নাট্য-সাহিত্যে স্মরণীয় সংলাপ
ড. তানভীর আহমেদ সিডনী || রাইজিংবিডি.কম
ঢাকার মঞ্চে ‘হ্যামলেট’ নাটকের একটি দৃশ্য
ড. তানভীর আহমেদ সিডনী : সংলাপই নাটকের শরীর, সংলাপ ছাড়া নাটকের শরীর নির্মিত হতে পারে না। আবার নাটকের শরীরে সংলাপ প্রোথিত, অর্থাৎ একের সঙ্গে অন্যের অন্বয়। এরই ধারাবাহিকতায় সংলাপ আপন পথ নির্মাণ করে। কখনো কখনো কোনো একটি নাটকের সংলাপ কাল অতিক্রম করে সর্বকালীন হয়ে যায়। হয়তো তা নাটকের ঘটনাকে অগ্রসর করে কিংবা নাট্যঘটনায় নতুন একটি পর্ব সৃজন করে। কিন্তু নাটকে রচিত সংলাপ কখনো হাজার বছর, কখনো শত বছর ধরে মানব মনে চিরায়ত স্থান করে রাখে।
সফোক্লিস রচিত ‘ইডিপাস’ নাটকের জোকাস্ট্রার সংলাপ গ্রিক যুগ পেরিয়ে আজও আমাদের মনে ঠাঁই করে নিয়েছে। এই নাটকে ইডিপাসকে বলে জোকাস্ট্রা- ‘অধিক সত্য জানতে চেও না।’ নাট্যঘটনায় সংলাপটি যেমন বিশেষ একটি পরিস্থিতি তৈরি করে অনুরূপ কাল পেরিয়ে বর্তমান কালেও তা অনিবার্য সত্য হিসেবে চিত্রায়িত হয়। আবার শেক্সপিয়ার রচিত নাটকের সংলাপ ‘to be or not to be that is the question.’ এই সংলাপ এখন আর শেক্সপিয়ারের সংলাপ নয় বরং আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে যে কোনো সংশয়ে আমরাও হ্যামলেটের মতো নিজে নিজে উচ্চারণ করি ইংরেজ এই নাট্যকারের সংলাপ।
শেক্সপিয়ারের বিভিন্ন নাটকে অসংখ্য সংলাপ আছে যা চিরায়ত বাণী হতে পারে অনায়াসে। এমনি একটি নাটক ‘এন্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’। এই নাটকের বিখ্যাত সংলাপ হলো, ‘পৃথিবীর কোনো সুন্দরী নারীর মুখে নেই সততার চিহ্ন’। এই সংলাপ নাটককে মুছে দেয়, এখানেই নাট্যকারের কৃতিত্ব। তিনি সংলাপের শক্তিতে বেঁচে থাকেন। কখনো এমনও হয় যে, আমরা সংলাপ বলছি অথচ জানিও না কে লিখেছে? কিন্তু সংলাপ ঠাঁই নিয়েছে আমাদের অন্তরে। এখানে ঠাঁই করার অর্থ কোনো একটি নাটকের সংলাপ রচনাকালে সেই সংলাপটি জনপ্রিয় হয় সেই কালের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু পরবর্তী কালে সংলাপটি পূর্বের আবেদন হারায়।
এ স্বল্প পরিধিতে এখানে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। শুধু একটি বিষয় লিখে রাখা প্রয়োজন আর তা হলো, কোনো একটি নাটক মঞ্চায়িত হওয়া সাপেক্ষে তার সংলাপের জনপ্রিয়তা নির্ধারিত হয়।
বাঙালির প্রাচীন নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ থেকে উল্লেখযোগ্য সংলাপ নির্ধারণ করা যায়। চর্যাপদে ‘বীণা পা’ রচনা করেন-
নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী।
বুদ্ধ নাটক বিসমা হোই॥
শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের কাছে এই বাণী যেন ইতিহাসের উপাদান। একইভাবে আরেকটি চর্যার কথা না লিখলে চর্যাপদের শিল্প সুষমাময় পদগুলো আমাদের সমুখে আসে না। চর্যাপদে লেখা হয়েছে-
এক সো পদমা চউসটঠী পাখুড়ি।
তহি চড়ি নাচই ডোম্বি বাপুড়ি॥
[অর্থ : একটি সেই পদ্ম, তার চৌষট্টি পাপড়ি/ডোম্বী বেচারী তার উপর চড়ে নাচে।]
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাঙালির ঘরে ঘরে পাঠের পাশাপাশি আসরে পরিবেশিত হতো এককালে। এর কোনো কোনো অংশ ধ্রুপদী উচ্চতায় উপনীত হয়। রাধার সংলাপ শুনে উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলী শোকের পথে পা বাড়ায়। রাধা বলে-
ধিক জাউ নারীর যৌবনে
মোর দুই আখি ধারা শ্রাবণে।
এ যেন আধুনিক এক নারীবাদীর উচ্চারণ, যে তার শোক আর ক্রোধ মিলিত করে শব্দ সমাবেশ ঘটান। রাধার আরেকটি সংলাপের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। যেখানে সে বলছে-
বিরহে পোড়েক সব গাএ
কাহ্ন নিলজ মামীকে রতি চাহে।
এই সংলাপের পথে রাধার ব্যক্তিগত বেদনা আর ব্যক্তিগত থাকে না। সামষ্টিক সমাজে তা ছড়িয়ে যায় আবার ব্যক্তির বেদনায় রূপ নেয়। মধ্যযুগের আরেক কবি আবদুল হাকিম। তার ‘য়ুসুফ-জুলেখা’ কাব্যগ্রন্থে রচনা করেন, “যে সবে আশেক জানে মাশুকের মন।’ প্রেমের এই চিরায়ত বাণীকে অস্বীকার করা যায় কোন অধিকারে?
ইংরেজ শাসনামলে বাংলাদেশের থিয়েটার একটি নতুন পথ তৈরি করে নেয়। পাশ্চাত্য প্রভাবিত এই থিয়েটারে বেশ কিছু জনপ্রিয় নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। উল্লেখ্য এই সময়ে পেশাদারি থিয়েটার গঠনের কাজও শুরু হয়েছিল। ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচনা করেন সেই সংলাপ যা আজও স্মরণীয়। তিনি লেখেন-
অলীক কুনাট্য রঙ্গে
মজে লোক রাঢ় বঙ্গে,
নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।
এ যেন বাংলা নাটকের অন্ধকার কালের দিকে তাকিয়ে বেদনায় সে কথা হৃদয়াঙ্গম করে বলা। ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকে রচিত সংলাপ চিরায়ত বাক্যে পরিণত হয়েছে। যেমন, ‘সুপাত্রে প্রদত্তা কন্যা পিতামাতার অনুশোচনীয়া হয় না।’ ‘অমৃতাভিলাষী ব্যক্তির কি কখনও মধুতে তৃপ্তি জন্মে?’ ‘শোকানল কখনও চিরস্থায়ী নয়।’ কিংবা ‘বিধাতা স্ত্রীজাতিকে পরাধীন করে সৃষ্টি করেছেন” ইত্যাদি। এই চিরায়ত উক্তি বা সংলাপ পাঠক-দর্শক চিত্তে বাণীসমূহ বহনের সুযোগ তৈরি করে দেয়।
দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘সধবার একাদশী’তে অসংখ্য নাট্যসংলাপ আছে যাতে মদ্যপানের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত তৈরি করে। কিন্তু এর একটি সংলাপ আজকালকার সময়ের সঙ্গেও মিলে যায়। নাটকে সরকারি আমলা কেনারাম বলেন, ‘মদ খেয়ে যদি অল্পবয়সে মরে যাই, তা হলে প্রোমোসানও পাব না...।’ একইসঙ্গে গিরিশ ঘোষের ‘জনা’ নাটকের কথাও মনে পড়ছে। সেখানে গঙ্গাদেবীকে জনা বলছে-
মা হয়ে, মা, মায়ের মনে ব্যথা দিও না, জননী
সমর-সাগরে-ঘোরে সঁপি গো নয়নমণি!
সে সময় পুরাণের প্রতি জন সাধারণের সংযোগ ছিল বলেই এমন উচ্চারণ জনপ্রিয় হয়েছিল। নাটকের চেয়ে সংলাপই প্রধান হয়। এখানে সংলাপ নিয়ন্ত্রণ করে নাটককে। গিরিশ ঘোষের আরেকটি সংলাপ ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সে সময়।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত ‘সাজাহান’ মঞ্চে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই নাটকে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সংলাপে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর প্রেমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্তানের প্রতি বাৎসল্য। এ যেন প্রত্যেক পিতার অন্তরের কথা, যা বহমান। সেই আলোচিত সংলাপ উদ্ধৃত হলো-
সাজাহান॥ আমার হৃদয় এক শাসন জানে। সে শুধু স্নেহের শাসন। বেচারা মাতৃহারা পুত্রকন্যারা আমার। তাদের শাসন করবো কোন প্রাণে জাহানারা ! ঐ চেয়ে দেখ্ ঐ স্ফটিকে গঠিত (দীর্ঘনিশ্বাস) ঐ তাজমহলের দিকে চেয়ে দেখ্- তারপর বলিস্ তাদের শাসন কর্তে।
একই নাটকের আরেকটি সংলাপ আছে যা আমাদের ভাবনায় তাড়ন তৈরি করে। সেই সংলাপে একজন বাবা যুদ্ধ থামাতে চান। কেননা তিনি জানেন যুদ্ধে একজনকে হারাবেন তিনি। তখন একজন বাবার সঙ্গেই সাক্ষাৎ হয় আমাদের। পাঠক, সংলাপটি এ রকম-
সাজাহান ॥ তর্ক করিস না জাহানারা। আমার কোনো যুক্তি নাই। আমার কেবল এক যুক্তি আছে। সে স্নেহ। আমি শুধু ভাবছি, এ যুদ্ধে যে পক্ষেরই পরাজয় হয়, আমার সমান ক্ষতি।
রবীন্দ্রনাটকে সংলাপ বরাবরই দার্শনিক সত্যে উপনীত হতে চায়। তার নাটকের অসংখ্য সংলাপ দর্শকের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকবে এমন আশা করা গেলেও কার্যত তা ঘটেনি। তার কারণ নাট্য প্রযোজনা, উপস্থাপনের দুর্বলতা। স্বল্পসংখ্যক সংলাপই আমাদের মনে বসবাস করে। সেটি অবশ্য প্রযোজনার গুণে নয়, রবীন্দ্র সাহিত্যের শক্তিতে। তেমনি কয়েকটি সংলাপ বিভিন্ন নাটক থেকে উদ্ধৃত করা হলো :
‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটকে চিত্রাঙ্গদা প্রেমিক অর্জুনকে বলছে-
দেবী নহি, নহি আমি সামান্যা রমণী।
... ..
যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরী,
আমার পাইবে তবে পরিচয়।
‘বিসর্জন’ নাটকে জয়সিংহের মনে সংশয় জন্মে, সে বলে-
আজন্ম পূজিনু তোরে তবু তোর মায়া
বুঝিতে পারি নে। করুণায় কাঁদে প্রাণ
মানবের, দয়া নাই বিশ্বজননীর।
‘রাজা’ নাটকে সুদর্শনাকে রাজা বলেন, ‘যে কালো দেখে আজ তোমার বুক কেঁপে গেছে সেই কালোতেই একদিন তোমার হৃদয় স্নিগ্ধ হয়ে যাবে। নইলে আমার ভালোবাসা কিসের।’
এমন অসংখ্য উদাহরণে এই লেখাটি ভরে উঠবে। এখানে যে সত্য প্রবাহিত তা হলো, নাট্যসাহিত্য তখনই সুষমাময় হয় যখন তার মঞ্চ উপস্থাপনা ঘটে। মঞ্চে উপস্থাপিত না হলে একটি নাটক দর্শক মনে ঠাঁই নিতে পারে না। মঞ্চে উপস্থাপনের মাধ্যমে নাটক শিল্পের পথে আপন ভুবন নির্মাণ করে। সেই সঙ্গে নাটকে উপস্থাপিত সংলাপও জনপ্রিয়তা পায়।
লেখক : নাট্যকার।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ আগস্ট ২০১৫/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম