ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘কাঠগড়ায়’ স্মিথ, টাইটানিকের জন্য আজও কাঁদে সাউদাম্পটন

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১২, ২ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘কাঠগড়ায়’ স্মিথ, টাইটানিকের জন্য আজও কাঁদে সাউদাম্পটন

ইয়াসিন হাসান, ইংল্যান্ড থেকে: শুনশান নীরবতা। চারদিক অন্ধকার। বিশাল বড় কাঁঠগড়া। সামনে উন্মুক্ত জায়গা। দুই পাশে দুই জায়ান্ট স্ক্রিন। কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা নেই। মাঝে ছোট্ট পোর্ডিয়াম। যেখানে গেলে দাঁড়াতে হবে আপনাকে।

‘Understanding the disaster; the Titanic inquiary’

সাউদাম্পটনের সি সিটি মিউজিয়ামের সবশেষ কামড়া সেটি। ‘টাইটানিকের জাদুঘর’ বলা হয় সি সিটি মিউজিয়ামকে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো আয়োজন আপনাকে নিয়ে যাবে শেষ শতাব্দীর শুরুর দিকে। শুরুতে মুগ্ধ করবে। মাঝে দেবে আনন্দ।  আরও ভেতরে ঢুকলে পাওয়া যাবে ভয়াবহ বৈষ্যমের চিত্র। আর শেষটা ভাঙবে হৃদয়।

২২৩৪ যাত্রী ও ক্রু নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ টাইটানিক যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন থেকে ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। কত ঐশ্বর্য ওয়াইট লাইন স্টারের তৈরি এই জাহাজ ঘিরে। ‘কখনো ডুববে না’ এমন ঘোষণা দিয়ে প্রথম সফরেই টাইটানিক ডুবে মরে। কেড়ে নেয় ১৫০৩ তাজা প্রাণ! কতো শিশু, কতো কিশোর-কিশোরী, কতো তরুণ-তরুণী ছিল। ছিল নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ। ‘ছোট্ট’ এক ভুলে শেষ হাজারো স্বপ্ন। 

জাদুঘরের শেষ কামড়ায় ২ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও দেখানো হয় বারবার। ভিডিও চিত্রে দেখানো হয় ক্যাপ্টেন অ্যাডওয়ার্ড জন স্মিথের ভুলের কথা। টাইটানিক বাঁচাতে কোনো চেষ্টাই তিনি করেননি! এমন অভিযোগে তাকে কাঁঠগড়ায় দাঁড় করান সকলে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সাউদাম্পটন থেকে ছেড়ে যাওয়ার চারদিনের মধ্যে টাইটানিকের সঙ্গে যে বরফখণ্ডের সংঘর্ষ হয়েছিল তা রুখে দেয়া যেত চাইলেই।  চারদিনে ৩৭৫ মাইল পাড়ি দেয়ার পর ১৪ এপ্রিল রাত ১১.৪০ মিনিটে সাউথ নিউফাউন্ডল্যান্ডে বরফখণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা খায় টাইটানিক। বেশ দূর থেকেই বরফখণ্ডের অস্তিত্ব টের পেয়েছিলেন স্মিথ। কিন্তু তার জাহাজ ডুববে না এমন বিশ্বাসে আরও জোরে টাইটানিক চালানো শুরু করেন তিনি। সেখানেই সব শেষ। নিচের পাঁচটি ফ্লোর সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে যায় সাগরের পানিতে! তাইতো ওই ভিডিও চিত্রের সবশেষে গাঢ় করে বলা হচ্ছে: ‘স্মিথ চাইলেই জাহাজটা ধীর গতিতে নামিয়ে আনতে পারতেন।’

সাউদাম্পটনের বন্দর থেকে ছেড়ে যায় টাইটানিক। আজও ওই জায়গায় জাহাড় ভেড়ে, জাহাজ ছাড়ে। কিন্তু টাইটানিকের আর্তনাদ কান পাতলেই শোনা যায়। সি সিটি মিউজিয়ামে ঢুকলেই পরিচয় হবে টাইটানিকে যারা ছিলেন প্রত্যেকের সঙ্গে। তাদের ছবি ও নাম আছে সেখানে। এরপর ভেতরে ঢুকলেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে! ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম জিনিসগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। স্মিথের তলোয়াড়, ঘড়ি। টাইটানিকের শেকল, ব্যবহৃত কয়লা। টাইটানিকের ভেতরের কামড়ার ছবি, ক্যাপ্টেনের ককপিট, আলিসান পার্টিং সেন্টার থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছু যত্নসহকারে রাখা জাদুঘরে। ধনী ও গরিবের বৈষম্য কতোটা ব্যাপক ছিল তা ফুটে ওঠে টাইটানিকের যাত্রায়। জেমস ক্যামেরনের নির্মাণ করা ১৯৯৮ সালের টাইটানিক ছবিতে যেমন দেখানো হয়েছিল ধনী-গরিবের বৈষম্য ঠিক তেমনই ছিল বাস্তবে। ৫টি ক্যাটাগরিতে টাইটানিকের টিকিট বিক্রি করেছিল কর্তৃপক্ষ। ধনীদের এক্সেস সব জায়গায় থাকলেও গরিবদের ছিল না। ফলে নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতরেই থাকতে হয় গরিব যাত্রীদের।  প্রথম শ্রেণির টিকিটের মূল্য ছিল জনপ্রতি ৩০ পাউন্ড। আলিশান স্যুটের মূল্য ছিল ৮৭৫ পাউন্ড। দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিটের মূল্য ছিল ১২ পাউন্ড। থার্ড ক্লাস টিকিটের মূল্য ছিল ৩-৮ পাউন্ড। এছাড়া কিছু টিকিট ছিল ২-৩ পাউন্ডের ভেতরে। শোনা যায় সেগুলো নাকি এমন জায়গায় যেখানে আলো-বাতাস কিছুই ঢুকতো না!

টাইটানিকের ভেতরে ছিল ১৫১৭ জন সাউদাম্পটনবাসী। এদের মধ্যে ক্রুও ছিল ৬৮৫ জন। তৃতীয় শ্রেণীর অধিকাংশ যাত্রী ছিল সাউদাম্পটনের। সংখ্যাটা ৪৯৪ জন। বলা হয় টাইটানিক বরফখণ্ডের সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ার পরপরপই তৃতীয় শ্রেণির বগি ডুবে যায়। সেখানে প্রাণ হারায় সকলে। এছাড়া তৃতীয় শ্রেণিতে ২৪৭ জন, প্রথম শ্রেণিতে ১৭৯ জন যাত্রী ছিলেন। ১০ এপ্রিল সাউদাম্পটনবাসীর জন্য উৎসবের। ১৪ এপ্রিল আর্তনাদের। ১৯১৪ সালে সাউদাম্পটনের অ্যান্ডুয়স পার্কে টাইটানিকে নিহতদের স্মরণে ভাস্কর্য তৈরি হয়। ১৪ এপ্রিল সেখানে জড়ো হয় হাজারো মানুষ। রাত ১১টা ৪০। ডানপাশের পেট বরাবর জায়গায় আঘাতপ্রাপ্ত হয় টাইটানিক।  এরপর মাত্র ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে সমুদ্রের ১৩ হাজার ফুট নিচে তলিয়ে যায় জাহাজটি। নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার দিয়ে জাহাজ থেকে লাইফ বোট ছাড়া হয়েছিল। ওরকম একটি জাহাজেই ছিলেন ২ মাস বয়সি মিলভিনা ডিন।  দ্য লাস্ট সারভাইবার মিলভিনা ডিন ৯৭ বছর বেঁচে ছিলেন। ২০০৯ সালে মারা যান তিনি।

‘কখনো ডুববে না’- এমন ঘোষণা দিয়ে যাত্রা শুরু করা টাইটানিক প্রথম সফরেই তলিয়ে যায়। প্রকৃতিও মেনে নেয়নি এমন ঐশ্বর্য। অবশ্য যাত্রার শুরুতেই টাইটানিকের গায়ে লেগেছিল আঁচড়। ইউএসএমএস নামের ছোট নৌকা আঘাত করে টাইটানিককে। তখনও সাবধান হননি স্মিথ। সাবধান হননি লা ব্রেনটেজ থেকে পাঠানো বার্তায়। যে রুটে টাইটানিক যাচ্ছিল, সেখানে বরফখণ্ডের সমাহর ছিল। এমন বার্তা দেয়ার পরও স্মিথ নর্থ অ্যান্টাল্টিকের রুট ব্যবহার করেন। জেদি ও একগুয়ে স্বভাবের স্মিথ এ কারণে সাউদাম্পটনবাসীর কাঁঠগড়ায়।

 

রাইজিংবিডি/ইংল্যান্ড/২ জুলাই ২০১৯/ইয়াসিন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়