ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

আশ্রয়ণ প্রকল্প ও গুচ্ছগ্রাম

আশ্রয় জুটলেও অনিশ্চিত জীবন-জীবিকা

রুমন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩৯, ২৮ অক্টোবর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আশ্রয় জুটলেও অনিশ্চিত জীবন-জীবিকা

রুমন চক্রবর্তী, কিশোরগঞ্জ : ষাটোর্ধ্ব আঙ্গুরা বেগমের নিজের বাড়িঘর নেই। স্বামী মারা যাওয়ায় ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতেন অন্যের বাড়িতে। মেয়েজামাই আবদুর রহিমের সঙ্গে প্রায় ছয় বছর আগে গুচ্ছগ্রামে আশ্রয় জোটে। ভেবেছিলেন বাকি জীবন এখানেই কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু অসহায়ত্ব আর অপ্রাপ্তি দানা বেঁধে এরই মধ্যে হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি। গুচ্ছগ্রামে তাকে আশ্রয় নয়, যেন দেওয়া হয়েছে নির্বাসন।

 

‘সরহারে গর বানাইয়া দিছে। কিন্তু এনো কি খালি ফানি খাইয়া থাহন যাইব? কাম-কাজের কুনু বাউ নাই। ছাইরোবুকদিয়া খালি ফানি আর ফানি। গরতো বাইর অওন যায় না। মরবার ফতে গেলেও ডাক্তরের কাছে যাওন যায় না। রাস্তাগাট নাই, কাছে ফিছে একটা বাজারও নাই। ফুলাফানরে যে ইস্কুলে দিয়াম, হেই সুবিদাও নাই। কেউ আমরার খবর লয় না।’ বুকের মধ্যে জমাট বাঁধা কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন আঙ্গুরা বেগম। চোখে-মুখে তার নিদারুণ কষ্ট আর অসহ্য যন্ত্রণা।

 

বলছিলাম কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার ধলা ইউনিয়নের সিকান্দরনগর গুচ্ছগ্রামের কথা। ছয় বছর আগে ৭০টি পরিবারের সঙ্গে ভিটেবাড়িহীন এই বিধবারও আশ্রয় জোটে এখানে। সুনাইবিলের মাঝখানে মাটি ভরাট করে ২০১০ সালে গড়ে তোলা হয় এই গুচ্ছগ্রাম।

 

তিন-চার কিলোমিটারের মধ্যে কোনো জনবসতি নেই। রাস্তাঘাট না থাকায় বিচ্ছিন্ন এক জনপদে পরিণত হয়েছে এটি। আর বর্ষার কথাতো বলাই বাহুল্য, তখন গুচ্ছগ্রামের লোকজন আশপাশের জনগোষ্ঠী থেকে ছিটকে পড়ে আরো দূরে।

 

মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই পেলেও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন বাকি সুবিধা থেকে। সরকারি ঘরবাড়িতে বাস করে নিশ্চিত হচ্ছে না তাদের জীবন-জীবিকা। জীবনের সব দিক থেকে তারা পিছিয়ে পড়ছেন। তাই সরকারের দেওয়া উপহার ছেড়ে অনেক ছিন্নমূল পরিবার আবার অনিশ্চিত গন্তেব্যে পা রাখছে। সুদিনের আশায় থেকে যাচ্ছেন যারা, তারাও জানেন না কবে আসবে সে সুদিন।

 

সিকান্দরনগর গুচ্ছগ্রামের সারি সারি ছোট ঘরগুলোর বেশিরভাগই এখন ফাঁকা, কেউ থাকে না। লোকজন না থাকায় অনেক ঘরই জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।গ্রামের বাসিন্দারা জানান, বেশকিছু ঘর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এগুলো আর মেরামত করা হয়নি।

 

এখানকার বাসিন্দা আবদুস সালাম বলেন, ‘কী আর করবাম নিজেরা যহন থাহি, যাওনের আর কুনু জায়গা নাই, তাই কষ্ট অইলেও নিজেরার গর নিজেরাই ঠিক কইরা লই।’ তিনি জানান, শুরুর দিকে এখানে ৭০টি পরিবার বাস করলেও, এখন আছে মাত্র ২৭টি পরিবার। বাকিরা পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের ঘর তালাবদ্ধ করে বা এভাবেই ফেলে রেখে গেছে। তিনিও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন, কী করবেন।

 

ছয় সন্তানের মা তহুরা বেগম। স্বামী পরের জমিতে কাজ করেন। গুচ্ছগ্রামে কোনো রকমে জীবন চলে গেলেও তার একটাই দুঃখ, লেখাপড়া করাতে পারেননি সন্তানদের। কারণ এ গ্রামের তিন-চার কিলোমিটারের মধ্যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই।

 

 

গুচ্ছগ্রামের যে পাঁচ-ছয়জন শিশু-কিশোর বিদ্যালয়ে যায়, তাদের একজন রুবেল। দশম শ্রেণির ছাত্র। পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে স্কুল। রাস্তাঘাট নেই, তাই প্রতিদিন স্কুলে যেতে পারে না। রুবেল জানায়, তাদের গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। আশপাশের সব গ্রামে টেলিভিশন থাকলেও, তাদের গ্রামে নেই। তাই টিভিতে কী হয় না-হয়, জানে না তারা। কয়েকটা বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে তারা পালা করে মোবাইলসেট চার্জের সুযোগ পায়।

 

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামের ৭০ থেকে ৮০ জন শিশু-কিশোরের মধ্যে স্কুলে যায় মাত্র ছয়জন। বাকিরা বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে।

 

জেলার করিমগঞ্জের সুবন্ধি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৭৫টি গৃহহীন পরিবারের ঠাঁই হয়েছে। ছোট ঘুপচি ঘরে দিনের বেলাতেও আলো-বাতাস যায় না। চার বছর হয়ে গেলেও সেখানে বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থা হয়নি। ১১টি নলকূপের মধ্যে দু-তিনটি বাদে সবগুলোই নষ্ট হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত এখানকার লোকদের কোনো সরকারি সহযোগিতা দেওয়া হয়নি। পেশাভিত্তিক  প্রশিক্ষণ ও ঋণ দিয়ে এদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার কথা থাকলেও গতি পায়নি সেই উদ্যোগও। এসব কারণে ২৫-৩০টি পরিবার এরই মধ্যে চলে গেছে সেখান থেকে।

 

এ আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের সমিতির সভাপতি মো. কবির বলেন, এখানে অনেক অসহায় পরিবার আছে। যাদের কোনো পেশা নেই। অনেকে ভিক্ষাবৃত্তি করেন। সরকারি সুযোগ-সুবিধাও পায় না। সবার আগে তাদের বিষয়টি সরকারের ভাবা উচিত।  বিদ্যুতের ব্যবস্থা হলে, বিদ্যুৎকে কাজে লাগিয়েও অনেকের পেশার সুযোগ হতো। আর প্রশাসনের লোকজন যদি নিয়মিত এখানে যাওয়া-আসা করতেন, অনেক সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যেত।

 

তিনি আরো জানান, সরকার যদি পেশার সুবিধা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, চিকিৎসা, শিক্ষা বাস্তবায়নে আন্তরিক হয়, তাহলে চলে যাওয়া লোকজন আবারও তাদের আপন ঠিকানায় ফিরে যাবে।

 

গৃহহীনদের কেবল ঘর দেওয়াই আশ্রয়ণ ও গুচ্ছগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল না। ঋণ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকার ব্যবস্থা করে তাদের দারিদ্র্য দূর করাই ছিল প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের দাবি, সেগুলো বাস্তবায়ন করলেই তারা দিশা খুঁজে পাবেন নতুন জীবনের।

 

 

তাড়াইলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানা আক্তার জানান, কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইলেই সবচেয়ে বেশি আশ্রয়ণ প্রকল্প রয়েছে। এখানে একটি গুচ্ছগ্রাম, দুটি আদর্শ গ্রাম ও সাতটি আশ্রয়ণ প্রকল্প আছে।

 

তিনি বলেন, সবগুলোর সমস্যা এক ধরনের নয়, একেকটির একেক ধরনের সমস্যা। ভৌগোলিক বাস্তবতায় সিকান্দরনগর গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা নানাদিক থেকে সমস্যায় আছে স্বীকার করে তিনি বলেন, কেবল সরকারের দিকে চেয়ে না থেকে নিজেদের উদ্যোগী হওয়া উচিত। এখানে জনপ্রতিনিধিদের অনেক দায় আছে। ভিজিডি, ভিজিএফসহ সরকারি সুবিধাগুলো এখানকার বাসিন্দাদেরও দেওয়া উচিত।

 

তিনি আশার বাণী শুনিয়ে  বলেন, আমি সবগুলো আশ্রয়ণ প্রকল্প ও গুচ্ছগ্রাম পরিদর্শন করছি। এগুলোর সমস্যা চিহ্নিত করে তা পর্যায়ক্রমে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আশা করি শিগগিরই এগুলোর সুফল তারা ভোগ করবে।

 

করিমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আছমা আরা বেগম বলেন, সুবন্ধি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বিদ্যুতের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিভাগকে নলকূপগুলো মেরামতের জন্য বলা হয়েছে। এছাড়া তাদের পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে। 

 

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় জানিয়েছে, জেলায় মোট ১৬টি আশ্রয়ণ প্রকল্প ও তিনটি গুচ্ছগ্রামে প্রায় ১২০০ গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আরো পাঁচটি প্রস্তাবিত প্রকল্প আছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ‘জমি আছে, ঘর নাই’ প্রকল্পের আওতায় ১০০টি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘সবার জন্য বাসস্থান’ কর্মসূচির আওতায় আরো ৬ হাজার ৬৩৬ জন গৃহহীনের তালিকা করা হয়েছে। যাদের পর্যায়ক্রমে পুনর্বাসন করা হবে।

 

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস রাইজিংবিডিকে বলেন, গুচ্ছগ্রাম ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের সমস্যাগুলো আমরা উপেক্ষা করি না। এসব সমস্যা সমাধানে আমাদের তৎপরতা আছে। তবে এগুলো একদিনে সমাধান করে দেওয়া যাবে না। এখানকার একটি শিশুও যেন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া পরিবারগুলোকে স্বাবলম্বী করতে প্রশিক্ষণসহ ঋণ কার্যক্রম জোরদার করা হবে।

 

 

রাইজিংবিডি/কিশোরগঞ্জ/২৮ অক্টোবর ২০১৬/রুমন চক্রবর্তী/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়