ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

জুলেখা এখন আলোর পথ দেখার অপেক্ষায়

রেজাউল করিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩১, ২৭ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জুলেখা এখন আলোর পথ দেখার অপেক্ষায়

থানা হাজতে জুলেখা

রেজাউল করিম, চট্টগ্রাম : আলোয় ফিরতে চান বন্দরনগরী চট্টগ্রামের  মাদক সম্রাজ্ঞী জুলেখা।৫৮ বছর বয়সী এই মাদক সম্রাজ্ঞী অসংখ্যবার গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং জেলও খেটেছেন।

সর্বশেষ গত বুধবার আবারও চোলাই মদসহ গ্রেপ্তার হন জুলেখা। গ্রেপ্তারের পর জুলেখা পুলিশকে জানিয়েছে এবার সে এই নষ্ট অধ্যায়ের ইতি ঘটাতে চায়। ফিরে আসতে চায় আলোয় ।

রটনা রয়েছে, জুলেখার বাসায় অতিথিদেরও নাকি আপ্যায়ন করা হয় চোলাই মদ দিয়ে! লোকে বলে, তার বাসায় পানির জগেও মদ মেলে। চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার বার্মা কলোনিতে তার বসবাস। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ২১টি মামলার রেকর্ড।

বায়েজিদ বোস্তামি থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মহসিন জানান, চট্টগ্রামে জুলেখা এমন একটি নাম যার গ্রেপ্তার আর মামলা স্বাভাবিক বিষয়। তার বিরূদ্ধে মাদক মামলাই আছে ২১ টি। রাঙামাটি, বান্দরবান থেকে শুরু করে সিএমপির প্রায় প্রতিটি থানার হাজতে থাকার অভিজ্ঞতা আছে তার। জেলে গেছেন ৩০ বারের বেশি। চারটি মামলার রায়ে সাজাও ভোগ করেছেন। প্রতিমাসে কমপক্ষে তিনবার জুলেখাকে আদালতে হাজিরা দিতে হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আজ বৃহস্পতিবার  তাকে আদালতে তোলা হবে।

বায়েজিদ থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন জানান, জুলেখার মাদক সম্রাজ্ঞী হয়ে ওঠার কাহিনী একটু অন্যরকমই। ভরা যৌবনে জুলেখার বিয়ে হয় এক রোহিঙ্গার সাথে। নাম আলী। সারাদিন ঘরে শুয়ে বসেই দিন কাটাত সে। আর মানুষের বাসা বাড়িতে ঝি এর কাজ করে সংসার চালাত জুলেখা। এভাবে তিন চার বছর কাটার পর তাকে তালাক দেয় জুলেখা। বিয়ে করে গোফরান নামে আরেকজনকে। চরিত্রে কোন তফাৎ ছিল না গোফরান ও আলীর মধ্যে। বেকার সেও। সংসারের ঘানি টানতো সেই জুলেখা। শেষ পর্যন্ত গোফরানকেও তালাক দেয় । কিন্তু অকর্মণ্য এই দুই স্বামী জুলেখার কাঁধে তুলে দিয়ে যায় দুই ছেলে ও চার মেয়ের বোঝা। রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের সাথে দিনের বেলা সাতটি মুখে খাবার তুলে দিতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছিল জুলেখা। ঠিক সেই সময়ই সাহায্যে এগিয়ে আসে রহিমা (বায়েজিদ এলাকার এই মাদক সম্রাজ্ঞী দুই দিন আগে থানায় আত্মসমর্পণ করে)।

রহিমা তাকে প্রস্তাব দেয়, রাঙামাটি থেকে চার সেলাইন চোলাই মদ আসবে। এগুলো পার করে দিলে প্রতি সেলাইনে সে একশ টাকা করে পাবে। প্রথম চালানে সে সফল হয়। পায় ৪০০ টাকা। এভাবে সে সপ্তাহের পাঁচদিন মানুষের বাসায় কাজ করে আর বাকি দুইদিন রহিমার কাজ করে ভালই সংসার চালাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন একটি চালান আনতে গিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয় জুলেখা। রহিমার কাছ থেকে ধার নিয়ে কোনমতে জামিন নেয় সে। এরপর অনেকের কাছে গিয়ে রহিমার কাছ থেকে ধার করা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য ধার চায়। কিন্তু সবাই তাকে ফিরিয়ে দেয়। শেষে রহিমার সাথে চুক্তি হয় পাওনা টাকার বিনিময়ে তার মদের সেলাইন চালান করে দেবে সে। পাওনা মেটানোর পর আর থাকবে না এই পথে। কিন্তু আবারও আটক হয় জুলেখা। আবারও সেই একই প্রক্রিয়ায় জামিন। আবারও সেই দ্বারে দ্বারে ঘুরে ফিরে আসা এবং সেই পুরনো পথে ফিরে যাওয়া। এভাবে আটক হতে হতে এক পর্যায়ে নিজেই এই ব্যবসায় নেমে পড়ে সে। একে একে ২১ মামলার আসামী এখন জুলেখা।

জীবনের প্রতি বিরক্ত জুলেখা অনেকটা অভিমান নিয়েই পুলিশকে বললেন, ‘স্যার, এই পেশাকে আমি ঘৃণা করি। তাই আমি আমার মেয়েদের আমার কাছে রাখি না। এই পেশাতে আছি বাধ্য হয়েই। প্রতি মাসে আমার মামলা বাবদ প্রয়োজন হয় ৮ হাজার টাকা। জামিন নিতে লাগে ২৫ থেকে ৪০ হাজার। এত টাকা আমি কোথায় পাব।’

পুলিশের প্রতি আকুতি জানিয়ে জুলেখা বলেন, ‘আমাকে তো কেউ ভাল হওয়ারই সুযোগই দিচ্ছে না।  আমার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করেন।’

বায়েজিদ বোস্তামি থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মহসিন জুলেখার আকুতির কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘জীবন জীবনের নিয়মেই চলবে। আইনও চলবে তার নিজস্ব গতিতে। জুলেখাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে মাদকের নতুন মামলায়।  বৃহস্পতিবার দুপুরে তাকে আদালতে তোলা হবে। হতে পারে এটাই তার নতুন জীবনের প্রথম সূর্যোদয়। হতে পারে আরও গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার নতুন একটি প্রয়াস।’

ওসি বলেন, ‘আমি জুলেখাকে আশ্বাস দিয়েছি আলোর পথ দেখাব বলে। থানা হাজতের প্রকোষ্ঠের ভেতর জুলেখা এখন আলোর পথ দেখার অপেক্ষায়।’



রাইজিংবিডি/চট্টগ্রাম/২৭ জুলাই ২০১৭/রেজাউল করিম/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ