ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

জীবন দিয়ে বাঁচালেন সহযোদ্ধাদের

রেজাউল করিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫১, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জীবন দিয়ে বাঁচালেন সহযোদ্ধাদের

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের কবর (ইনসেটে মু্ন্সী আব্দুর রউফ)

রেজাউল করিম, চট্টগ্রাম: চারদিকে স্বচ্ছ নীল জলরাশি। মধ্যখানে একটি পাহাড়। সেই পাহাড়েই শুয়ে আছেন জাতির সাত শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। তিনি বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ।

 

১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল পাকবাহিনীর সঙ্গে বীরদর্পে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন এ বীর সন্তান। বাংলাদেশ বিডিআরে কর্মরত মুন্সী আব্দুর রউফ ছিলেন ল্যান্স নায়েক।  

 

২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু হলে বিডিআর দলের সঙ্গে তিনিও ছুটে আসেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাটে শত্রুবাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলে মুন্সী আব্দুর রউফ বীরদর্পে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। শত্রুবাহিনীর তিনটি নৌযান একাই ধ্বংস করেন তিনি।

 

তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর নেমেছিল কাপ্তাই হ্রদের বুকে। চিংড়িখাল বরাবর উত্তর-দক্ষিণের হ্রদের ছোট এক টুকরো দ্বীপের ওপর প্রতিরক্ষা বুহ্য তৈরি করে শত্রুপক্ষের গতিবিধি লক্ষ্য রাখার জন্য মেশিনগানার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন অষ্টম ইস্টবেঙ্গল ও ইপিআরের (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, বর্তমানে বিজিবি) সদস্য ল্যান্স নায়ক মুন্সী আব্দুর রউফ।

 

এ সময় তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছিল পাকবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানির অধিক সৈনিক। তারা ভারি অস্ত্র সহকারে তিনটি লঞ্চ ও দুটি স্পিডবোট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানকে চারদিক ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর মর্টারশেল ও অন্যান্য ভারি অস্ত্র দিয়ে গোলাবর্ষণের ফলে তাদের প্রতিরক্ষা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।

 

তবে সেখানে দায়িত্বরত ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ শত্রুপক্ষের প্রবল গোলাবর্ষণের মুখেও মেশিনগান নিয়ে নিজ অবস্থানে স্থির ছিলেন। তিনি তার নিজস্ব অবস্থান থেকে মেশিনগান দিয়ে শত্রুর ওপর গুলিবর্ষণ অব্যাহত রেখে সহযোদ্ধা সব সদস্যকে নিরাপদে পশ্চাদপসারণে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে পরিখা থেকে বের হয়ে গুলিবর্ষণ অব্যাহত রেখে পাকবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রাখেন তিনি। মেশিনগান তুলে ধরে অবিরাম গুলি ছুঁড়তে থাকেন সরাসরি শত্রুর স্পিডবোটগুলোকে লক্ষ্য করে।

তার অসীম সাহস ও দুর্দান্ত মেশিনগানের গুলির আঘাতে শত্রুপক্ষের দুটি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোট পানিতে ডুবে যায়। এতে দুই প্লাটুন পাকসেনার সলিল সমাধি হয়। বাকি দুটি স্পিডবোট এই অবস্থা দেখে দ্রুত পশ্চাদপসারণ করে মুন্সী আব্দুর রউফের মেশিনগানের রেঞ্জের বাইরে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। কিন্তু হঠাৎ পাকবাহিনীর একটি মর্টারের গোলা তার ওপর আঘাত করে। এতে তিনি শহীদ হন।

 

মুন্সী আব্দুর রউফের অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ পদক্ষেপের ফলে শত্রুবাহিনী মহালছড়িতে মুক্তিবাহিনীর মূল অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। তিনি তার জীবন উৎসর্গ করে কর্তব্যপরায়ণতা ও দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তার অনন্য সাধারণ ত্যাগ ও অসাধারণ বীরত্বের জন্য তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধি দেওয়া হয় ।

 

যুদ্ধকালে তার ঘনিষ্ঠ ছিলেন সহযোদ্ধা রবার্ট রোনাল্ড পিন্টু। বর্তমানে কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনায় অবস্থানরত এই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বলেন, সেসময় পাক বাহিনীর গোলার আঘাতে আমাদের নৌযানও ধ্বংস হয়েছিল। আমরা বেশ কয়েকজন সাঁতরে পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নেই। মুন্সী আব্দুর রউফকেও সেখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য অনেক ডাকাডাকি করি। কিন্তু তিনি বললেন, তোমরা নিরাপদে সরে যাও। আমি যুদ্ধ চালিয়ে যাব। এক সময় পাকবাহিনীর ছোঁড়া মর্টারের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় মুন্সী আব্দুর রউফের শরীর।

 

এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দয়াল কৃষ্ণ চাকমা নামের একজন তার ছিন্ন ভিন্ন শরীর একসঙ্গে করে সেখানেই সমাধিস্থ করেন।

 

স্বাধীনতার ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালে তার সমাধিস্থল চিহ্নিত করা হয়। এরপর থেকে স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় তার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়। আর তার বীরমাতা মুকিদুন্নেসাকে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও বিজিবির পক্ষ থেকে সম্মাননা দেওয়া হয়।

 

রাঙামাটিবাসী প্রতিনিয়ত শ্রদ্ধায় অবনত হয় এই বীর শহীদের প্রতি। রাঙামাটি শহরের প্রবেশপথেই মানিকছড়িতে নির্মিত হয়েছে এই শহীদের সুবিশাল ভাস্কর্য। বুড়িঘাটে তার সমাধিস্থলটিও এমনভাবে সাজানো, যেনো সবুজ পাহাড় আর হ্রদের বুকে ভাসমান সাদা পদ্ম, রাঙামাটি শহরের শহীদ মিনার চত্বরে তার একটি ম্যুরাল আছে। এ ছাড়া তার নামে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্লাব ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

 

প্রসঙ্গত, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ ১৯৪৩ সালে ১ মে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সালামতপুরে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মুন্সী মেহেদী হোসেন ও মার নাম মুকিদুন্নেসা। তিনি ১৯৬৩ সালের ৮ মে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে সৈনিক পদে যোগদান করেন।

 

 

রাইজিংবিডি/চট্টগ্রাম/৫ ডিসেম্বর ২০১৬/রেজাউল করিম/রিশিত/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়