ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

১৪২৪ বঙ্গাব্দ: ভাবো, ভাবা প্রাকটিস করো || টোকন ঠাকুর

টোকন ঠাকুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:২২, ১৫ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
১৪২৪ বঙ্গাব্দ: ভাবো, ভাবা প্রাকটিস করো || টোকন ঠাকুর

টোকন ঠাকুর, ছবি: নির্ঝর

শব্দের মধ্যেই একরকম ধারণা উপস্থিত থাকে। শব্দ শুনেই শব্দের তাপমাত্রা, শীতলতা অনুভব করা যায়।

'নদী' একটি শব্দ। আমার ধারণা 'নদী' শব্দটি উচ্চারণমাত্রই দেখা যায় এমন এক জলরেখা, যার নাম 'তিস্তা' কিংবা নাম 'নবগঙ্গা'। এবং নদী শব্দের মধ্যেই নৌকো, ক্যালেন্ডারের ছবি হয়ে থাকা বাঁশ পুঁতে রাখা জেলেদের মাছ ধরার জাল, একঝাঁক হাঁস, নদীর ওপারে গ্রাম- সব দেখা যায়।  সেই গ্রামে কারা বাস করে? সেই গ্রামের ওপারে আছে যে মাঠ, সেই মাঠ পাড়ি দিলে আরো যে-যে গ্রাম, গ্রামান্তর- সব দেখতে পাই। সন্ধেবেলায় সেই গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছেনি এখনো, এই ১৪২৪ বঙ্গাব্দেও! এখন অনেক নদীই মরে গেছে। এককালের নদীমাতৃক বাংলাদেশ আজ মরা নদীর দেশ। কিন্তু এই লেখায় নদীর আলেখ্য বলাই প্রধান উদ্দেশ্য নয়। এই আবচন শুরু হয় শব্দ-ধারণা নিয়ে। খেয়াল করার বিষয়, শব্দ আমাদের কোথায় নিয়ে যায়, কীভাবে নিয়ে যায়! শব্দ যদি 'নদী' না হয়ে শুধু 'মাছ' হতো, কী হতো? 'মাছ' শব্দ শুনলে কি মনে হয়- পুঁটি, না-ইলিশ? আমরা ইলিশ-পুঁটির বিতর্কে না গিয়ে, যদি আরেকটি শব্দের দিকে খেয়াল চালাই, যদি শব্দটি হয় 'স্বপ্ন'- কী দেখব? 'স্বপ্ন' শব্দ আমাকে কোথায় নিয়ে যায়, কীভাবে নিয়ে যায়, স্বপ্ন শব্দটি আমাকে নিয়ে যায় যদি ফিরিয়ে দেয় কি ফের? আমি কি স্বপ্ন দেখতে গিয়ে ফিরে আসি আর? যার যার স্বপ্ন, সে-ই সে-ই দেখতে থাকে, স্বপ্ন যাকে যেখানে নিয়ে যায় বা তাকে ফিরিয়ে আনে কি আনে না- সেও এ রচনায় কহতব্য নয়। তাহলে এই রচনার গন্তব্য কোথায়? শুধুই কি শব্দ-অর্থের তাৎপর্য অন্বেষণ!

তা নয়। লিখতে গিয়ে শব্দ এসে গেছে, শব্দই তো ব্রক্ষ্ম। শব্দহীন গন্তব্য হয় না। নিঃশব্দ গমন বলে কিছু নেই। যেতে উঠলেই শব্দ হয়।  যেতে চাই তাই শব্দ হয়। শব্দের ভেতর দিয়ে, শব্দের সঙ্গে যাই। যেমন, একটি শব্দের নাম চৈত্র, একটি শব্দের নাম বৈশাখ। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আরো কত শব্দ! জড়িয়ে যায় চৈত্র সংক্রান্তি, আসে পহেলা বৈশাখ। আসে নববর্ষ। বাঙালির নববর্ষ। আসে ইতিহাস, জনপদের মানুষের বেঁচে থাকা, সংস্কৃতি। শব্দ তার তাপমাত্রা ছড়িয়ে দেয়। 'বৈশাখ আসছে' বলতেই ঢাকের বাড়ি, ঢোলের বোল শুনতে পাই। 'হালখাতা' শব্দটির সঙ্গে এককালে পরিচয় ছিল আমাদের আর একালে 'পান্তা-ইলিশ' শব্দের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়েছে গণমাধ্যম। কৃষিভিত্তিক বাংলার কৃষকের উত্তরাধিকারদের কাছেই বৈশাখকে আইটেম করে বেঁচে দিচ্ছে ব্যবসায় কোম্পানি, গণমাধ্যম ব্যবসায় হয়ে উঠছে দোসর। নদীর ইলিশ, কৃষকের উৎপাদিত ধান থেকে চাল হয়ে ভাত, সেটাই পান্তা ভাত- খুব ঘটা করে খাচ্ছে নগরবাসী। এর নাম হয়ে উঠছে বৈশাখি উৎসব। উপনিবেশের হ্যাঙওভার নিয়ে যাচ্ছে বাঙালিকে। সব দেখতে পাচ্ছি।

রমনার বটমূলে ছায়ানট-এর গানে গানে বর্ষবরণ- ক্রমশ তাও আজ ইতিহাস। চারুকলার 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' আজ ইতিহাস। নাগরিক বাঙালির বাংলা নববর্ষ পালনের ইতিহাস। এতক্ষণে পরিষ্কার, লেখার গন্তব্য পহেলা বৈশাখ। লেখার বিষয় বাঙালির নববর্ষ উদযাপন। কারণ, গাছে গাছে গজানো নতুন পাতারাও আহবান করছে- এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/ ধুলো উড়িয়ে এসো/ কুলো উড়িয়ে এসো...আমার মতো ঘামতে থাকা গ্রীষ্মদিনের চড়ে থাকা রোদও, তিন রাস্তার মোড় পার হওয়ার সময় রোদ মনে মনে খুব গাচ্ছে, তিতির পাখি, তমালে কনকলতার মতো জড়িয়ে আমায় ভালোবেসো, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...

'বৈশাখ' একটি শব্দ। 'নববর্ষ' একটি শব্দ। 'বৈশাখ' বা 'নববর্ষ' উচ্চারণমাত্রই যা সামনে আসে, তার বাঙালির পরিচয় অনেকদিনের। 'বাঙালি'ও একটি শব্দ- এই বোশেখে 'বাঙালি' উচ্চারণমাত্রই চোখে পড়ে, হয়তো আমার চোখে পড়ে নদীপাড়ে বসেছে গ্রামীণ মেলা, বসেছে নাগরদোলা, মনোহরি কত কী আনন্দ সম্ভার! বাঙালি বৌদ্ধ, বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলমান, বাঙালি খ্রিষ্টান- যখন সে বাঙালি তখন বৈশাখ একান্তই তার। ধর্ম আলাদা বলে ধর্মীয় উৎসবও আলাদা, সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু বাঙালির বৈশাখ ধর্মীয় সীমানা ডিঙিয়ে এক একাকার উৎসব। বাঙালিমাত্রই বৈশাখের উত্তরাধিকার।

বৈশাখি রোদ-মেঘ-ঝড়-বৃষ্টি হিন্দু বা মুসলমান-বৌদ্ধের ধর্মীয় বিষয় নয়, বৈশাখ ঋতু প্রকৃতির বিষয়। মানুষ আদতে প্রকৃতিজাতক। তাই প্রকৃতির প্রতিই তার নিবেদন তৈরি হয়। বৈশাখ প্রকৃতিজাত একটি সময়কে নির্দেশ করছে। বোশেখের এই নির্দেশে বাঙালির ধর্মীয় পরিচয়ের বেড়াজাল বিঘ্নতা ঘটায় না। এক জাতিগত উৎসবের মিলন মেলা তৈরি হয়। পুরাতন বছরকে পার করে, পুরাতন বছরকে স্মৃতির মধ্যে গ্রহণ করে নতুন বছরকে এসময় আহ্বান করে বাঙালি, আবাহন করে বাঙালি। এভাবেই পৃথিবীর নানান জাতি বৈশিষ্ঠ্যের তালিকায় আপামর বাঙালি নববর্ষে তার স্বতন্ত্র পরিচয় ফুটিয়ে তোলে।

আর এদিকে বৈশাখি গানে ভেসে যায় জনপদ। বৈশাখি মেঘ এসে আনাগোনা করে, ঝড় তোলে। কবিতা সেই ঝড়, সেই মেঘ-বিদ্যুৎলতা ফুটিয়ে তোলে। নেচে ওঠে রোদ-ফড়িং, নাচে ঘূর্ণি হাওয়া, নাচে মন। বেঁচে থাকা ভালো লাগে। বাংলা নববর্ষ উদযাপন প্রতিষ্ঠা পায় ধীরে ধীরে, অপরাপর জাতি-বৈশিষ্ঠ্যের মানুষের কাছে। দিনে দিনে আমরাও পরিচিত হই পৃথিবীর কাছে, বাঙালি বলে। বাংলা ভাষা ছড়িয়ে পড়ে অন্য ভাষার ভেতরে। সমৃদ্ধি আসে আমাদের।

তবু খেদ রয়ে যায়। আফসোস থেকে যায়। ঠুনকো তর্ক-বিতর্কের বারান্দা-উঠোন পেরিয়ে এখনো বাঙালি নিজেকে কোথাও কোথাও ছোট করেই রাখে দেখি। তাই ধর্মীয় পরিচয়ের সীমানায় নিজের জাতিগত নববর্ষ পালন নিয়েও রক্ষণশীলতার আচরণ দেখায়। ধর্ম মানুষের আাত্মাকে মুক্তি দেবে- এটাই কথা কিন্তু ধর্মের বাণিজ্যিক ব্যবহারে সেই আত্মমুক্তির পথ বেপথে চলে যায়। মানুষ মানুষকে ভালোবাসায় জড়াবে- এই প্রবৃত্তি থেকে বেরিয়ে তখন কিছু সুবিধাবাদী মানুষ কূটকৌশলে ধর্মীয় পরিচয়ের বাতাবরণ তুলে সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করে। সেটা যেমন আগেও হয়েছে, এখনো এই ১৪২৩ শেষ করে ২৪-এ পৌঁছেই হচ্ছে! তাহলে কবির প্রশ্ন: 'কতদূর এগুলো মানুষ!'

আর অর্থনৈতিকভাবে টালমাটাল মানুষ যারা, ঠিক তারাও কি চৈত্র সংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাখ- নববর্ষ পালনে সক্ষম? আমার ধারণা, অন্তত দেশের একটা অংশের মানুষ সেভাবে বুঝতেই পারে না- উৎসব কখন আসে বা যায়! কারণ, শুধুমাত্র টাকা দিয়ে যে সমাজের মানুষ ভালো মন্দ সব কিছু বিবেচনা করে, সেই সমাজে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ খুব ক্রান্তিকাল পার করে। ভালো খাবার, ভালো পোশাক পরা, ভালো চিকিৎসা পাওয়া বা ভালো থাকা যখন তারা পায় না, তখন কোনো উৎসবও তাদের কাছে ভালোভাবে পৌঁছায় না- খেয়াল করলেই দেখা যায়। অথচ সম্মিলিত মানুষ ভালো থাকাই মানবজাতির ভালো থাকা। সম্মিলিত মানুষের হাসিই মানবজাতির হাসি, একজন মানুষের কান্নাও মানবজাতির কান্না। সেভাবেই, সম্মিলিত মানুষের উৎসবই মানবজাতির উৎসব, মানবজাতির উদযাপন। একজনও যদি উৎসবের বাইরে থাকে, সে উৎসব কি সম্পূর্ণ সফল হয়?

১৪২৪ বঙ্গাব্দে পা দিতে গিয়েও মনে পড়ে যাচ্ছে, ঋত্বিক ঘটকের সেই ভর্ৎসনা: ‘ভাবো, ভাবা প্রাকটিস করো'





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ এপ্রিল ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়