ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ||  অগ্রহায়ণ ২২ ১৪৩০

কালের সাক্ষী শমসের গাজীর রহস্যময় সুড়ঙ্গ

মো. সাহাব উদ্দিন, ফেনী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৫, ৬ নভেম্বর ২০২৩  
কালের সাক্ষী শমসের গাজীর রহস্যময় সুড়ঙ্গ

কালের সাক্ষী হয়ে আছে ভাটির বাঘ খ্যাত বাংলার বীর শমসের গাজীর রহস্যময় সুড়ঙ্গ। যা এখনও অক্ষত। ফেনীর রহস্যঘেরা এ সুড়ঙ্গ নিয়ে হাজারো লোককথা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে। ঐতিহাসিক এ স্থানে সব সময় ভীড় করেন পর্যটকরা।

আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা তথা বর্তমান বৃহত্তর নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে জমিদারি শুরু করেন 'ভাটির বাঘ' খ্যাত শমসের গাজী। ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী চম্পকনগর ও সোনাপুর এলাকায় ছিল শমসের গাজীর রাজপ্রাসাদ ও আবাস্থল। সেখানেই তিনি তৈরি করেন রহস্যময় এ সুড়ঙ্গ। যা শমসের গাজীর সুড়ঙ্গ বলে পরিচিত।

অবিভক্ত বাংলায় তৈরি হওয়া এ সুড়ঙ্গের বর্তমানে একমুখ বাংলাদেশে, অন্যমুখ ভারত। সুড়ঙ্গ ও শমসের গাজীর ভিটা নিয়ে রয়েছে আরও অনেক উপাখ্যান। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন পর্যটকরা।

মূলত ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী চম্পকনগর ও সোনাপুর এলাকাটি শমসের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত স্থান। সেখানে রয়েছে শমসের গাজীর সুড়ঙ্গ, বাঁশের কেল্লা রিসোর্ট, দিঘিসহ নানা স্থাপনা।

স্থানীয়দের তথ্য মতে, ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী এবং ত্রিপুরার রোশনাবাদ পরগণার কৃষক বিদ্রোহের নায়ক শমসের গাজীর প্রাসাদসহ অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ ভারতের ত্রিপুরার মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে।

নবাব সিরাজদ্দৌলার পর ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে প্রথম নিহত হন ত্রিপুরা রাজ্যের শেষ স্বাধীন মুসলিম নবাব বীর শমসের। জীবনব্যাপী বহু কৃতিত্ব রয়েছে তার। মৃত্যুর আগে তিনি দুর্গ ও রাজধানী গড়ে তোলেন। প্রতিরক্ষার জন্য আধুনিক রণকৌশলে সাজান পুরো এলাকা। তার রাজকীয় বাড়ির পাশে ৪.৩৬ একর জায়গা জুড়ে দিঘি এবং একটি সুড়ঙ্গ পথ নির্মাণ করেন তিনি। সে সময় তিনি চোর ডাকাত ও জলদস্যুদের রুখতে এক শক্তিশালী বাহিনীও গড়ে তোলেন। গাজীর সুড়ঙ্গ পথটি নিয়ে রয়েছে অনেক গল্প ও নানা লোককথা।

স্থানীয় সামছুল হক নামে এক বয়োবৃদ্ধ বাসিন্দা জানান, এ সুড়ঙ্গের দিকে তাকালেই রহস্যময় অনু্ভূতির সৃষ্টি হয়। ছোট থেকে এটি নিয়ে নানা কথা শুনে আসছি। সোলায়মান হাজারী নামে এক পর্যটক বলেন, শমসের গাজী পরিবারের নারীদের জন্যই এ সুড়ঙ্গ পথটি তৈরি করা হয়েছিল বলে জনশ্রুতি আছে। এ পথ দিয়ে গাজীর পরিবারের নারী সদস্যরা গোসলে যেতেন।

সুড়ঙ্গের অদূরেই রয়েছে শমসের গাজীর একটি দিঘি; যাকে খুইল্লা দিঘিও বলা হয়। এটিকে নিয়েও রয়েছে নানা গল্প। কথিত আছে, ঢিল ছুঁড়ে কেউ কখনও দিঘি পার করতে পারেনি।

স্থানীয় প্রবীণরা বলেন, এতে অলৌকিক শক্তি আছে। যে কারণে ঢিল ছুঁড়ে দিঘি পার করা যায় না। এ প্রসঙ্গে আবদুর রহমান নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, এখানে ঘুরতে এসে প্রায় সবাই একটি পাথর নিয়ে দিঘির পশ্চিম পাশে নেওয়ার চেষ্টা করে। তবে দরবেশের দোয়ায় তাদের হাতের শক্তি কমে যায়। যার ফলে কেউ ঢিল ছুঁড়ে পার করতে পারে না।

শমসের গাজীর স্থাপনাগুলোর মধ্যে আরেকটি হল বাঁশের কেল্লা রিসোর্ট। বাঁশের নান্দনিক নির্মাণশৈলীতে গড়ে তোলা হয় এই কেল্লা। রিসোর্টটির পুরো আঙিনায় রয়েছে নানা শৈল্পিক আয়োজন, বিভিন্ন ধরনের ফল আর ফুলের বাগান। সেই বাগানের পাশের খোলা আঙিনার ধারে বাঁশের মাচা করে পার্বত্য অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি ঘরের নমুনায় নির্মিত হয়েছে স্থাপনা।

বর্তমান ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলায় জন্মগ্রহন করেন শমসের গাজী। তার পিতার নাম পীর মুহাম্মদ মতান্তরে পেয়ার মুহাম্মদ খান এবং মাতার নাম কৈয়্যারা বিবি। তিনি প্রথম জীবনে এক জমিদারের ক্রীতদাস ছিলেন। নিজের জ্ঞান, শক্তি, দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে তিনি একসময় হয়ে উঠেন জমিদার। টানা এক যুগ ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করেন এই বীর। পরে পরিচিতি লাভ করেন ভাটির বাঘ হিসেবে।

বহু যুদ্ধক্ষেত্র দাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন এই বীর। শত্রু সেনা বিনাশ করতে কখনো পিছপা হননি। তার কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ইংরেজ বেনিয়ারা। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ঐপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসন প্রতিহত করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

গাজীর বংশধর পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঞাঁ নবাবের স্মৃতি ধরে রাখতে পাঁচ একর জায়গায় বাঁশেরকেল্লা রিসোর্টটি তৈরি করেন। এর প্রতিটি আসবাবপত্রই বাঁশ দিয়ে তৈরি করা।

দর্শনার্থী ও স্থানীয়রা বলছেন, সম্ভাবনাময় এ পর্যটন স্পটকে ঘিরে যদি নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয় এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা যায় তাহলে এটির কদর বাড়বে আরও বহুগুনে।

ছাগলনাইয়ার শিল্পপতি মিজানুর রহমান মজুমদার বলেন, শমসের গাজী এবং এ স্থানের ইতিহাস নিয়ে একটি চলচ্চিত্র বানানো যেতে পারে। সুড়ঙ্গসহ অন্যান্য স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের মাধ্যমে ঐতিহ্যের স্বাক্ষর রাখা প্রয়োজন।

ছাগলনাইয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল বলেন, এ জায়গাটি ফেনীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। দারুণ সম্ভাবনাময় পর্যটন স্থান হিসেবে দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করতে এখানে আরও বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। পর্যটন কর্পোরেশনের সঙ্গে কথা বলে সে ধরনের কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

ফেনীর সদ্য সাবেক জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল-হাসান বলেন, শমসের গাজীর সুড়ঙ্গ ও দিঘির বিষয়াবলী দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার জন্য আমরা ফেনী গাইড নামে একটি প্রকাশনা করেছি। সেখানে এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও এ স্থানটিকে আরও পর্যটকবান্ধব করার পরিকল্পনা রয়েছে।

যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে স্টারলাইন পরিবহনে সরাসরি ছাগলনাইয়া। অথবা শ্যামলী, ইউনিক, সোহাগ, গ্রিন লাইন ও সৌদিয়া পরিবহনের বাসে ফেনী যেতে হবে। এছাড়াও ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে মহানগর গোধূলি ও তূর্ণা এক্সপ্রেস ট্রেনে ফেনী যেতে পারবেন। এরপর ফেনী সদর হাসপাতাল মোড় থেকে সিএনজিযোগে ছাগলনাইয়া উপজেলা হয়ে শুভপুর এলাকায় শমসের গাজীর দিঘি ও সুড়ঙ্গে যেতে হবে।

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়