ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ফ্রান্‌ৎস কাফকা, শতাব্দী সেরা প্রভাবশালী সাহিত্যিক

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৩ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফ্রান্‌ৎস কাফকা, শতাব্দী সেরা প্রভাবশালী সাহিত্যিক

রুহুল আমিন : এক সকালে গ্রেগর সামসা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন শেষে ঘুম ভেঙে দেখতে পান যে তিনি বিছানায় একটি প্রকাণ্ড পোকায় রূপান্তরিত হয়ে আছেন। কিন্তু বেচারা তখনো ভাবছেন অফিসে যাওয়ার ট্রেনটা যেন আবার মিস না হয়ে যায়(গল্প ‘দ্য মেটামরফোসিস’ বা ‘রূপান্তর’)।

ক্ষণজন্মা ও স্বল্পায়ু সাহিত্যিক ফ্রান্‌ৎস কাফকা বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার মাঝে তৈরি করেছেন অনন্য এক সেতুবন্ধন। পরাবাস্তবতার খোলসে আচ্ছাদিত করেছেন জীবন ও শিল্পের অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতাকে। কাফকার লেখা ‘মেটামরফোসিস’ গল্পটি সাহিত্যজগতে একটি সাড়া জাগানো নাম। অনেক সাহিত্যবোদ্ধাদের ধারণা, গল্পটি যেভাবে শুরু হয়েছে গত শতাব্দী জুড়ে আর কোনো সাহিত্যকর্ম এতটা চমক জাগানিয়া বাক্য দিয়ে শুরু হতে দেখা যায়নি।

বিশ শতকের অন্যতম এ ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার অস্ট্রিয়ার কারলিংয়ে ১৯২৪ সালের এ দিনে (৩ জুন) মারা যান। এই দিনে প্রভাশালী কথাশিল্পীর প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা।

তৎকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের প্রাহা (প্রাগ) শহরের (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী) 'ওল্ড টাউন স্কয়ারে' একটি মধ্যবিত্ত জার্মান-ইহুদী জার্মানভাষী পরিবারে ১৮৮৩ সালের ৩ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন ফ্রান্‌ৎস কাফকা। তার বাবার নাম হারমেইন কাফকা। ফ্রান্‌ৎস কাফকার মায়ের নাম জুলি। হারমেইন এবং জুলির ছয়টি সন্তানের মধ্যে ফ্রান্‌ৎস কাফকা ছিলেন জ্যেষ্ঠ।

হারমেইন ও জুলি উভয়েই তাদের পারিবারিক ব্যবসায় এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে তারা দিনের প্রায় পুরোটা সময়ই ব্যস্ত থাকতেন। একারণে ফ্রান্‌ৎস কাফকার শৈশব কিছুটা একাকীত্বের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় এবং তিনি শিশুকাল হতে গৃহপরিচারিকা ও পারিবারিক সেবকদের কাছে মানুষ হয়েছেন।

১৮৮৯ সাল থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত কাফকা ডয়েচ ক্যানাবেনশুল জার্মান বয়েজ এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ালেখা করেন। ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে পড়ালেখা করার মাধ্যমে তার ইহুদী শিক্ষার ইতি ঘটে। ১৮৯৩ সালে তার বাবা তাকে একটি প্রথাগত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। সেই বিদ্যালয়ে জার্মান ভাষার মাধ্যমে পাঠদান হতো। তবে  কাফকা কথা বলা ও লিখার ক্ষেত্রে চেক ভাষা ব্যবহারে পারদর্শী ছিলেন। সেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কাফকা পুরো আট বছর অধ্যয়ন করেন এবং বেশ ভাল ফলাফল অর্জন করেন। চেক ভাষার ওপর ভাল দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে চেক ভাষায় মোটেও দক্ষ মনে করতেন না। তবে তিনি চেক ভঙ্গিতে জার্মান বলতেন। কাফকার সময়কালে প্রাগের অধিকাংশ মানুষ চেক ভাষায় কথা বলতো। চেক আর জার্মান ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে বিভাজন ছিল একটি স্পর্শকাতর বাস্তবতা। উভয় পক্ষই একই জাতীয় পরিচয়ের দাবিদার ছিল। কাফকা উভয় ভাষাতেই পারদর্শী হলেও জার্মান ভাষাকে নিজের মাতৃভাষা মেনে নিয়েছিলেন। ১৯০১ সালে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।

একই সালে কাফকা প্রাগ শহরের জার্মান চার্লস-ফার্দিন্যান্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে ভর্তি হন। কিন্তু দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই তিনি রসায়ন ছেড়ে আইন শাস্ত্রে ভর্তি হন। আইন শাস্ত্রে কাফকার আগ্রহ ছিল না। দুটি কারণে তিনি এই বিষয়ে অধ্যয়ন করার জন্য মনস্থির করেন। প্রথম কারণ আইন পেশায় যথেষ্ঠ সম্ভাবনা থাকায় তার বাবা খুশি থাকবেন। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অনেক দীর্ঘ কোর্স হওয়ায় তিনি দীর্ঘকাল ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করতে পারবেন। এ সময় তার প্রিয় বিষয় ইতিহাস, কলা ও জার্মান শিক্ষায় ছোট ছোট কোর্স করতে পারবেন।

১৯০৬ সালের ১৮ জুলাই আইনে ডক্টরেট ডিগ্রি পান তিনি। পরের এক বছর আদালতে বাধ্যতামূলক বেতনহীন কেরানির চাকরি করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষের শেষদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্র ম্যাক্স ব্রডের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। তাদের এই বন্ধুত্ব আজীবন অটুট ছিল। ব্রডকে কাফকা বলেছিলেন, মৃত্যুর পর যেন সব লেখা পুড়িয়ে ফেলা হয়। তবে ব্রড সে কথা রাখেননি। অস্তিত্ববাদী দার্শনিক সোরেন কির্য়েকেগার্ড কাফকার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেন।

তিনি দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি ও একটি বড় ব্যবসায়িক উদ্যোগে যুক্ত ছিলেন। ১৯০৭ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯০৮ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত ইতালিয়ান বীমা কোম্পানিতে কাজ করেন। কম বেতন ও লেখালেখির জন্য সময় না পাওয়া তার জন্য কষ্টের কারণ হয়ে ওঠে। এরপর সরকারি বীমা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তার কাজ ছিল কারখানার শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে আহত হলে, সে সব দুর্ঘটনার তদন্ত ও ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ। সরকারি কাজের কারণে ১৯১৫ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাকে অংশগ্রহণ করতে হয়নি। তবে ১৯১৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ দেখান। তবে যক্ষ্মার কারণে যেতে পারেননি। ১৯১৮ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে অফিস তার পেনশন মঞ্জুর করে। এরপরের ছয় বছর নানা স্যানাটোরিয়ামে (স্বাস্থ্যনিবাস) কাটে তার।

ফ্রানৎস কাফকার লেখালেখির মধ্যে রয়েছে গল্প, উপন্যাস, স্যাটায়ার, প্রবন্ধ ও চিঠি। তার সব লেখা জার্মান ভাষায় লিখিত। তবে এখানে ইংরেজি অনুবাদের নাম ব্যবহার করা হল। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয় ‘কনভারসেশন উইথ দ্য সাপ্লিকান্ট’ ও ‘কনভারসেশন উইথ দ্য ড্রাঙ্কেন ম্যান’ নামে দুটি লেখা। একই বছর বিখ্যাত বোহেমিয়া পত্রিকায় ছাপা হয় ‘দ্য এরোপ্লেন অ্যাট বেসিকা’। আর ১৯১০ সালে বোহেমিয়ায় অনেকগুলো লেখা লিখেন, যেগুলো পরে ‘মেডিটেশন’ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯১২ সালে ‘রিচার্ড অ্যান্ড স্যামুয়েল’ উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদ প্রকাশিত হয় পত্রিকায়। একই বছর ‘আমেরিকা’ উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন। লিখেন গল্প ‘দ্য জাজমেন্ট’। ১৯১৩ সালে ‘মেডিটেশন’ প্রকাশিত হয়। একই বছর লিখেন তার শ্রেষ্ঠ বড় গল্প ‘দ্য মেটামরফোসিস’। ১৯১৪ সালে ‘ইন দ্য পেনাল কলোনি’ বড় গল্পের প্রথম খসড়াটি লিখেন, লিখেন ‘দ্য জায়ান্ট মোল’। শুরু করেন ‘দ্য ট্রায়াল’ উপন্যাস। ১৯১৮ সালে লিখেন গল্প ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয় গল্প সংকলন ‘এ কান্ট্রি ডক্টর’। ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় ‘ইন দ্য পেনাল কলোনি’। ১৯২১ সালে শেষ করেন উপন্যাস ‘দ্য ক্যাসেল’। এই বছরেই প্রকাশিত হয় ‘দ্য বাকেট রাইডার’। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় ছোটগল্প ‘এ হাঙ্গার আর্টিস্ট’। ১৯২৩ সালে লিখেন ‘ইনভেস্টিগেশনস অব এ ডগ’ ‘দ্য বারোজ’ ও ‘যোসেফিন দ্য সিঙ্গার’। জীবদ্দশায় মোট সাতটি বই প্রকাশিত হয়। মৃত্যুর পরে ‘দ্য ট্রায়াল’, অসম্পূর্ণ ‘আমেরিকা’ ও ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’ প্রকাশিত হয়। ম্যাক্স ব্রডের সম্পাদনায় ১৯১০-২৩ সাল পর্যন্ত তার লেখা দিনলিপি ও ভ্রমণলিপি প্রকাশিত হয়।

কাফকা জার্মান ভাষার উপন্যাস ও ছোটগল্প লেখক হলেও বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক প্রভাবশালী লেখক হিসেবে সমালোচক কর্তৃক বিবেচিত হতেন। কাফকাকে বলা হয় বিংশ শতকের সেরা লেখক। কিংবা সেরাদের সেরা। কারণ আলবেয়ার কাম্যু, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, জে. এম. কোয়েৎজি ও জাঁ পল সার্ত্রে’র মত বিংশ ও একবিংশ শতকের সেরা লেখকরা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন তারা কাফকা দ্বারা প্রভাবিত। কাফকার লেখনী রূপক আশ্রয়ী এবং এর মাত্রা এতটাই বেশি যে তার গল্প ও উপন্যাসের অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে বের করতে গবেষকদের ঘাম ঝরাতে হয়েছে বছরের পর বছর। বলা হয়ে থাকে, শেক্সপিয়ারের পর যে লেখককে নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা ও বই লেখা হয়েছে তিনি কাফকা। এ পর্যন্ত নোবেল বিজয়ী ১০৯ জন লেখকের মধ্যে ৩২ জনই তাদের লেখায় কাফকার সরাসরি প্রভাব আছে বলে স্বীকার করেছেন। কাফকা অস্তিত্ববাদ তত্ত্বকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। তার অধিকাংশ কাজগুলোর বিষয়বস্তু এবং আদর্শিক দিক মূলত বিচ্ছিন্নতাবোধ,শারীরিক এবং মানসিক নিষ্ঠুরতা, অভিভাবক-সন্তান সম্পর্কের সংঘর্ষ, আতঙ্কজনক উদ্দেশ্য চরিতার্থে ব্যস্ত এমন চরিত্র, মানবজীবনে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ এবং রহস্যময় রূপান্তর - এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।




রাইজিংবিডি/৩ জুন ২০১৭/রুহুল/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়