ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

মুস্তাফিজকে যেমন দেখেছি

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০২, ১৯ জুন ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুস্তাফিজকে যেমন দেখেছি

মুস্তাফিজুর রহমান

উদয় হাকিম : ওয়ানডে ম্যাচে ভারতকে একাই হারিয়ে দিলেন মুস্তাফিজ। বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইন-আপকে এক হাতে গুঁড়িয়ে দিলেন তিনি। ওয়ানডে অভিষেক ম্যাচেই তুলে নিয়েছেন পাঁচ উইকেট। এই বাঁহাতি পেসারের কাটারে পর্যুদস্ত টিম ইন্ডিয়া।

 

বাংলাদেশের সমর্থকরা খুশি হয়েছেন বিশ্বকাপে হারের বদলা নেওয়ায়। কারণ, টাইগার-সমর্থকদের ধারণা, গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে জয়বঞ্চিত করা হয়েছে বাংলাদেশকে।

 

ভালো লাগা অংশটুকু দিয়ে শুরু করলেও এই লেখার প্রধান উপজীব্য ওই তরুণ পেসার মুস্তাফিজ। ১৯ বছর বয়সি ওই স্পিড স্টারের বাড়ি সাতক্ষীরায়। বছর দুয়েক হবে, ঢাকায় এসেছেন তিনি। এরই মধ্যে হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিস্ময়।

 

পাকিস্তান সিরিজের আগের কথা। তখন এনসিএল (জাতীয় ক্রিকেট লিগ) চলছিল। ওয়ালটন ছিল টুর্নামেন্ট স্পনসর। খেলা দেখার জন্য গিয়েছি ফতুল্লা স্টেডিয়ামে। সরাসরি চলে গেলাম মাঠে। আমার সঙ্গে সহকর্মী মিল্টন। মিডিয়া প্রান্ত থেকে বল করছিলেন এক তরুণ। অচেনা। লিকলিকে, গায়ের রং শ্যামলা। উচ্চতা গড়পড়তা।

 

 

প্রথম বলটা দেখেই খানিকটা চমকে উঠলাম। চমৎকার লাইন, লেন্থ। নিচু হয়ে যাচ্ছিল বল। অনেকটা ভারতের প্রাক্তন পেসার শ্রীকান্তের মতো। অফ স্টাম্পের আধা হাত বাইরে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। ব্যাটসম্যান খেলতে পারলেন না। পরের বলে হাফ বাউন্সার। পরের বলটা কাটার।

 

পুরো ওভার দেখলাম। বাঁহাতি হওয়ার কারণেই কি না, ওই বলগুলো খেলতে পারছিলেন না ব্যাটসম্যান। বলে গতিও যথেষ্ট। ডেলিভারির স্টাইলও ভালো।

 

মিল্টনকে জিজ্ঞেস করলাম, ছেলেটার নাম কী? এত ভালো বল করছে! মিল্টনও আমার সঙ্গে একমত হলেন। হ্যাঁ, খুব ভালো বল। কিন্তু নাম বলতে পারলেন না।

 

আরেকটু এগোতেই দেখা কোচ রিপন ভাইয়ের সঙ্গে। জাতীয় দলের প্রাক্তন অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমনের বড় ভাই। বললেন, ওর নাম মুস্তাফিজ। সাতক্ষীরায় বাড়ি। এনসিএলে নতুন খেলছে। আন্ডার নাইনটিন থেকে এসেছে। ভালো বল করে। খুলনার হয়ে খেলছে। উইকেটও পাচ্ছে।

 

 

আসলে ভৌগোলিক কিংবা প্রাকৃতিক কারণেই হোক, বাংলাদেশে ভালো পেসারের সংকট। এই সংকট আছে ভারতেরও। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের পেসাররা খুবই ভালো। তার পরেই বলতে হয় শ্রীলঙ্কার কথা।

 

বাংলাদেশে পেসার তৈরির সেরকম সুযোগ-সুবিধাও নেই। আবার যে কজন ভালো বল করেন, তাদের মধ্যে ইনজুরি-প্রবণতাও স্বাভাবিক কারণে বেশি। পাইপলাইনে আরো অনেক পেসার দরকার। হচ্ছে না সেটিও।

 

কিন্তু মুস্তাফিজকে দেখে আশান্বিত হলাম। মনে হলো- ছেলেটা বছর দুয়েকের মধ্যেই জাতীয় দলে চলে আসবে। ওকে আটকানো যাবে না। বললাম মিল্টনকেও। তিনিও একমত হলেন। দ্রুতই লাইমলাইটে চলে আসবে মনে হচ্ছে- মিল্টনের উত্তর।

 

কথা হলো কিউরেটর বেলাল ভাইয়ের সঙ্গে। পিচ কেমন? বললেন, বাংলাদেশের উইকেট। ওই তো স্পিন-সহায়ক। সামান্য ঘাস আছে। কিন্তু পেসারদের বল করতে হয় জোরের ওপর।

 

 

তাহলে ওই ছেলেটা যে ভালো বল করছে?

 

মুস্তাফিজ? তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বোলার। ঝটপট জবাব তার। তবে এখনো সেভাবে প্রচার পায়নি। সুনাম পায়নি। এ ধরনের উইকেটে অনেক কষ্ট করতে হয় পেসারদের। সেটাই করছে। ভালো করছে শহীদও।

 

শহীদ তখনো লাইমলাইটের বাইরে। এর আগের বছর বিসিএলে ওয়ালটনের পক্ষে ভালো খেলেছেন। শুনেছিলাম, নির্বাচকরা তার দিকে নজর রেখেছেন। দ্রুতই চলে আসবেন জাতীয় দলে। লংগার ভার্সনের জন্য ভালো বোলার। হলোও তাই। এবারের এনসিএল আর বিসিএলে নির্বাচকদের নজর কেড়ে চলে এসেছেন টেস্ট দলে।

 

লাঞ্চ ব্রেকে ড্রেসিংরুমে কথা হচ্ছিল খেলোয়াড়দের সঙ্গে। জাতীয় দলের প্রাক্তন পেসার শরিফ বললেন, হ্যাঁ, মুস্তাফিজ ভালো বল করে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, ও কাটার মারে। ওর কাটারগুলো খেলা মুশকিল। শরিফ তখন এনসিএলে ১০০ উইকেট পাওয়া বোলার। তার মুখে কথাটা শুনে বিশ্বাস না করে পারিনি।

 

ফতুল্লা থেকে ফেরার পথে আবারও মনে হলো মুস্তাফিজের কথা। ক্রিকেটের আলোচনায় আরো কয়েকবার তার কথা উঠেছে। সেসব আলোচনায় বলেছি, এরা যখন জাতীয় দলে আসবে, তখন পেস বোলিং আরো শক্তি পাবে।

 

গত পাকিস্তান সিরিজের কথা। হঠাৎ করে পত্রিকায় দেখি, টি-টোয়েন্টিতে মুস্তাফিজ ১৪ জনের দলে। অবাক হয়েছি! সেই ছেলেটা! এত তাড়াতাড়ি জাতীয় দলে! পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলার জন্য! শেষ পর্যন্ত দেখলাম একাদশেও আছে। আরো বিস্ময়ের জন্ম দিয়ে নিলেন শহিদ আফ্রিদি ও মোহাম্মদ হাফিজের উইকেট। রানও দিলেন খুব কম।
বিস্ময়ের বাকি ছিল আরো। ১৮ জুন, ২০১৫। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম দিন। ৭৯ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাক্রমশালী ভারতকে হারাল বাংলাদেশ। জয়ের নায়ক সেই তরুণ সারথি- মুস্তাফিজ। অভিষেকেই ক্রিকেট-বিশ্বকে জানান দিলেন নিজের আবির্ভাবের কথা।

 

মুস্তাফিজের মতো তরুণরা যুগে যুগে এগিয়ে নেবে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে- এই আমাদের নিরন্তর প্রত্যাশা।

 

 

নির্বাচকদের ধন্যবাদ
মুস্তাফিজকে জাতীয় দলে দেখে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব খুশি হয়েছে। মনে হয়েছে, ছেলেটা যোগ্য। ভালো করবেন। প্রতিভার স্বাক্ষর রাখবেন। কিন্তু এসব ভাবার আগে মনের গহিন থেকে ধন্যবাদ উঠে এসেছে বিসিবি নির্বাচকদের জন্য।

 

বলতে পারেন, নির্বাচকদের ধন্যবাদ কেন? তাদের কাজই তো ভালো খেলোয়াড়দের দলে জায়গা দেওয়া আর যারা খারাপ করবেন, তাদের বাদ দেওয়া।

 

কথাটা বলা যত সহজ, কাজটা ততই কঠিন। দলের প্রয়োজন বা টিম কম্বিনেশন, অধিনায়ক ও কোচের পছন্দ, পারফরম্যান্স, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয় হিসাব করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কেউ বাদ পড়লে প্রশ্ন ওঠে- কেন বাদ পড়লেন? দলে এলেও প্রশ্ন- কেন এলেন? দিতে হয় সেসবের উপযুক্ত ব্যাখ্যা। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় বাজিও ধরতে হয়। সুযোগ পাওয়া খেলোয়াড়টি ভালো পারফরম করলে সমস্যা নেই। কিন্তু খারাপ করলেই নানান প্রশ্ন।

 

ধন্যবাদ দিতে চাই এজন্য যে, মুস্তাফিজ আসলে নির্বাচকদেরই আবিষ্কার। তারা মাঠে বসে খেলা দেখেই মুস্তাফিজকে সুযোগ দিয়েছেন। সোনা চেনার মতো খাঁটি কারিগর হয়েছেন, সফল হয়েছেন। এজন্য তিন নির্বাচককে সাধুবাদ। কারণ মুস্তাফিজ তখনো অন্যদের নজরে পড়ার মতো কেউ ছিলেন না। নির্বাচকদের সঠিক সিদ্ধান্ত তাকে নিয়ে এসেছে পাদপ্রদীপের আলোয়।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জুন ২০১৫/ইয়াসিন/রফিক/কমল কর্মকার

 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়