ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

মৃত্যুর পরও অসম্ভব জনপ্রিয় এক কিংবদন্তি

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:২১, ২৯ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মৃত্যুর পরও অসম্ভব জনপ্রিয় এক কিংবদন্তি

মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন

শাহ মতিন টিপু : তিনি ছিলেন ‘পপ কিং। একাধারে সংগীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী এবং সমাজসেবক। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে সর্বকালের সবচেয়ে সফল শিল্পী তিনি। ১৩টি গ্র্যামি পুরস্কার, ১৩টি ১ নম্বর একক সংগীত এবং ৭৫ কোটি অ্যালবাম বিক্রির রেকর্ড রয়েছে তার। শিল্পী হিসেবে পুরো বিশ্বে তার খ্যাতি ছিল। প্রায় ৪০ বছর ধরে সারা বিশ্বে বিখ্যাত হয়েছিলেন। কিংবদন্তি এই সংগীতশিল্পীর জন্মদিন আজ। এই বিখ্যাত শিল্পীকে জানে না, এমন কোনো সংগীত শ্রোতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি মাইকেল জ্যাকসন। পুরো নাম মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন।  

১৯৫৮ সালের ২৯ আগস্ট জন্ম তার। গ্যারি ইন্ডিয়ানায়। তখনো দুনিয়া টের পায়নি, পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটেছে এক অসাধারণ গাইয়ে তারকার, যার আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। বাবা-মা যথাক্রমে জোসেফ ওয়াল্টার জ্যাকসন ও ক্যাথরিন জ্যাকসন। পাঁচ ভাই ও তিন বোন, সবাই কোনো না কোনো সময় পেশাগতভাবে সংগীতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিশেষ করে ছোট বোন জ্যানেট জ্যাকসন একজন সফল সংগীতশিল্পী।

জ্যাকসন পরিবারের সপ্তম সন্তান মাইকেল মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ১৯৬৩ সালে পেশাদার সংগীতশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। গায়ক হিসেবে জ্যাকসনের উত্থান কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকেই। তিনি তখন জ্যাকসন ফাইভ নামের সংগীতগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে গান গাইতেন।

১৯৭১ সাল থেকে মাইকেল একক শিল্পী হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন। মাইকেলের গাওয়া পাঁচটি সংগীত অ্যালবাম বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রীত রেকর্ডের মধ্যে রয়েছে- অফ দ্য ওয়াল (১৯৭৯), থ্রিলার (১৯৮২), ব্যাড (১৯৮৭), ডেঞ্জারাস (১৯৯১) এবং হিস্টরি (১৯৯৫)।

মাইকেল জ্যাকসনের বাবা জোসেফ জ্যাকসন একটি কারখানায় চাকরি করতেন। এর পাশাপাশি ভাই লুথারকে নিয়ে ‘দি ফ্যালকন’ নামের একটি ব্যান্ড দল বানিয়েছেন, বিভিন্ন জায়গায় তিনি গান গেয়ে বেড়ান। বলা যায় শ্রমিকের কাজ করলেও গানের প্রতি বেশ দুর্বলতা ছিল তার। এই দুর্বলতা তার ছেলেমেয়েদের ওপরেও বেশ প্রভাব ফেলেছিল, বিশেষ করে তার ৯ ছেলেমেয়ের মধ্যে সপ্তম ছেলেটির ওপরে। আর তা এতটাই যে, পরবর্তী সময়ে তিনিই হয়ে ওঠেন বিশ্বের ‘কিং অব পপ’।

১৯৮০-র দশকে মাইকেল সংগীতশিল্পীদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছান। তিনি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সংগীতশিল্পী যিনি এমটিভিতে এত জনপ্রিয়তা পান। বলা হয়, তার গাওয়া গানের ভিডিওর মাধ্যমেই এমটিভির প্রসার ঘটেছিল। গানের তালে তালে মাইকেলের নাচের কৌশলগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মাইকেলের জনপ্রিয় নাচের মধ্যে রবোট, ও মুনওয়াক (চাঁদে হাঁটা) রয়েছে। মুনওয়াক আসলে হলো সামনের দিকে হাঁটার দৃষ্টিভ্রম সৃষ্টি করে পিছনে যাওয়ার ভঙ্গিমা। এখনো সারা বিশ্বের খ্যাত নৃত্যশিল্পীদের কাছে মাইকেল জ্যাকসনকে  শ্রদ্ধা কুড়ান।

পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটেছে অসাধারণ গাইয়ে তারকার, যার আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে- এটা যেমন মানুষের কাছে অজানা ছিল; ঠিক তেমনি কেউ জানত না, তার জীবন প্রদীপ নিভে যাবে এত তাড়াতাড়ি মাত্র ৫০ বছর বয়সেই। বিখ্যাত এই পপ গায়ক মৃত্যুবরণ করেন ২০০৯ সালের ২৫ জুন। তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয় তারই ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. কনরাড মারেকে এবং সে কারণে তাকে চার বছরের জন্য কারাদণ্ডও দেওয়া হয়। ওষুধের প্রভাবে মৃত্যু হয়েছিল বিশ্বসংগীতের এই কিংবদন্তির।

মৃত্যুর পর সংগীতের ইতিহাসে জনপ্রিয়তার হিসাব-নিকাশ অনেকটাই বদলে দিয়েছেন মাইকেল জ্যাকসন, গড়েছেন নিত্যনতুন সব রেকর্ড। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যাওয়ার পর সে বছরই সর্বাধিক বিক্রীত অ্যালবামের শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হন জ্যাকসন। মৃত্যুর এক বছরের মাথায় কেবল আমেরিকাতেই তার অ্যালবাম বিক্রি হয় ৮.২ মিলিয়ন কপি। আর বিশ্বজুড়ে বিক্রি হয় ৩৫ মিলিয়ন।

মৃত্যুর পর গান ডাউনলোডের ইতিহাসেও রেকর্ড গড়েন ‘পপ কিং’। মাত্র এক সপ্তাহে পয়সা খরচ করে জ্যাকসনের ১০ লাখ গান ডাউনলোড করে তার ভক্তরা। এর আগে এত কম সময়ে আর কোনো শিল্পীর এত বেশিসংখ্যক গান ডাউনলোড হয়নি।

জ্যাকসনের মৃত্যুর পর তার নির্বাচিত গান নিয়ে প্রকাশিত তিনটি অ্যালবাম এত বেশি বিক্রি হয় যে, কোনো জনপ্রিয় শিল্পীর নতুন অ্যালবামও এত বিক্রি হয়নি। এ ছাড়া এক বছরে সর্বাধিক বিক্রীত সেরা বিশের তালিকায় জায়গা করে নেয় জ্যাকসনের চার-চারটি অ্যালবাম। আমেরিকার সংগীতের ইতিহাসে আর কোনো শিল্পীর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি।

২০১৫ সাল পর্যন্ত জ্যাকসনের গানের পরিবেশক সংস্থা হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল সনি মিউজিক। কিন্তু পপ কিংয়ের মৃত্যুর পর তার গানের বিক্রি ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় ২০১০ সালে জ্যাকসন এস্টেটের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করে সনি মিউজিক। নতুন চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৭ সাল পর্যন্ত জ্যাকসনের গানের স্বত্ব কিনে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।

২০১০ সালের নভেম্বরে জ্যাকসনের অপ্রকাশিত গান নিয়ে ‘মাইকেল শিরোনামের অ্যালবাম প্রকাশের ঘোষণা দেয় সনি মিউজিক। অ্যালবামটি মুক্তি পায় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। এর গানগুলোতে জ্যাকসনের সঙ্গে আরো কণ্ঠ দিয়েছিলেন একন, ফিফটি সেন্ট প্রমুখ। এই অ্যালবামের জন্য জ্যাকসন এস্টেটের সঙ্গে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে সনি মিউজিক। একক কোনো গায়কের সঙ্গে সবচেয়ে ব্যয়বহুল চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয় এটি।

জ্যাকসনের জীবনের আরো কিছু ব্যক্তিগত তথ্য এই যে, ওর বাবা রাগি মানুষ ছিলেন। ছেলেমেয়েদের খুব মারধর করতেন। ছোট্ট জ্যাকসনকেও কারণে-অকারণে মারতেন। জ্যাকসনের ভাই মারলন এ ব্যাপারে বলেছিলেন, “বাবা সবাইকেই মারত, তবে জ্যাকসনটাই বোধ হয় মারটা বেশি খেত। বাবা প্রায়ই তাকে পা ধরে উল্টো করে ঝুলিয়ে বেদম পেটাতেন, আমরা অন্য ভাইবোনরা কিছুই বলতাম না। কারণ বাবা আমাদেরও মারতেন, আমরা বড় ছিলাম বলে উল্টো করতে পারতেন না, তবে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতেন নয়তো দেয়ালের সঙ্গে ঠেসে রাখতেন। জ্যাকসন নিজেও এই কথা স্বীকার করেছেন। তিনি কিন্তু আরো বলেছিলেন, ‘বাবা মারধর করলেও তার নিয়মানুবর্তিতার তুলনা ছিল না, আমার সফলতার পেছনে যে ডিসিপ্লিন, এটা আমি তার কাছ থেকেই পেয়েছিলাম।’

২০০৫ সালে চাঁদে ১২০০ একরের প্লট কিনেছিলেন ‘পপ কিং’ মাইকেল জ্যাকসন। তার মৃত্যুর পর চাঁদের একটি আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের নাম পরিবর্তন করে ‘মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন’ রাখা হয়। জ্যাকসনকে সম্মান জানাতেই এমনটা করেছিল দ্য লুনার রিপাবলিক সোসাইটি।

মৃত্যুর বছর খানেক আগে অর্থাৎ ২০০৮ সালে অনেক সংবাদমাধ্যমে মাইকেল জ্যাকসন ইসলামে রূপান্তরিত হয়েছিলেন বলে ছড়িয়ে পড়ে। এই তথ্যের মূল উৎস দি সান নামক যুক্তরাজ্যের একটি বিখ্যাত ট্যাবলয়েড।

২০০৯ সালের মার্চে মঞ্চে ফিরে আসবেন ঘোষণা দিয়ে ভক্তদের মাঝে নতুন করে চাঞ্চল্য তৈরি করেন। তিনি আবারো আগের মতো ‘পারফর্ম’ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও, ‘দিস ইজ ইট’ নামের শো দেখার জন্য টিকিট কেনার ‘ক্রেজ’ প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যায়। দুঃখজনকভাবে লন্ডনে প্রথম শো করার ঠিক ১৮ দিন আগেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে তার মৃত্যুসংবাদ।

 

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ আগস্ট ২০১৫/টিপু/এএন

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ