ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

আত্মহত্যা ও আমাদের গণমাধ্যমের পোস্টমর্টেম

শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ১৮ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আত্মহত্যা ও আমাদের গণমাধ্যমের পোস্টমর্টেম

রুহুল আমিন : ঘটনা ১ : তারিখ ১৬ মে, ২০১৬। নাম-জয়ন্ত বিশ্বাস (৪৮), যশোর ইনস্টিটিউট নাট্যকলা সংসদের অভিনেতা ও পরিচালক। সামাজিক সংগঠন দ্যোতানার সভাপতি ও যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। আত্মহত্যার আগে নিজ হাতে একটি নোট লিখে যান। এই সুইসাইড নোটে তিনি কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি। যেহেতু শিল্প-সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে ওনার হাঁটা চলা ছিল, চিঠির মধ্যেও সেই রেশ পাওয়া যায়। চিঠির শেষে আত্মহত্যার জন্য তিনি কাছের মানুষ, যারা ওনাকে ভালবাসতেন বলে তিনি বিশ্বাস করতেন, তাদের কাছে ক্ষমা চান। ফেসবুক আইডি আছে, কিন্তু তাতে তিনি এ সংক্রান্ত কোনো পোস্ট দেননি।

 

ঘটনা ২ : তারিখ ২০ মে, মধ্যরাত, ২০১৬ । নাম- মহিউদ্দিন ইবনে খায়ের। ঢাকা কলেজের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা। আত্মহত্যার আগে নিজের ফেসবুক ওয়ালে এক স্ট্যাটাস ও প্রেমিকার সঙ্গে তোলা কয়েকটি ছবি পোস্ট করে সেখানে আত্মহত্যার কারণ উল্লেখ করেন। সংবাদ মাধ্যম ওই স্ট্যাটাসকে সুইসাইড নোট হিসেবে নিউজে উল্লেখ করেছে। ফেসবুকে ওই পোস্ট দেওয়ার ৩০ মিনিট পর তার কক্ষে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।

 

ঘটনা ৩ : তারিখ ২৪ মে, মধ্যরাত, ২০১৬। নাম : সাবিরা হোসাইন। উঠতি মডেল ও একটি বেসরকারি টেলিভিশনের বিপণন বিভাগের কর্মকতা। প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা।  আত্মহত্যার আগে নিজের ফেসবুক ওয়ালে একটি স্ট্যাটাস ও ভিডিও পোস্ট করেন। প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, বিছানায় শুয়ে একটি ছুরি হাতে নিয়ে নিজের পেট ও গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন সাবিরা। তাকে মানসিকভাবে অনেক অস্থির বলে মনে হয়। শুরুতে তাকে বলতে শোনা যায়, আমি কিচ্ছু করতে পারব না। তারপর হাতে একটি ছুরি নিয়ে বারবার পেটে ও গলায় চাপ দেন। কিন্তু কিছু হয় না। বারবার বলতে শোনা যায়, কাটেও না। আমি ব্যর্থ। ওকে নেক্সট অ্যাটেম্পট নেব। পরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়।   

 

ঘটনা ৪ : তারিখ ১৪ জুন, মধ্যরাত, ২০১৬। নাম : সিনহা রাজ। মডেল ও অভিনেত্রী। আত্মহত্যার কারণ; অভিনেতা ও নাট্যপরিচালক স্বামীর সঙ্গে আর্থিক টানাপোড়েন। সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় লাশ পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগে ফেসবুকে কোনো পোস্ট দিয়েছিলেন কি না তা জানা যায়নি।

 

২০১৬ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর সারা বিশ্বে ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো, ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে শীর্ষ দুইয়ে আছে আত্মহত্যা। আর আত্মহত্যার ৭৫ ভাগ ঘটনা ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে।

 

আত্মহত্যা সংক্রান্ত একটি মেডিক্যাল টার্ম হল ‘সুইসাইডাল আইডিয়েশন। এতে বলা আছে, আত্মহত্যা করার আগে আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের মাঝে বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যা থেকে অনুমান করা যায় যে মানুষটি আত্মহত্যার হুমকিতে রয়েছে। হতাশা থেকে শুরু করে শারীরিক অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করতে পারে মানুষ। তবে সুইসাইডাল আইডিয়েশেন সম্পর্কে অবগত থাকলে কেউ আত্মহত্যাপ্রবণ কি না তা বোঝা যাবে। এ বিষয়ে মানসিক রোগ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আরো ভালো বলতে পারবেন। 

 

প্রতিটি আত্মহত্যার পেছনে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কারণ ও ঘটনা। যে আত্মহত্যা করে তার কাছে ওই ঘটনা ও কারণের জন্য আত্মহত্যা, মানে নিজেকে বলি দেওয়ার মধ্যে এক ধরনের মুক্তি আছে। তাদের এই যুক্তির কাছে জগতের আর সব কিছু মূল্যহীন। হয় তো এমনও হতে পারে যে, আত্মহত্যাকারীর কাছে ওই কারণটি আত্মহত্যার কারণ হলেও, আমার আপনার কাছে সেটা কোনো বড় কারণ না। একেবারে মামুলি ব্যাপার। যদি সুইসাইডাল আইডিয়েশনের ব্যাপারটা সম্পর্কে আমাদের কিছু ধারণা থাকে তবে আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে সঙ্কটাপূর্ণ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে সাহায্য করা যেতে পারে।

 

অপরদিকে আত্মহত্যা এক ধরনের আত্মগরিমাও বলা যায়। যে গরিমার কারণে জাপানিরা আত্মহত্যা করে। মূল কথা বিভিন্ন কারণেই মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে বিদ্রোহ করে, আবার অনেকে শুধু নিজের বলতে প্রাণ ছাড়া আর কিছু নেই তা প্রমাণে আত্মাহুতি দেয়। তবে আমাদের দেশে আত্মহত্যার কারণগুলো প্রায় সাদৃশ্যপূর্ণ। বিগত কয়েক বছরে যে কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে তার বেশির ভাগই পারিবারিব কলহ, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, প্রেমঘটিত কারণ, পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হওয়ায়ও অনেক সময় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

 

এই তো গেলো দৃ্শ্যত কারণ। অদৃশ্য কারণও আছে আত্মহত্যার পেছনে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি আত্মহত্যার পেছনে মিডিয়া তথা গণমাধ্যমের বিশেষ এবং বিশাল একটা অদৃশ্য ভূমিকা রয়েছে। পত্রিকার পাতা খুললে সবচেয়ে আকর্ষণীয় খবর মনে হয় আত্মহত্যার খবর। আমাদের গণমাধ্যমগুলো আত্মহত্যাকে পোস্টমর্টেম করে। পোস্টমর্টেম করেই ক্ষান্ত হয় না। মিডিয়াগুলো আত্মহত্যার পেছনের এবং আত্মহত্যার আগে লিখে যাওয়া সুইসাইড নোট ফলাও করে প্রচার করে। আর এই প্রচারে নতুন যোগ হয়েছে আত্মহত্যাকারীর ফেসবুক স্ট্যাটাস। আত্মহত্যার আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া যেন একটি ফ্যাশন হয়ে গেছে। আর এই ফ্যাশনকে ফলাও করে প্রচার করছে আমাদের গণমাধ্যম। যা আত্মহত্যাপ্রবণদের আত্মহত্যা করতে আরো বেশি প্ররোচিত করছে।

 

তথ্যের অবাধ প্রবাহের কারণে কোনো তথ্যই আর আটকে রাখা যায় না। একবার ভাবুন তো, আপনার স্কুল পড়ুয়া ছেলেটি মাত্র কয়েকদিন আগে প্রেমে পড়ল। সে এখন এক ফ্যান্টাসি জগতে বাস করছে। এই ফ্যান্টাসিতে থাকতে থাকতেই এলো তার ফাইনাল পরীক্ষা। প্রেমের ফ্যান্টাসির কারণে ভুলে গেল সে পডাশোনা করার কথা। পরিণামে রেজাল্ট হলো খারাপ। এদিকে যে মেয়েটির প্রেমে পড়েছে সে, সেই মেয়েটিও তাকে এড়িয়ে চলে। আপনি দেখলেন, আপনার ছেলে আর আগের মতো বাকপটু নেই। ভেতরে ভেতরে সে বিচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে আপনার কাছ থেকে, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে। সকলের কাছ থেকে। ঠিক সেই মুহূর্তে আপনি রেজাল্ট শিট হাতে পেয়ে খুব করে বকলেন ছেলেকে। সে দুঃখে আর অভিমানে নিতে পারে যেকোনো ধরনের বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত। প্লিজ সময় দিন আপনার সন্তানকে, বন্ধুর মতো মিশুন। সুইসাইডাল আইডিয়েশন সম্পর্কে জানুন এবং সচেতন হোন।

 

প্রযুক্তিগত কারণে মানুষ প্রতিনিয়ত বিচ্ছিন্ন হচ্ছে এবং এই আইসোলেশন প্রত্যেককে নিজের ভেতরে সীমাবদ্ধ করে ফেলছে। যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকত তাহলে চিন্তার কারণ ছিল না, কিন্তু নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে খাতা কলমে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকলেও বাস্তবে তা নেই আমাদের। আর এই জায়গাতেই যত সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সে কথা বলেছে জোর দিয়ে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার বেশি। বলছিলাম বিচ্ছিন্নতার কথা; বিচ্ছিন্নতা মানুষকে নিজের ভেতরে আবদ্ধ করে ফেলে। প্রযুক্তিতে আসক্তি তৈরি হয়। কিন্তু এই আসক্তি যখন কিছুটা পরতির দিকে থাকে তখন আর স্বাভাবিক জীবনের ফেরা হয় না ওইসব মানুষের। অবশেষে অস্বাভাবিকতায় খুঁজে তারা নিজেদের মুক্তি।

 

তথ্যের অবাধ প্রবেশ আর বিশ্ব নাগরিক হওয়ার স্লোগান মানবজাতির কল্যাণের পাশাপাশি ভয়ংকর ক্ষতি করেছে বলেও আমার ধারণা। বিশ্বনাগরিকতা মানুষের আবেগ-অনুভূতির সিন্ধুক ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে পথে-প্রান্তরে। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ বলে কিছু থাকল না। আর ‘আমিই সেরা’মতবাদ কেড়ে নিয়েছে মানুষের সর্বশেষ মনুষ্যত্বটুকুও। তাই আত্মহত্যার মতো ঘটনা এখন আর আমাদের ভাবায় না। খুব পরিচিত কেউ আত্মহত্যা করলেও দু-চার দিনের বেশি শোকগ্রস্ত থাকি না। আর দায়ও থাকে না আমাদের। আমাদের সুখের অসুখ কারো অস্বাভাবিক মৃত্যুও সারাতে পারে না।

 

সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। সমাজের প্রতিটি ঘটনা মানুষকে জানানোর মধ্যে সংবাদপত্রের ভূমিকা আছে। সংবাদপত্র মানুষের কল্যাণে কথা বলবে। আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রগুলো একটি ভালো ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু টিআরপি, সার্কুলেশন আর অ্যালেক্সার অসহ্য প্রতিযোগিতা তা করতে দিচ্ছে না। ছাপা পত্রিকার চেয়ে অনলাইন পত্রিকা এখন মানুষ বেশি পড়ে, বিশেষ করে শহরে। ছাপা পত্রিকার জায়গা অনলাইন দখলে নিচ্ছে প্রতিনিয়িত। ঘটনা ঘটার কয়েক মিনিটের মধ্যে পাঠকের কাছে পৌঁছে যায় সে খবর। কিন্তু বেশির ভাগ অনলাইন পত্রিকাই অ্যালেক্সার শিকলে বন্দি। অ্যালেক্সার রেটিংয়ের ওপর নির্ভর করে সাংবাদিকদের রুটি-রুজি। তাই মূলধারার সাংবাদিকতার চর্চা আর করা হয় না তাদের। পাঠকের দৃষ্টি কাড়তে প্রতিনিয়ত পোস্টমর্টেম করতে থাকে ঘটনার, সংবাদের। তাই শিরোনামেই চলে আসে বউকে বেঁধে স্বামীর আত্মহত্যা। প্রেমিকযুগলের একসঙ্গে আত্মহত্যা। টিভি অভিনেত্রীর আত্মহত্যা। ‘আত্মহত্যা’ শব্দটা নিয়েই আমার আপত্তি আছে। এই শব্দটার ভেতরেই আত্মহত্যাপ্রবণদের জন্য উসকানি আছে। তাছাড়া এই শব্দের ভেতর হতাশার জন্যও যেমন মরতে উদ্বুব্ধ করে, তেমনি দাম্ভিকতার মাধ্যমেও মরতে উদ্বু্ব্ধ করে। যে ব্যক্তি নিজেকে খুন করে তার কাছে ব্যাপারটা এমন নয় কি যে, অন্যসব সবার কাছে থাকলেও এটা (নিজের মৃত্যু) আমার হাতে। এটাকে দাম্ভিকতা বা শেষ সম্বল যাই বলি না কেন, এটাই শেষ অর্থে আত্মঘাতী করে তোলে মানুষকে।

 

আগের মতো মানুষ আর খুটে খুটে পত্রিকা বা খবরের সবটুকু পড়ে না এখন। বেশির ভাগ মানুষই শিরোনাম পড়ে। শিরোনাম পড়ে চোখ আটকে গেলে ভেতরে ঢোকে। সংবাদকর্মীরাও তা জানে এবং বোঝে বলে আমার বিশ্বাস। তাই সংবাদকর্মীদের একটা প্রচেষ্টা থাকে আকর্ষণীয় শিরোনাম দেওয়ার। আমি নিজে সাংবাদিতায় যুক্ত থাকায় ব্যাপারটায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখন কোনো নিউজের শিরোনামে যদি ‘আত্মহত্যা’ শব্দটা থাকে তবে পাঠকের চোখ সেখানে আটকে যায়। এটাই আমার মনে হয়। সব সংবাদকর্মীদেরই চেষ্টা থাকে এ রকম সংবাদকে কীভাবে পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করা যায়। খবরটাকে যত বেশি উন্মুক্ত করা যায় তত বেশি পড়বে পাঠক। শিরোনামে আত্মহত্যা শব্দ দেখে আটকে গিয়ে পুরো নিউজটাই পড়া হয়। প্রতিটি আত্মহত্যায়ই কোনো না কোনো কারণ থাকে। আর আত্মহত্যাকারী সুইসাইড নোট লিখে গেলে তো কথাই থাকে না। পাঠকের সামনে তা তুলে ধরতে পারলে তো সর্বাধিক পঠিত হয় সে নিউজ। কিন্তু একবারও কি আমরা ভাবি যে, এই সব নিউজ কাউকে না কাউকে আত্মহত্যায় উৎসাহ জোগায়।

 

আমার ধারণা, আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের কাছে এই সুইসাইড নোট লিখে মরে যাওয়ার ঘটনা এক ধরনের ফ্যান্টাসিতে পরিণত হয়। তখন আত্মহত্যা করতে আরো বেশি উদ্বুদ্ধ হয় সে। বলা যায়, আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের কাছে ওই ধরনের সংবাদ নিজের হাতে নিজের মৃত্যুকে আরো বেশি উসকে দেয়। আত্মহত্যার জায়গায় আমরা অপমৃত্যু, অপঘাত বা অন্য কিছু লিখতে পারি। পরে নিউজের ভেতরে স্বেচ্ছামৃত্যুর ব্যাপারটা বলা যেতে পারে। কিন্তু অন্ততপক্ষে আত্মহত্যা শব্দটার পক্ষে আমি নই। আমার কাছে মনে হয়, আত্মহত্যা শব্দটা সর্বদা আত্মহত্যাপ্রবণতাকে উসকে দেয়।

 

আত্মহত্যার পর থানায় মামলা করতে গেলে আমরা বলি ইউডি মামলা, মানে আন-ন্যাচারাল ডেথ বা অপমৃত্যুর মামলা। কিন্তু নিউজ করার সময় আমরা খুব সহজে লিখে ফেলি আত্মহত্যা। সেখানে আমরা কি বলতে পারি না অপমৃত্যু। অনেক সময় এই ধরনের মৃত্যুর পর মামলা-মোকদ্দমা হয়। এ ক্ষেত্রে নিউজ কাটিং অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে ক্ষেত্রে অপমৃত্যুর আগে যদি কেউ সুইসাইড নোট লিখেও যায়, তবে তা মিডিয়ায় প্রকাশ না করে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। ঠিক যেভাবে সংরক্ষণ করা হয় ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে ধর্ষিতার (ভিকটিম) পরিচয়। কারণ আত্মহত্যাপূ্র্ব গল্পটা আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের ভেতরে একটা ঘোর তৈরি করে। সে ফ্যান্টাসিতে পড়ে আত্মহত্যার চিন্তাকে আরো বেশি এগিয়ে নিয়ে যায়।

 

প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনারই ফলোআপ দেওয়া হয় সংবাদমাধ্যমে। হত্যা, খুন বা যেকোনো ধরনের অপরাধ বা বড় ঘটনার। কিন্তু আত্মহত্যার ক্ষেত্রে তা হয় না। এটাও অপরাধই। আর দিলেও কেন, কীভাবে এবং কারণ এইসব উসকে দেওয়া ব্যাপার-স্যাপার থাকে ওই ফলোআপে। আমি এইগুলোকে উসকে দেওয়া বিষয়ই বলব। যদি আত্মহত্যাকারীর স্বজন, বিশেষ করে মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী এবং সন্তানের বরাত দিয়ে ফলোআপ দেওয়া যেত, তাহলে কিছুটা উপকারে আসত। এবং সে ফলোআপ অবশ্য আত্মহত্যাকারীর চলে যাওয়ার কারণে যে শূন্যতা তৈরি করেছে তাদের মনে, সে বিষয়ে হবে। তার বেঁচে থাকা যে কি জরুরি ছিল, স্বজনদের এমন হাহাকার দিয়ে ফলোআপ হবে। কেন আত্মহত্যা করেছে, কোন ঘটনার জেরে করেছে, আত্মহত্যা করার আগে তাদের যাপন কেমন ছিল- এইসব। যে অভিমানেই আত্মহত্যা করুক না কেন, তাকে যে কত দরকার ছিল, তা বলা খুব প্রয়োজন। এটা আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির ভেতরে জাগাবে যে তার পরিবারও এই রকম দুঃখের সাগরে ভাসবে তাকে হারালে। আত্মঘাতী না হতে সাহায্য করবে তাকে। প্রয়োজনবোধে নিয়মিত আত্মহত্যায় স্বজনহারাদের খবর দেওয়া যেতে পারে। যার সন্তান আত্মহত্যা করে সে সারা জীবন বয়ে বেড়ায় ওই দুঃসহ বেদনা। পরিবারের সব জীবিত সদস্য সে অসহনীয় কষ্ট আজীবন বয়ে বেড়ায়। এইগুলো খবর করা যেতে পারে। আর সবার আগে আত্মহত্যা শব্দটা ব্যবহার বাদ দিতে হবে।

 

নতুন ঘটনা জানানোই হলো সংবাদপত্রের কাজ, সুতরাং তা জানাতে হবে। তবে মানুষের কল্যাণের কথাও মনে রাখা দরকার। স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে আত্মহত্যা প্রতিরোধে আত্মহত্যা করতে যেসব পদ্ধতি বহুল প্রচলিত, সেগুলোর সহজলভ্যতা কমিয়ে আনার পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমে আরো দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সংবাদ প্রকাশের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, সংবাদমাধ্যমকে এমন ভাষা পরিহার করতে হবে, যা অন্যকে আত্মহত্যায় উৎসাহী করে তোলে। এ ছাড়া আত্মহত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাও এড়িয়ে চলতে হবে। আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশনের (আইএএসপি) নির্দেশনায় অতিরঞ্জন, স্থান-পদ্ধতির হুবহু বিবরণ, চাঞ্চল্যকর ভাষা, সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে উপস্থাপন, গুরুত্ব দিয়ে প্রচার ও ফলাও প্রচার পরিহার করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে ‘আত্মহত্যা’ শব্দ ব্যবহার, চিরকুট প্রকাশ, আত্মহত্যাকে সফল বা ব্যর্থ বলা ও ফিচার শব্দ পরিহার করতে বলা হয়েছে।

 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমে আত্মহত্যার সংবাদ প্রচার-সংক্রান্ত জাতীয় নীতিমালা রয়েছে। নরওয়ের গণমাধ্যমে কখনোই ‘আত্মহত্যা’ শব্দটি উল্লেখ করা হয় না। ডেনমার্কে জনস্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হলে ‘আত্মহত্যা’বা ‘আত্মহত্যার চেষ্টা’ শব্দ পরিহার করা হয়। জাপানের গণমাধ্যমে তারকা বা বহুল পরিচিত ব্যক্তিত্ব না হলে আত্মহত্যাকারীর নাম ও আত্মহত্যার কারণ উল্লেখ করা হয় না।

 

অনেকে বলে থাকেন, যে আত্মহত্যা করে তাকে ঘৃণা করতে হবে। আর যাই হোক আত্মহত্যাকারী কারো সমবেদনা পেতে পারে না। আমি এই ধারণায় বিশ্বাসী না। কারণ, আত্মহত্যাকারীকে নয় বরং আত্মহত্যাকে ঘৃণা করতে হবে। যে আত্মহত্যা করেছে তার জন্য তার স্বজনদের মাঝে যে শূণ্যতা তৈরি হয় তার প্রতি নজর দিতে হবে। তাতে করে আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের ভেতরে তার বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হতে পারে। সময় এসেছে  আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ অভিশাপ নিয়ে আমাদের ভাববার। আমার, আপনার আশপাশের মানুষকে নিয়ে আমরা একটা পারস্পরিক জীবন  ও যাপন নির্ভর সম্প্রীতি গড়ে তুলতে পারি। একে অন্যের মধ্যে দুঃখ বেদনা শেয়ার করার জায়গা তৈরি করতে পারি। পাশের কেউ বেদনায় নুয়ে পড়লে তাকে সহমর্মিতা আর সাহস দিয়ে এগিয়ে চলার মন্ত্রণা দিতে পারি। বলতে পারি জীবন একটাই, বেঁচে থেকে সৌন্দর্য উপভোগ কর।

 

যাদের দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম তাদের কথা বলেই শেষ করব। জয়ন্ত, মহিউদ্দিন, সাবিরা ও সিনহা রাজ। তাদের আপনজনরা জানেন, প্রিয়জনের এই অস্বাভাবিক মৃত্যু কতটা বেদনাদায়ক। একমাত্র তারাই বুঝবেন প্রিয়জনের এই স্বেচ্ছামৃত্যু কতটা পীড়াদায়ক। কিন্তু আমার কথা হলো, জয়ন্ত বিশ্বাস কি আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তার আশপাশের মানুষজন সুইসাইডাল আইডিয়েশন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন? তার মান অভিমান কিংবা দুঃখের কথা, বেদনার কথা মন খুলে বলতে পারে এমন কাউকে পাশে পেয়েছিল জয়ন্ত। প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাওয়াতে মহিউদ্দিন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিল, সাবিরাও আত্মহত্যার চেষ্টার ভিডিও ফেসবুকে দিল তারপর কি তাদের বাঁচানোর যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল? কিংবা সিনহা রাজের পাশে গিয়ে কি দাঁড়িয়ে ছিল তার কোনো বন্ধু? মহিউদ্দিন ও সাবিরাকে আমরা কি পারতাম না বাঁচাতে? স্ট্যাটাস দেওয়ার পর আত্মহত্যা করতে তো অন্তত কিছুক্ষণ সয়ম লাগে। সে সময়ে কেউ কি তাদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি? যে বেদনায় সাবিরা আত্মহত্যা করল তার বেদনার কথা বলার এমন কাউকে কি সে পেয়েছিল কাছে? পায়নি। প্রতিবেশী বলতে আমরা এখন আর কাউকে চিনি না। এই কেতাদুরস্ত শহরে তো প্রতিবেশী একেবারে অপরিচিত। প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধন থাকলে হয়তো বেঁচে থাকত সাবিরা, মহিউদ্দিন, সিনহা। কিংবা নির্ভর করা যায়, বিশ্বাস করা যায় এমন বন্ধু থাকলে হয়তো আত্মহত্যাকারী এইসব কেউ আর আত্মহত্যা করত না। প্লিজ আপনার আশপাশের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবেন না, অন্তত বেঁচে থাকার জন্য যে পারস্পরিক সৌহার্দ আর সম্প্রীতি দরকার তা আমরা বজায় রাখতে চেষ্টা করি। তাতেই আমাদের পৃথিবী হবে সুন্দর। 

 

সময় এসছে আমাদের সচেতন হওয়ার। সুখ, শান্তি ভোগ বিলাসিতার বাইরে এখন, এই সময়ে শুধু বেঁচে থাকার জন্য আমাদের একত্রিত হওয়া প্রয়োজন। এই দুঃসময়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে, সবাইকে একসঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হবে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ জুন ২০১৬/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়