ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ তার ক্যামেরায় হয়েছে ইতিহাস

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৩, ২৫ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ তার ক্যামেরায় হয়েছে ইতিহাস

গণ অভ্যুত্থানের এই ছবি তুলে অমর হয়ে আছেন রশীদ তালুকদার। ইনসেটে এই চিত্রশিল্পী

হাসান মাহামুদ: কথায় বলে, ‘একটা ছবি হাজার শব্দের কথা বলে’। ছবি একটি স্থির সময়ের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই ছবিই হয়ে ওঠে ইতিহাস। যখন একজন দক্ষ কারিগর কোনো একটা সময়কে, মানুষের অভিব্যক্তিকে শিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ও পরে দেশের প্রথিতযশা আলোকচিত্র শিল্পী রশিদ তালুকদার নিজ হাতে ধারণ করেছেন অনেক ছবি যা আমাদের ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ।

যুদ্ধ সাংবাদিকদের কলম যুদ্ধের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব নিয়ে লড়ে যান ক্যামেরা যোদ্ধারাও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালের সফল ক্যামেরা যোদ্ধা রশিদ তালুকদার। তার ক্যামেরায় বন্দী হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বহু সাক্ষী-প্রমাণ। এদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠলেই রশিদ তালুকদারের নাম উঠে আসে সবার আগে। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছবি তুলেছেন শুধু দেশের জন্য।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধপরবর্তী হাহাকার, আহাজারি, কান্না, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, মানবিক অনুভূতি, নারী আন্দোলন, ইত্যাদি নানা বিষয়ে তিনি তার ক্যামেরার মাধ্যমে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। তার ছবি বর্ণনা করেছে নির্যাতিতদের অব্যক্ত কথা। মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে জাগ্রত করেছেন তিনি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিত্রগুলোই তার হাতে তোলা। সেসব ছবিতেই আমরা মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন দৃশ্য দেখি। তার তোলা ছবি দেশ-বিদেশের অনেকের কাছে পরিচিত। তার ক্যামেরায় তোলা আছে বিভিন্ন মুহূর্তের অনেক বিরল ছবি। তার সেসব বিখ্যাত, বহুল প্রচারিত ও মুদ্রিত ছবি ইতিহাসের সত্যতাকে ধারণ করছে যুগ যুগ ধরে।

আলোকচিত্র শিল্পী রশীদ তালুকদার ১৯৩৯ সালের ২৪শে অক্টোবর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের চব্বিশ পরগণায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আবদুল করিম তালুকদার ছিলেন চাকরিজীবি এবং মা রহিমা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। বাবা স্টেশন মাস্টার হওয়ায় পৈত্রিক ভিটা মাদারীপুরের কালকীনি থানার দক্ষিণ রমজানপুর গ্রামে হলেও তার জন্ম চব্বিশ পরগণায়। ১৯৫৭ সালে তার বাবা আবার বদলী হয়ে খুলনা থেকে রাজশাহী চলে আসেন।

পড়াশুনার পাট চুকিয়ে পেশা হিসেবে ফটো সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছিলেন রশীদ তালুকদার। কর্মজীবনে ১৯৫৯ সালে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে পিআইডি বা প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টে ৮০ টাকা বেতনে যোগ দেন। এর পর ১৯৬২ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ফটো সাংবাদিক বা আলোকচিত্রী হিসেবে যোগদান করেন। ফটো সাংবাদিক হিসেবে তাঁকে জীবনের প্রথম অ্যাসাইনমেন্টটি দিয়েছিলেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি শহীদুল্লাহ কায়সার।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিশে যান তিনি। ক্যামেরা হাতে ধারণ করেন যুদ্ধের সময়ের নানা ছবি। নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন বীরসেনাদের। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে রশীদ তালুকদার দৈনিক সংবাদ থেকে চলে এসে যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়। সেখানে তাঁর সহকর্মী হিসেবে ছিলেন ইত্তেফাকের সাবেক সম্পাদক রাহাত খান। দৈনিক ইত্তেফাকে তিনি একাধারে ২৯ বছর চাকরি করে ২০০৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, রশীদ তালুকদার ছিলেন বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

বীর বাঙালীদের স্বাধিকারের দাবিতে স্বাধীনতা-পূর্ব ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের স্থিরচিত্র ধারণ করে নিজেকে স্মরণীয় করে রেখেছেন রশীদ তালুকদার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণ-অভ্যুত্থানের স্থির চিত্র হিসেবে মিছিলের সম্মুখভাগে টোকাই বা পথশিশুর ছবি তুলে সকলের নজর কাড়েন তিনি।

ছাত্রদের অসহযোগ আন্দোলনে শহীদ আসাদের মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন রশীদ তালুকদার। তার ক্যামেরায় স্থিরচিত্র হিসেবে ফুঁটে উঠেছিল ছাত্র-জনতার দীর্ঘ মিছিলসহ আসাদের শার্টের ছবি। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের অসহযোগ আন্দোলনকেও ক্যামেরায় ধারণ করেন রশীদ তালুকদার। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে বুদ্ধিজীবীদের লাশ উত্তোলনের ছবিও তিনিই ধারণ করেন।

বাংলাদেশের বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে তার আলোকচিত্র। রশিদ তালুকদারের বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশে আসা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মাদার তেরেসার ছবি, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম, বুদ্ধিজীবিদের লাশ উত্তোলনের স্থিরচিত্র।

আলোক চিত্রকলায় অসামান্য অবদানের জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে স্বর্ণপদকসহ প্রায় ৭৭টি পুরস্কার লাভ করেন রশীদ তালুকদার। এর মধ্যে ২০০৬ সালে তাকে ‘ছবি মেলা আজীবন সম্মাননা পুরস্কার’, ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অলাভজনক বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি'র পক্ষ থেকে ‘পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড’, জাতিসংঘ কর্তৃক ‘নিরাশ্রয়ের জন্য আশ্রয়’ শীর্ষক প্রতিযোগিতায় একত্রে ছয়টি পুরস্কার এবং জাপান ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ও আশাহি শিমবুন পত্রিকার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় পরপর দুইবার পুরস্কৃত হওয়া অন্যতম।

রশীদ তালুকদারের ডাক নাম কাঞ্চন এবং সহকর্মীদের কাছে তিনি ‘রশীদ ভাই’ নামে পরিচিত ছিলেন। যৌবনে রাজশাহীতে পরিচিত ছিলেন ‘প্রিন্স রশীদ’ নামে। বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এই আলোকচিত্র শিল্পীর আজ ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১১ সালের আজকের দিনে (২৫ অক্টোবর) ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে তিনি মারা যান। প্রথিতযশা আলোকচিত্রশিল্পী রশীদ তালুকদারের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ অক্টোবর ২০১৭/হাসান/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়