ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

৪৪ বছরেও বাস্তবতা মেনে নিতে পারেনি পাকিস্তান

নওশের || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৮, ৩০ নভেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
৪৪ বছরেও বাস্তবতা মেনে নিতে পারেনি পাকিস্তান

আলী নওশের : মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড ২১ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর করা হয়। এই দণ্ড কার্যকর করা প্রসঙ্গে ২২ নভেম্বর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি ইস্যু করা হয়।

 

বিবৃতিতে বিচারের ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে এবং বিচারকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নামান্তর হিসেবে উল্লেখ করে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়েছে। পাকিস্তান মিথ্যাচারের সীমা লঙ্ঘন করে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় (ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান) চুক্তির ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে।

 

সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে এর কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। বাংলাদেশের সব মানুষ প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। অভিজ্ঞ কূটনীতিকদের মতে এটি সম্পূর্ণ কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজ এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। পাকিস্তান কিছুতেই এটি করতে পারে না। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত, অগ্রহণযোগ্য।

 

অত্যন্ত হাস্যকর বিষয় হলো বিচারের দণ্ড কার্যকর হয়েছে বাংলাদেশে, আর কান্নাকাটি করছে পাকিস্তান! তাদের এই কর্মকাণ্ডেই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হচ্ছে। পাকিস্তান বলছে, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদেরই বিচার করা হচ্ছে। এ কথা অবশ্য সঠিক, একাত্তরে যারা পাকিস্তানের পক্ষে, মানে বাংলাদেশের বিপক্ষে ছিল, বিচার হচ্ছে তাদেরই। তবে সব পাকিস্তানপন্থির বিচার হচ্ছে না আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। যারা একাত্তর সালে পাক হানাদারদের সহায়ক শক্তি হিসেবে খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজের মতো সুনির্দিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল; শুধু তাদেরই বিচার হচ্ছে। তাই সুনির্দিষ্ট অপরাধে অভিযুক্ত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার কারও নেই।

 

বাস্তবতা হলো, ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনের আওতায় গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের যে বিচার হচ্ছে, তা ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতে কোথাও মানবতাবিরোধী কোনো অপরাধের বিচারের প্রশ্ন এলে তার মানদণ্ড হবে বাংলাদেশ। কারণ এই আইনেই অভিযুক্তদের মানবাধিকার সবচেয়ে ভালোভাবে রক্ষিত হয়েছে, তাদের আইনের সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে উম্মুক্ত আদালতে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হচ্ছে। তারা ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারছেন, আপিলের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে পারছেন। এমনকি রাষ্ট্রপতির অনুকম্পাও চাইতে পারছেন। বিশ্বের অনেক দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের আপিল করারই সুযোগ নেই।

 

আর মানবতাবিরোধী অপরাধ কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হয় না, হয় গোটা মানবতার বিরুদ্ধে। তাই কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ক্ষমা করারও কোনো সুযোগ নেই। এদিকে যে নয়া দিল্লি চুক্তির দোহাই দিয়ে পাকিস্তান বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে তাতেও স্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী, ভারতের আটক ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

 

সুতরাং ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়ার কথা কখনও বলা হয়নি। বাংলাদেশের নাগরিক, যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক হয়ে হত্যা, গণহত্যা চালিয়েছে, তাদের ব্যাপারে চুক্তির কোথাও কিছু বলা হয়নি। সুতরাং সাকা, মুজাহিদ, কাদের মোল্লার বিচার ও দণ্ডাদেশ নিয়ে কথা বলার কোনো অধিকার পাকিস্তানের নেই। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক আইন ও রীতি অনুযায়ী গণহত্যার কোনো ক্ষমা হয় না। ১৯৬৯ সালে গৃহীত ভিয়েনা কনভেনশনের ৫৩ নম্বর ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, গণহত্যাকারীকে কেউ যদি ক্ষমা করেও থাকে, তবে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।

 

একাত্তরের ঘটনা তদন্তে পাকিস্তান হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে যে কমিশন গঠন করেছিল, সেই কমিশনের রিপোর্টেও পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসরদের যুদ্ধাপরাধের বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ এবং কয়েকজন সামরিক কর্তার শাস্তির সুপারিশ করা হয় । কমিশন পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংসতা, অবাধ নিষ্ঠুরতা ও অনৈতিকতা তদন্তে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আদালত বা কমিশন গঠনেরও সুপারিশ করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান কিছুই করেনি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণহত্যার একটি হয়েছিল বাংলাদেশে, সেটি বরাবরই পাকিস্তান আড়াল করে রেখেছে, অস্বীকার করেছে। ১৯৭৪ সালে নয়াদিল্লি চুক্তিতে পাকিস্তান কোনো রকমে নিজেদের বন্দীদের ছাড়িয়ে নিতে ক্ষমা চাইলেও পরে বারবার প্রমাণ করেছে একাত্তরের জন্য তারা অনুতপ্ত নয়। আর এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তারা বুঝিয়ে দিচ্ছে, নিজেদের অবস্থান থেকে তারা একটুও সরে আসেনি।

 

প্রসঙ্গত, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দণ্ড দেওয়ায় পাকিস্তান ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত পাঁচবার বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব এনে সরাসরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলিয়েছে। তারা যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে শহীদ ঘোষণা করেছে। এগুলো যে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য সহায়ক নয়, সেটি বাংলাদেশ স্পষ্ট করেই বলেছে। কিন্তু আমলে নেয়নি পাকিস্তান। সাকা, মুজাহিদদের ফাঁসির শোক যেন পাকিস্তান কাটিয়ে উঠতে পারছে না। দু-তিন দিন আগেও পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তারা পুনরায় কটাক্ষ করেছে।

 

পাকিস্তানের মানবাধিকার নেত্রী আসমা জাহাঙ্গীর বলেছেন, পাকিস্তানের বিবৃতিতে প্রমাণিত হয় সাকা, মুজাহিদ পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছিল। সুতরাং এটা আদর্শগত দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ, যার শুরু ১৯৫২ সালে; যার একটির আপাত পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে। কিন্তু ৪৪ বছরেও পাকিস্তান বাস্তবতা মেনে নিতে পারেনি।

 

সোমবার দেশটি আবার চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছে পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাহকমিশনারকে ডেকে। বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে ডেকে বাংলাদেশ যে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল তার পাল্টা হিসেবে এটি করেছে তারা।

 

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কাজি খলিলুল্লাহ সোমবার এক বিবৃতিতে জানান, পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ও সার্কবিষয়ক মহাপরিচালক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশি হাইকমিশনারকে (ভারপ্রাপ্ত) বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনারকে যে ভিত্তিহীন অভিযোগে প্রতিবাদ জানিয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করছি আমরা।

 

কাজি খলিলুল্লাহ আরো বলেন, ‘পাকিস্তানকে অবমাননা করতে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় পাকিস্তান। তিনি আরো বলেন, দুই দেশের মানুষ শুধু সম্পর্ক ধরে রাখতেই চায় না, তারা বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব আরো শক্তিশালী চায়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এই আবেগ বুঝতে পারেনি।’

 

যদিও এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কিন্তু পাকিস্তান যে ‘দুই দেশের মানুষ শুধু সম্পর্ক ধরে রাখতেই চায় না, তারা বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব আরো শক্তিশালী চায়’বলে উল্লেখ করেছে তা তাদের কার্যকলাপে পরিস্ফুট হয় না। এটি একটি বিতর্কিত বক্তব্য।

 

পাকিস্তানের এ অবস্থান একদিকে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যাকে অস্বীকার; অন্যদিকে চার দশক আগে ঘটে যাওয়া অপরাধের বিচার নিশ্চিত করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধে বাংলাদেশের প্রয়াসের অব্যাহত বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ।

 

কিন্তু পাকিস্তানের যে চরিত্র, তাতে তারা এমন বিবৃতি দেওয়াই স্বাভাবিক। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক কথা হলো-একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে হবে। এর থেকে পাকিস্তান আজ পর্যন্ত এক ইঞ্চিও সরে আসেনি। সুতরাং এই নীতির আওতায় পাকিস্তান কী ধরনের কার্যক্রম চালাচ্ছে, সেটি আমাদের উপলব্ধিতে থাকতে হবে যাতে যথাসময়ে পাকিস্তানের সব দুরভিসন্ধিকে আমরা প্রতিহত করতে এবং যথোপযুক্ত জবাব দিতে পারি।






রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ নভেম্বর ২০১৫/নওশের/উজ্জল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়