ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ডাইনোসরের পথে চেনা-জানা বহুপ্রাণী

শায়েখ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩২, ১৪ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ডাইনোসরের পথে চেনা-জানা বহুপ্রাণী

শায়েখ হাসান : মনুষ্যসৃষ্ট কারণ, প্রতিকূল পরিবেশসহ নানাবিধ কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছে, শিগগিরই পৃথিবী থেকে মুছে যাবে হাজার প্রজাতির প্রাণী।

পৃথিবীতে যেভাবে প্রাণীর সংখ্যা ব্যাপক হারে কমছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে জীবজগতের আরো একটি গণবিলুপ্তি অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে ১৪ প্রজাতির প্রাণী এবং ৩০ প্রজাতির পাখি।

প্রাণী বিজ্ঞানীরা প্রাণীকুলের এই মহাদুর্যোগের নাম দিয়েছেন, ‘সিক্সথ মেস এক্সটিঙ্কশান এরা অব বায়োলজিক্যাল এনিহিলেশান’ বা ‘ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি’। নিউইয়র্কের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের একটি গবেষণায় সম্প্রতি এমন তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত পাঁচটি গণবিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে আমরা ষষ্ঠ বিলুপ্তির পথে হাঁটছি বলে দাবি করা হয়েছে ওই গবেষণাপত্রে। তবে এর মধ্যে পার্থক্য হলো, এর আগের পাঁচটি গণবিলুপ্তি প্রাকৃতিক কারণে ঘটেছিল, এবারের গণবিলুপ্তি সত্যিই ঘটলে, তা হবে মানুষের তৈরি কারণে।

এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যেভাবে বন্যপ্রাণীদের বসবাসের জায়গা দখল করে নিচ্ছে মানুষ এবং যেভাবে দূষণের মাত্রা বাড়ছে, তাতে জীবজগতের গণবিলুপ্তি সময়ের  অপেক্ষা বলে মনে করা হচ্ছে।

গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, স্তন্যপায়ী, পাখি ও সরীসৃপদের বসবাসের ৩০ শতাংশ জায়গা দখল করে নিয়েছে মানুষ। তারা বলছেন, বিলুপ্তির পথে পৃথিবীর হাজারের ওপর প্রজাতি। ছোট্ট চড়ুই পাখি থেকে রাজকীয় জিরাফ, শিগগিরই হারিয়ে যাবে এরকম বহু প্রাণী। ঠিক যেভাবে গণবিলুপ্তি ঘটেছিল ডাইনোসরদের, সেভাবেই পৃথিবী থেকে মুছে যাবে আমাদের চেনাজানা বহু প্রাণী।

সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো, স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংখ্যা কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। যেসব প্রাণীকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে চিতা, আফ্রিকান সিংহ, প্যাঙ্গোলিন এবং জিরাফ। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, গত ১০০ বছরে অন্তত ২০০টি প্রজাতির প্রাণী ইতিমধ্যেই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। এখনই সতর্ক না হলে ডাইনোসরদের মতোই এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে চিতা, সিংহ, জিরাফও।

বন বিভাগের তথ্যমতে, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ১৪টি প্রাণীর প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ডোরাকাটা হায়েনা, গ্রে উল্ফ (ধূসর নেকড়ে), বারাশিঙা বা কাদা হরিণ, ব্ল্যাকবাক (হরিণ জাতীয়), নীলগাই, গাওর, বানটেং (এক ধরনের বুনো মোষ), বন্য জলমহিষ, সুমাত্রান গণ্ডার, জাভান গণ্ডার, ভারতীয় গণ্ডার, দেশি ময়ূর, পিঙ্ক হেডেড ডাক (পাখি) ও মিঠা পানির কুমির।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বাংলাদেশের পাখির তালিকায় মোট ৭৪৪টি পাখি অন্তর্ভুক্ত। এসব পাখির মধ্যে গত দুই শতকে বাংলাদেশে ছিল এবং বর্তমানে আছে এমন পাখিও অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে ১৯৪টি পাখি বর্তমানে টিকে আছে।

৩০ প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে বর্তমানে বিলুপ্ত। এর মধ্যে ২৯টি অন্য দেশে পাওয়া গেলেও ‘গোলাপীশির হাঁস’ পৃথিবী থেকেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। ৬২০টি প্রজাতির পাখি অতীতে বাংলাদেশে দেখা গিয়েছিল। এর মধ্যে ১৪৩টি প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে ‘অনিয়মিত’ আখ্যায়িত হয়েছে। কারণ কালেভদ্রে এদের দেখা যায়। বাকি ৪৭৭ প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে নিয়মিত দেখা যায় বলে সরকারিভাবে মনে করা হয়। যদিও পাখি বিশেষজ্ঞরা এই সংখ্যার সঙ্গে দ্বিমত করেন।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, এই ৪৭৭ প্রজাতির মধ্যে ৩০১টি বাংলাদেশের ‘আবাসিক’ পাখি চিহ্নিত। এসব পাখি স্থায়ীভাবে এ দেশে বাস করে। বাকি ১৭৬টি বাংলাদেশের ‘পরিযায়ী’ পাখি, যেগুলো খণ্ডকালের জন্য নিয়মিতভাবে এ দেশে থাকে। এই ১৭৬ প্রজাতির নিয়মিত আগন্তুকের মধ্যে ১৬০টি শীতে এবং ৬টি গ্রীষ্মে বাংলাদেশে থাকে। বাকি ১০ প্রজাতির পাখি বসন্তে এদেশে থাকে, যাদের ‘পান্থ-পরিযায়ী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। তবে পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্টের ফলে কিছু আবাসিক পাখিসহ পরিযায়ী ও পান্থ-পরিযায়ী শ্রেণিভুক্ত পাখিগুলো অচিরেই বাংলাদেশের আকাশে আর না উড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে, বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের মতে, সংরক্ষণ ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে মোট বন্যপ্রজাতির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আগামী কয়েক বছরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তাদের মতে, বিদ্যমান পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে যে হাজারখানেক প্রজাতির বন্যপ্রাণী টিকে আছে, যারা পরিবর্তিত পরিবেশে বিপন্ন। অর্ধেক প্রজাতিই এখন কোনো না কোনো ধরনের হুমকির সম্মুখীন।

ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশ ও দ্যা ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন বাংলাদেশ শাখার এক জরিপের তথ্য থেকে জানা যায়, গত ২০০ বছরে বিলুপ্ত হয়েছে অন্তত ৩০০ প্রজাতির প্রাণী। দেড়শ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ১৩ প্রজাতির মেরুদণ্ডি প্রাণী, ৪৭ প্রজাতির দেশি পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর, ৬৩ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১০ স্তন্যপায়ী প্রাণীর ১০টি মিলিয়ে প্রায় ৩০০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এছাড়াও বিপন্ন ৪৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। একইভাবে বিপন্ন অবস্থায় ১০৬ প্রজাতির নলবাহী উদ্ভিদ।

জানা গেছে, দেশের অধিকাংশ নদী বর্ষাকাল শেষে মরা খালে পরিণত হয়। বিষাক্ত বর্জ্য ও নদীতে সারা বছর পানি না থাকার কারণে মাছসহ বিভিন্ন ধরনের জলজপ্রাণীও বিলুপ্তির পথে। মিঠা পানির প্রায় ৫৪ শতাংশ প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্ত। শামুক, ঝিনুক, কচ্ছপ আগের মতো আর দেখা যায় না। নদীতে বসবাসকারী ঘড়িয়াল ও শুশুকও বিলুপ্তির তালিকায় রয়েছে। আর গ্রামে আগের মতো দেখা যায় না সাপ, গুঁইসাপ, ব্যাঙ প্রভৃতি।

বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারও এখন বিলুপ্তির পথে। প্রতিবছরই আশঙ্কাজনক হারে কমছে বাঘের সংখ্যা। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে মাত্র ১০৬টি বাঘ রয়েছে। ২০০৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৪০।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক  (ডিজি) ডা. মো. আইনুল হক রাইজিংবিডিকে বলেন, প্রাণীর খাবার বা আবাসস্থল কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ মানুষ। মানুষের প্রয়োজনে প্রাণী একদিকে খাবারে পরিণত হচ্ছে, অন্যদিকে হচ্ছে ভোগ-বিলাসের সামগ্রীতে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীব-বৈচিত্র্যের ওপর মানুষই প্রভাব ফেলছে।

তিনি বলেন, প্রাণী সংরক্ষণে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর পাশাপাশি মানুষকে প্রাণীর প্রতি অনুভবের জায়গাটা তৈরি করতে হবে।

প্রধান বনসংরক্ষক মো. ইউনুছ আলী বলেন, প্রাণীরা খুব সংবেদনশীল হওয়ায় পরিবর্তিত পরিবেশে টিকতে না পেরে বিভিন্ন প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে। কারণ নগরায়ন ও শিল্পায়ন যত বেশি হচ্ছে, জীব-বৈচিত্র্যের ওপর তত প্রভাব পড়ছে।

বন বিভাগের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আরো বলেন, অবৈধ শিকার রোধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অবৈধ শিকার ও পাচার রোধে আমরা সাধ্যাতীত চেষ্টা করছি। পাশাপাশি ফরেস্ট ইকো-সিস্টেম যাতে পরিবর্তন না হয় সে লক্ষ্যেও আমরা কাজ করছি। তবে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জুলাই ২০১৭/শায়েখ/হাসান/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়