। হোস্টেলে না গিয়ে সোজা হাজির হলাম সেই রেস্টুরেন্টে। আগের দিনের মতো মুরগির মাংস দিয়ে পেট ভরে ভাত খেলাম। হোস্টেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ছোট্ট একটা বিশ্রামের পর কফি পান করতে বেরিয়ে পড়লাম। পাম গাছের হেলে পড়া পাতাগুলো যেন আমারই অপেক্ষায় ছিল। তাই তো এত খদ্দের থাকার পরও কেউ ওই টেবিলে বসেনি। খাবার সরবরাহকারী আমাকে ভালোভাবেই মনে রেখেছে। জনতে চাইল ভ্রমণ কেমন হলো। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ভালো লাগল। অভিজ্ঞতার টাটকা অনুভূতি কারও সাথে ভাগাভাগি করার মজাই আলাদা। ইচ্ছা হলো তাকে সামনে বসিয়ে সমস্ত অভিজ্ঞতার কথা পইপই করে বর্ণনা করি। এদিকে আমার হোটেল হ্যাংওভার কর্তৃপক্ষ কিঞ্চিৎ অভিমান করেছে, হোস্টেলের নিচে তাদের বার কাম রেস্টুরেন্ট থাকার পরও এক বেলা খেলাম না! এছাড়া একটা টুর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সিও আছে, সারাদিন টো টো করে কোথায় কোথায় ঘুরছি অথচ তাদের পানে একবার তাকানোরও ফুরসত হলো না। ভেবে দেখলাম তাদের অভিমান করার খানিকটা যৌক্তিকতা আছে কিন্ত আমার কিছুই করার ছিল না।

ঘুম থেকে দেরি করে উঠতে চাইলাম, কিন্তু দেখা গেল ভোরেই ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুমের পর বিছানায় অযথা গড়াগড়ি করা আমার পছন্দ না। পাব স্ট্রীট ধরে হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে গেলাম শহরের প্রধান বাজার। মাছ-মাংস, কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে খাদ্যসামগ্রী এবং গৃহস্থলীর নিত্য ব্যবহার্য প্রায় সমস্ত জিনিস বাজারের পণ্য। সসেজ তাদের খুব প্রিয় একটা খাদ্য। শুঁটকি মাছ আর সসেজ পট্টি অতিক্রম করে প্রবেশ করলাম বাজারের ভেতর। এরই মধ্যে কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে পুরো বাজার। প্রায় শতভাগ দোকানদার নারী। মাংস পট্টি এলাকায় শূকরের মাংসের প্রাধান্য লক্ষণীয়। মাংসের দোকানের ফাঁকে চোখে পড়ে হিজাব পরা এক নারী। তিনি মুসলমান, তার দোকানে বিক্রি হচ্ছে ভেড়ার মাংস। বাজারের একমাত্র হালাল মাংসের দোকানে স্বল্পসংখ্যক ক্রেতার আনাগোনা। এর আগে ভেবেছিলাম সিয়াম রেপ-এ মুসলমান সম্পদায়ের বসবাস নেই। এই নারীকে দেখে আমার ভাবনা ভুল প্রমাণিত হলো।

ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে গেলাম একটা কফির দোকান। এক ডলারে বিক্রি হচ্ছে মগ ভর্তি কোল্ড কফি। পানীয়ের মধ্যে কফি আমার খুব প্রিয়। তাই এক মগ কফি দিয়েই সকালের নাস্তা শুরু করলাম। কনডেন্সড মিল্কের সাথে কড়া লিকারের কফি, প্রতি চুমুকেই অনুভূত হলো চনমনে প্রশান্তি। তন্নতন্ন করে বাজার ঘুরলাম। বোধহয় একটা গলিও বাদ গেল না। কেনার মধ্যে যা কিনলাম তা হলো সামান্য কিছু অলঙ্কার। হাতির দাঁতের দৃষ্টিনন্দন সব অলঙ্কার বিক্রি হচ্ছে। সাধ্যের মধ্যে হামেশাই মিলে যায়। একটু খতিয়ে দেখা গেল হাতির দাঁতের আদলে উন্নত প্লাস্টিক। যাচাইপূর্বক নিশ্চিত হলে বিক্রেতার সাথে গোল বাধার আগেই নিরাপদে কেটে পড়লাম। ওদিকে হস্তশিল্পজাত পণ্যের দাম নাগালের মধ্যে। বিক্রেতাদের মধ্যে কোনো বিরক্তি নেই। পণ্যের দাম জিজ্ঞেস করে না নিলে মুখ ভার বা গজরগজর করার মতো বিষয়গুলোর সাথে তারা বোধহয় অপরিচিত।

শহরের চওড়া রাস্তাটা পেরিয়ে একটা কৃত্রিম হ্রদ। তার উপর দিয়ে সুন্দর সেতুটা পেরিয়ে দোকানের দীর্ঘ সারি। সমস্ত দোকানের প্রধান পণ্য উপহার সামগ্রী, যেন একটা জাদুঘর। শুধু এই বাজার ঘুরলে কম্বোডিয়ার সংস্কৃতির একটা সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাওয়া সম্ভব। এছাড়াও শহরের প্রধান সড়কের পাশ ধরে রয়েছে নানান রঙ্গের জিনিসপত্ররের বড় বড় অনেক দোকান। লম্বা সময় ধরে ঘোরাঘুরির পর ফিরে এলাম হোটেলে। এক পশলা টানা বৃষ্টির সুবাদে দীর্ঘক্ষণ ঘরে আটকে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। এরই মধ্যে লাঞ্চের সময় হয়ে এসেছে। ঠিক করলাম এবার খুঁজে বের করবো নতুন জায়গা। নতুন জায়াগার অনুসন্ধান করতে করতে সকসন রোড ধরে পৌঁছে গেলাম ছোট্ট শহর সিয়াম রেপ-এর অপর প্রান্তের এক গ্রামে।

ঠিক গ্রাম নয়, শহরতলী। তবুও মসজিদের গায়ে ইংরেজি বর্ণমালায় লেখা ‘ভিলেজ’। বানান জটিল হওয়ায় শেষ পর্যন্ত গ্রামের নামটা উচ্চারণই করতে পারলাম না। তবে মসজিদের নামটা সহজ, আল-নিরমাতুল ইসলামী মস্ক। বোঝাই যাচ্ছে এলাকাটা মুসলিম প্রধান। সংখ্যায় খুব বেশি মনে হলো না। রাস্তার ধারে মাত্র তিন-চারটা দোকান। তবে দোকানদার সকলেই নারী। এই বিষয়টা আমার খুব ভালো লাগল। কম্বোডিয়ান নারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এর মধ্যে একটা দোকানে বিক্রি হচ্ছে মাংসের কাবাব আর পাউরুটি। শিকে ঝলসানো মাংসের টুকরো লম্বাকৃতির পাউরুটির মধ্যে দিয়ে পরিবেশন। সঙ্গে শসা, পেঁয়াজ কুচি, পাকা মরিচ আর সামান্য কিছু মসলার ছিটা। নাস্তার পদ হলেও খেতে খেতে তাতে আমার লাঞ্চ হয়ে গেল। (চলবে)

* শেকড়ে ঢাকা মানুষের ইতিহাস

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়