ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

অভিযোগপত্র দাখিলে অনিশ্চিয়তা

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ৩১ অক্টোবর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অভিযোগপত্র দাখিলে অনিশ্চিয়তা

মামুন খান : প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা ও প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ আরো দুই লেখককে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এক বছরেও অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেনি পুলিশ।

 

এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে হামলাকারীরা। প্রকৃত নাম না জানায় হত্যার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।

 

দুটি ঘটনায় ইতোমধ্যে জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আসামিদের দেওয়া স্বীকারোক্তি থেকে হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া আরো ১০ জঙ্গির বিষয়ে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তবে সেগুলো ছদ্মনাম হওয়ায় প্রকৃত নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করে আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করতে গোয়েন্দাদের ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।

 

এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে মামলা দুইটির অভিযোগপত্র দাখিল অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। এদিকে দুটি মামলায় পুলিশ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এ পর্যন্ত আদালতের বেশ কয়েকটি ধার্য তারিখ পার হলেও তা দাখিল করতে পারেনি পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগ (ডিবি)।

 

এদিকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত বলে দাবি করেন মামলার বাদীপক্ষ। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে এর ধারাবাহিকতা চলতেই থাকবে।

 

দীপন হত্যা মামলায় দুজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে মাইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান চলতি বছরের ২৯ আগস্ট ও মো. আব্দুস সবুর ওরফে আব্দুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে সাজু ওরফে সাদ চলতি বছরের ২ অক্টোবর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন।

 

মামলার তদারককারী কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, ‘মামলা দুটির তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। দুটি মামলায়ই আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এবিটির সদস্যরা দীপনকে হত্যা করে ও টুটুলসহ তিনজনকে হত্যার চেষ্টা চালায়। এ দুটি হামলায় সরাসরি পাঁচজন করে মোট ১০ জন অংশ নেয়। এ ছাড়াও হামলার পরিকল্পনাকারী, প্রশিক্ষক ও হামলাকারীদের বড় ভাইসহ পরোক্ষভাবে আরো কয়েকজন দুটি হামলার সঙ্গে জড়িত। তাদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের জন্য জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত। তবে হামলায় জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের ওপর নির্ভর করছে অভিযোগপত্র দাখিল। হামলায় জড়িত আরো কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেই অভিযোগপত্র দাখিল প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।’

 

তিনি আরো জানান, প্রকাশক দীপন হত্যা মামলায় দুজন আসামি ইতোমধ্যেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ মামলায় আরো দুই আসামিকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া টুটুল হত্যা চেষ্টা মামলায়ও দুজন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আসামিদের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে হামলার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।

 

মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে আদালত পুলিশের উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, ‘প্রকাশক দীপন হত্যা মামলা ও প্রকাশক টুটুল হত্যা চেষ্টা মামলার পুলিশ প্রতিবেদন আদালতে এখনো আসেনি। আগামী ২৩ নভেম্বর এ দুটি মামলার পুলিশ প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য রয়েছে।’

 

দীপন হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মো. ফজলুর রহমান বলেন, ‘এ মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের দেওয়া জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকা ৮-১০ জনের নাম পাওয়া গেছে। কিন্তু এর কোনোটিই তাদের প্রকৃত নাম নয়। সবই সাংগঠনিক নাম। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আসামিদের স্বীকারোক্তিতে দেওয়া নামগুলোর সঠিকভাবে শনাক্ত করা, যাচাই করা শেষে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হলে পরবর্তীতে এ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। তবে মামলাটির অভিযোগপত্র দ্রুততার সঙ্গে দিতে আমরা আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’

 

হত্যা মামলার বাদী দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান বলেন, আমরা দীপনকে হারিয়ে অনেক কষ্টে আছি। মা-বাবাও ভেঙে পড়েছেন। দীপনের মতো অন্য কাউকে যেন এভাবে চলে যেতে না হয় আমরা এ প্রত্যাশা করছি।

 

তিনি বলেন, ‘মামলার তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ডিবি থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তারা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে দুজন আসামি তারা গ্রেপ্তার করেছে। আসামিরা আদালতে স্বীকারোমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে।

 

তিনি বলেন, জাতীয় স্বার্থে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে এ ধারাবাহিকতা থেকেই যাবে। অপশক্তি আরো বেশি শক্তিশালী হবে, শুভশক্তির শক্তি কমে যাবে।’

 

দীপনের স্মরণে ‘দীপন স্মরণ’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আজ ৩১ অক্টোবর টিএসসিতে বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে এ অনুষ্ঠান শুরু হবে। সমাজের বিশিষ্টজনের পাশাপাশি ওই অনুষ্ঠানে সবার অংশগ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।

 

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে পৌনে ৪টার মধ্যে ‘জাগৃতি’ প্রকাশনী অফিসে ঢুকে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করে। এরপর ২ নভেম্বর দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

 

অপরদিকে একই দিনে মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া সি ব্লকের ৮/১৩ নম্বরে ‘শুদ্ধস্বর’ নামে একটি প্রকাশনা অফিসে আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, লেখক তারেক রহিম ও রন দিপম বসু ওরফে সুদ্বীপকে কুপিয়ে ও গুলি করে গুরুতর জখম করে দুর্বৃত্তরা। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩ নভেম্বর প্রকাশক টুটুল বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় আসামি সুমন হোসেন ওরফে শাকিব ওরফে শিহাব ওরফে সাইফুল গত ২১ জুন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে। এ ছাড়া এ মামলায়ও জঙ্গি মো. আব্দুস সবুর ওরফে আব্দুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে সাজু ওরফে সাদ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

 

মামলার তদন্ত সূত্র জানায়, গত ৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশক দীপন হত্যা ও টুটল হত্যা চেষ্টার সঙ্গে জড়িত মাস্টারমাইন্ড মো. আব্দুস সবুরকে টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। টুটুল হত্যা চেষ্টায় জড়িত এবিটি সদস্যদের অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া, ঘটনাস্থল রেকি ও অপারেশন পরিকল্পনা তৈরি করা ছাড়াও ওই হামলার সার্বিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেছে ওই জঙ্গি। তিনি মোহাম্মদপুরে নবোদয় হাউজিংয়ে এবিটির বোমা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেন ও বাড্ডার সাঁতারকুলে এবিটির নতুন আস্তানার প্রশিক্ষকও ছিলেন।

 

গত ১৫ জুন বিমানবন্দর এলাকা থেকে প্রকাশক টুটুল হত্যা চেষ্টায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী আসামি মো. সুমন হোসেনকে ও গত ২৩ আগস্ট প্রকাশক দীপন হত্যায় জড়িত আসামি মাইনুল হাসান শামীমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাস্টারমাইন্ড মো. আব্দুস সবুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য ডিএমপি থেকে দুই লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। সে এবিটি সামরিক শাখার শীর্ষ চারজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির একজন।

 

এদিকে গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে বইমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে মুক্তমনা ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে।

 

গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই দিন রাত ১০টা ২০ মিনিটে অভিজিৎ রায় মারা যান। গুরুতর আহত বন্যাকে পরে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।

 

ওই হত্যাকাণ্ডের পরের দিন শাহবাগ থানায় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন অভিজিতের বাবা শিক্ষাবিদ ড. অজয় রায়। ওই মামলায়ও এখনো অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেনি পুলিশ।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ অক্টোবর ২০১৬/মামুন খান/এসএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়