ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বাড়ি বদলালেন দরবারী রমাপদ চৌধুরী

কমলেশ রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ৩১ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাড়ি বদলালেন দরবারী রমাপদ চৌধুরী

রমাপদ চৌধুরী

কমলেশ রায়

অনেক দিক দিয়েই তিনি ছিলেন আলাদা। আর পাঁচজনের থেকে স্বতন্ত্র। একবারে ব্যতিক্রম। তরুণ বয়সেই পেয়েছিলেন আকাশ-ছোঁয়া পাঠকপ্রিয়তা। তখন প্রকাশকগণ প্রতিষ্ঠিত লেখকদের ছোটগল্প সংকলন ছাপতে সাহস করতেন না। অথচ তাঁর বিখ্যাত গল্পের বই ‘দরবারী’র এগারো মাসে তিনটে সংস্করণ হয়েছিল। তিনি প্রকাশনা জগতের সব হিসাব উল্টে দিয়েছিলেন। তবে লেখার ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ অলস। নির্মেদ, ঋজু চেহারা। পরনের পোশাকও ছিল সাদাসিধে। ধুতি, পাঞ্জাবি আর কোলপুরি চটি। সভাসমিতি এড়িয়ে চলতেন। অনেক বার বিদেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছেন, এবং পত্রপাঠ প্রত্যাখান করে দিয়েছেন। বাইরে ছিল কঠিন আবরণের আড়াল, কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলে ছিলেন আড্ডাবাজ, অত্যন্ত রসিক মানুষ। বরাবরই তাঁর পাঠকপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। এক প্রকাশক তো তাকে গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। সেই সময়ে বাঙালি লেখকদের জন্য যা ছিল বিরল ঘটনা।

সেই ব্যতিক্রমী কথাকার রমাপদ চৌধুরী আর আমাদের মাঝে নেই। অনন্ত পরলোকের পথে যাত্রা করেছেন তিনি। জাগতিক বাড়ি তিনি বদল করে নিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিক রোগে ভুগছিলেন। গত ২০ জুলাই শ্বাসকষ্টে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে কলকাতার বেলভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়। গত ২৯ জুলাই রোববার সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। তিনি স্ত্রী সুষমা চৌধুরী, দুই মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ৩০ জুলাই সোমবার দুপুরে কেওড়াতলা শ্মশানে সম্পন্ন হয় তাঁর শেষকৃত্য।

রমাপদ চৌধুরীর জন্ম রেলের শহর খড়গপুরে, ১৯২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর। সেখানে স্কুলের পাঠ শেষে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাশ করেন। তরুণ লেখক হিসেবে তখনই তাঁর বেশ নামডাক। তখনকার নামকরা পত্রিকা ‘ইদানিং’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন তিনি। এই ‘ইদানিং’ পর্ব ছিল ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯৫৩ সালে তিনি যোগ দেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য়। সহযোগী সম্পাদক হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন ওই পত্রিকার ‘রবিবাসরীয়’ সম্পাদনা করেছেন। ‘আনন্দমেলা’র প্রথম চার সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন তিনি। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘প্রথম প্রহর’ (১৯৫৪)। তাঁর শেষ লেখা প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে, আত্মজীবনীমূলক ‘হারানো খাতা’। ১৯৬০ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস ‘বনপলাশীর পদাবলী’। সেই কাহিনী নিয়ে পরে ১৯৭৩ সালে সিনেমা নির্মাণ করেন উত্তমকুমার, যাতে অভিনয়ও করেন এই মহানায়ক। মৃনাল সেন সিনেমা বানিয়েছেন তাঁর ‘খারিজ’ উপন্যাস নিয়ে (১৯৮২)। আর ‘অভিমুন্য’ নিয়ে প্রশংসিত ছবি ‘এক ডক্টর কি মওত’ তৈরি করেন তপন সিংহ। এছাড়াও তাঁর অনেক উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। এর মধ্যে বীজ, এখনই, পিকনিক, দ্বীপের নাম টিয়ারং উল্লেখযোগ্য।

রমাপদ চৌধুরী চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি রেখে গেছেন অসামান্য সব ছোটগল্প ও উপন্যাস। ‘ভারতবর্ষ’-এর মতো তাঁর অনেক ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে মাইলফলক হয়ে থাকবে। ১৯৮৮ সালে তিনি সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান ‘বাড়ি বদলে যায়’ উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও তিনি পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৭১), আনন্দ পুরস্কার (১৯৬৩), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মারক আন্তর্জাতিক পুরস্কার (২০১১), শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার, সাম্মানিক ডি লিট। ইংরেজি, হিন্দিসহ বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর রচনা।

তিনি ছিলেন আগ্রাসী পাঠক। যে বইই হাতে পেতেন, পড়ে ফেলতেন। এই অভ্যাসটা তিনি পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকে। ইংরেজ আমলে নিষিদ্ধ বই ‘পথের দাবি’ পড়ার জন্য, সেই আমলে একশ টাকা খরচ করে দুদিনের জন্য বইটি ভাড়ায় এনে বাবা-ছেলে মিলে পড়ে শেষ করেছিলেন!
প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময়ে মূলত লেখালেখি শুরু করেন রমাপদ চৌধুরী। দুই সহপাঠী প্রাণতোষ ঘটক ও স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে পা-ুলিপি পড়তে দিতেন মতামত নেওয়ার জন্য। একদিন তারাই বললেন, তোমাকেও লিখতে হবে। এরপর একটি চায়ের দেকোনে বসে লেখা তাঁর প্রথম গল্প বন্ধু স্বরাজ নিয়ে যান। এবং পরে সেটা তখনকার নামী একটি পত্রিকায় প্রকাশ পায়।
রমাপদ চৌধুরীর গল্প সমগ্রের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে। প্রতিটি সংস্করণে তিনি এতে নতুন গল্প যোগ করতেন। গল্প সমগ্রের সর্বশেষ সংস্করণে এখন গল্প সংখ্যা ১৪৪টি। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ৫০টির মতো। লেখা বন্ধের ঘোষণার আগে বছর তিরিশের মতো তিনি শুধু শারদীয় ‘দেশ’ বা ‘আনন্দবাজার’-এ একটি করে উপন্যাস লিখতেন। সারা বছর আর কিছুই লিখতেন না, এতই আয়েশি লেখক ছিলেন তিনি। বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে ‘সমগ্র’ ধারণাটা কিন্তু রমাপদ চৌধুরীর অবদান। তাঁর গল্প সমগ্রের ‘পূর্বকথা’তেই এর উল্লেখ আছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘গল্প সমগ্র, উপন্যাস সমগ্র, কবিতা সমগ্র নামগুলি এখন প্রচলিত। কিন্তু আমার গল্প সমগ্র প্রকাশিত হবার আগে চলিত ছিল না।’

রমাপদ চৌধুরীর রসবোধ ছিল প্রবল। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে সেটার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে। তিনি লিখেছেন, ‘মনে আছে একবার তাঁকে কালী পুজো ‘ওপেন’ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে এসেছিল কয়েক জন। রমাপদ বাবু একটু হেসে বললেন, মা কালীর তো সবই ওপেন, আর ওপেন করার কী আছে !’
ব্যক্তি রমাপদ চৌধুরীর খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায় আরেক সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের লেখা থেকে। অগ্রজ লেখকের প্রথম দিনের ব্যবহারে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘আপাত রুক্ষ স্বভাবের আড়ালে আসল রমাপদ চৌধুরী একেবারে অন্যরকম। ঠিক যেন নারকোলের স্বভাব। সহজে যার ভিতরে ঢোকা যায় না। কিন্তু একবার ঢুকতে পারলেই শাঁসজলের অফুরান সন্ধান। ১৯৬৭-তে প্রথম বার ‘দেশ’ পত্রিকায় আসার পরে ওঁর কাছাকাছি আসতে পেরেছিলাম সেই ১৯৭৮-এ। সেই প্রথম সাক্ষাতের পরে আমি ওঁকে এড়িয়েই চলতাম। এক দিন আনন্দবাজারে ঢোকার মুখে দেখা হতেই হঠাৎ ফস করে বললেন, একটা লেখা দেবেন তো! দাঁড়ালেন না, তাকালেন না, নাম ধরেও ডাকলেন না। ¯্রফে লেখাটা দিতে বলেই চলে গেলেন। পরে ওঁর খানিকটা কাছাকাছি যখন এসেছি, তখন অনুযোগও করেছি, এই রুক্ষ হাবভাব নিয়ে। উনি নির্বিকার! ‘আমার স্বভাব!’ তখন কিন্তু অফিসে দেখা হলেই হাঁক দিতেন, বিকেলে মুড়ি খেয়ে যাবে!’

জ্যোতিষশাস্ত্রে রমাপদ চৌধুরীর ছিল ভীষণ কৌতূহল। এক সময়ে বেশ চর্চা করতেন। কিন্তু মোটেও বিশ্বাস করতেন না। এই বিষয়ে তাঁর ভাষ্য হলো, ‘ধুস। বিশ্বাস করি কি করে। হিরোশিমায় অ্যাটম পড়ে যে এতগুলো লোক মারা গেল তাদের যে সকলের কোষ্ঠীতে ওই সময়ে মৃত্যুযোগ ছিল এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?’
নিজের লেখার ব্যাপারে রমাপদ চৌধুরী ছিলেন ভীষণ খুঁতখুঁতে। আর বইয়ের ব্যাপারে ছিলেন খুবই সতর্ক। বইয়ের মার্কেটিং নিয়েও সচেতন ছিলেন তিনি। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক রচনা ‘পিওন থেকে প্রকাশক’-এ তাঁর সেই পরিচয়  তুলে ধরেছেন  বাদল বসু। তাকে যে চিঠিটি লেখক লিখেছিলেন, সেটি এখানেও তুলে ধরা যাক। ‘বাদলবাবু, আপনাদের স্টলে গিয়ে কাল অনেক কষ্টে আমার বইগুলির দর্শন পেলাম। এক কোণায় সর্বনিম্নের তাকে রাখা হয়েছে। গল্প-সমগ্র বইটি আবার সেই তাকের এক কোণায়। অতবড় বইও মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা যাবে না। অন্য বইগুলির সম্পর্কে আমার কোনও আগ্রহ নেই। গল্প-সমগ্র এবং ‘বনপলাশির পদাবলী’কে একটু উচ্চাসন দিলে বই বিক্রি হোক বা না হোক কিছু প্রচার হয়। যাক। এবার তো বইমেলা শেষ হয়ে গেল। পরের বার যেন একটু দর্শনীয় করে এ-বই দু’টি রাখা হয়। রমাপদ চৌধুরী। ২১.৩.৮০।’

রমাপদ চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘আমি তাঁর আত্মীয় পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।’ তাঁর মৃত্যুতে সাহিত্যাঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। কবি জয় গোস্বামী বলেন, ‘রমাপদ চৌধুরীর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।’ সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘রমাদা চলে যাওয়া মানে অনেক স্মৃতির বিদায়।’
‘বইয়ের দেশ’-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে। এই সংখ্যায় রমাপদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। এই সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে তিনি আর না লেখার বিষয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেন। রমাপদ চৌধুরী বলেন, ‘লিখে আর কী হবে ? মনে হচ্ছে এই কেবল লিখে যাওয়ার কোনও মানে নেই। অনেক তো লিখেছি। এদেশে গান ভাল লাগলে তো কেউ হাততালি দেয় না, হাততালি দেয় গান থামানোর জন্য।’ কী রূঢ় সত্য উচ্চারণ ! তিনি অনেক সময় বলতেন, একটা বয়স পরে লেখকেরও অবসর নেওয়া উচিত। আসলেই তো একটা সময় পরে থামতে জানতে হয়। লেখা থামিয়ে দিয়েছিলেন আগেই। আর বাস্তবে একটুর জন্য সেঞ্চুরিটা হলো না। ইস ! আর মাত্র চারটে রান। সরি, চারটে বছর ! একটা আফসোস তো থেকেই যায়।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়