ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ফুটপাতের ব্যবসা থেকে সফল উদ্যোক্তা

লোকমান বিন নূর হাসেম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৩, ৬ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৬:০৯, ৬ জানুয়ারি ২০২১
ফুটপাতের ব্যবসা থেকে সফল উদ্যোক্তা

রবিউল ইসলাম একজন তরুণ উদ্যোক্তা। তিনি ‘ফেব্রিকন ফ্যাশন’-এর স্বত্বাধিকারী। একটা সময় তিনি ফুটপাতে ব্যবসা করতেন। আজ তিনি তৈরি করেছেন ফেব্রিকন ফ্যাশন নামে নিজস্ব ব্র্যান্ড। দেশের ৬৪ জেলায় নিজস্ব ব্র্যান্ডের শো-রুম করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন দুর্বার গতিতে। তিনি তৈরি করেছেন অসংখ্য যুবকের কর্মসংস্থান। 

জয়পুরহাটের সন্তান রবিউল ইসলাম ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন নিজে কিছু করবেন। লেখাপড়ায় খুব ভালো করলেও ভালো চাকরির আশা কখনোই তার ছিল না। তাই ডিপ্লোমা করা অবস্থায়ই টুকটাক বিজনেস শুরু করে দেন। ঢাকায় বিভিন্ন বায়িং হাউজ থেকে পণ্য কিনে রবিউল ইসলাম তা বাইরে বিক্রি করতেন, পাঠাতেন দেশের বিভিন্ন জেলায়। এভাবেই চলতে থাকে তার ছোট্ট বিজনেস। 

আরো পড়ুন:

হোস্টেলে থেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি এসব ছোট-খাটো ব্যবসা করায় তার বন্ধুরা অনেক রসিকতা করেছে। অনেক তুচ্ছ-তাচ্ছিলও করেছে, কিন্তু রবিউল তাদের সমালোচনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এগিয়ে গেছেন তার লক্ষ পূরণের দিকে। শুরুতে ঢাকার ফুটপাতে একটি দোকান নেন তিনি। সেখানে কিছু প্যান্ট শার্ট দিয়ে একজন লোক বসিয়ে দেন, যে বিকেল থেকে রাত ১১/১২টা পর্যন্ত প্যান্ট শার্ট বেচাকেনা করতেন। রবিউল ইসলাম তাকে প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে বেতন দিতেন। এতে কর্মচারী যেমন লাভবান হতেন, তেমনি রবিউল ইসলামও ভালো মুনাফা পেতেন।

ফুটপাতে প্যান্ট-শার্টের ব্যবসা ভালোই চলতে থাকে। ধীরে ধীরে তার দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। একটি থেকে দুটি অতপর তিনটি এক পর্যায়ে ফুটপাতে তার পাঁচটি দোকান হয়ে যায়। জমে উঠে তার ব্যবসা, অনেক লাভ হতে থাকে। দোকানগুলো পরিচালনা করতে তার অনেক কষ্ট হয়ে যায়। এবার তিনি আর একটু বড় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। এবারের স্বপ্ন মার্কেটে একটি দোকান নেওয়া। মার্কেটে দোকান নেওয়ার চিন্তা ভাবনা করতে থাকেন রবিউল। অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে তিনি ফুটপাতের দোকানগুলো ছেড়ে  মিরপুর শাহ আলী কলেজ মার্কেটের তিন তলায় একটি দোকান নিয়ে নেন। 

স্বপ্ন পূরনের পথে আরও একধাপ এগিয়ে যান তিনি। ফুটপাত থেকে এখন একটি মার্কেটে দোকানের মালিক রবিউল। কিছুটা ব্যবসায়ী ব্যবসায়ী ভাব চলে এসেছে তার মনে। বন্ধু মহলে এখন বুক ফুলিয়ে ব্যবসায়ী পরিচয় দিতে পারেন। তবে গন্তব্য বহুদূর, আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে তাকে। 

এদিকে তার ডিপ্লোমা করা শেষ হয়েছে। পরিবার থেকে চাপ বাড়তে থাকে প্রবাসে যাওয়ার। এত দিন তিনি যে ব্যবসা করে আসছিলেন, তার সে ব্যবসার পেছনে পরিবারের কোনো সাপোর্ট ছিল না, ছিল শুধুই বিরোধিতা। বাবা মায়ের স্বপ্ন তাকে জাপান পাঠাবেন। ডিপ্লোমা শেষ হওয়ার পর এই চাপ আরও বাড়তে থাকে। বাবা, মায়ের ইচ্ছায় রবিউল জাপানি ভাষা শিখতে থাকেন, পাশাপাশি চলতে থাকে তার ব্যবসা। তবে তিনি ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠিত হবেন এটাই তার ফাইনাল ডিসেশন। 

মার্কেটে খুব ভালো চলতে থাকে তার ব্যবসা। বঙ্গবাজারসহ বিভিন্ন বড় বড় মার্কেট থেকে তিনি প্যান্ট শার্ট কিনে তার দোকানে বিক্রি করেন। তার মনে ইচ্ছে জাগে এমন একটি নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করার, যে ব্র্যান্ড একসময় ব্যাপক পরিচিতি পাবে। এই ব্র্যান্ডের মাধ্যমে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে পুরো দেশব্যাপী।  

রবিউল ইসলাম তার পরিকল্পনা শেয়ার করার জন্য ইকবাল বাহার স্যারের কাছে ছুটে যান। ইকবাল বাহার এমন একজন ব্যক্তি, যার অনুপ্রেরণায় ৬০ বছরের বৃদ্ধ টগবগে যুবকের ন্যায় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন, চরম হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি নতুন করে আশার আলো দেখতে পান, যে ভাবতো আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না, সেও উদ্যোক্তা হওয়ার দৃঢ় মনোবল ফিরে পান। রবিউল ইসলাম তার কাছে নিজের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। স্যার তার পরিকল্পনার কথা শুনে খুব খুশি হন ও তাকে ব্যাপক উৎসাহ দেন। সেইসঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানের নাম রেখে দেন ‘ফেব্রিকন ফ্যাশন’। 

জন্ম হয় ফেব্রিকন ফ্যাশনের, তৈরি হয় রবিউল ইসলামের নিজস্ব ব্র্যান্ড। স্বপ্ন এবার সত্যি হতে চলছে, আনন্দ আলোর ঝলকানি প্রস্ফুটিত হচ্ছে রবিউল ইসলামের চেহারায়। অল্প দিনের ব্যবধানে তিনি মার্কেটে আরও একটি দোকান নিয়ে নেন। তবে এটি তৃতীয় তলায় নয়, দ্বিতীয় তলায়। কারণ তিনি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন তৃতীয় তলার তুলনায় দ্বিতীয় তলার দোকানগুলোতে কাস্টমারের আনাগোনা বেশি। 

তার ব্যবসার সফলতা দেখে বাবা-মা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। এতদিন পর তিনি তার পিতা-মাতার সাপোর্ট পান। তারা তাকে বিদেশ পাঠানোর পরিকল্পনা বাতিল করেন। রবিউল ইসলামও ব্যবসায় পূর্ণ মনোযোগ দেন। 

আসলে উদ্যোক্তাদের পথচলা কখনোই খুব মধুর হয় না। এই পথে থাকে নানা প্রতিকূলতা। যারা এই প্রতিকূলতাকে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মোকাবিলা করতে পারেন, তারাই হয়ে উঠেন সফল। আর যারা প্রতিকূলতার কাছে পরাজয় বরণ করেন, তারা নাম লেখান ব্যর্থদের তালিকায়। রবিউল ইসলাম সফলতার পথে যখন  এক পা, দু পা করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই তার পা গর্তে পড়ে যায়, খুব ভালোভাবেই তিনি হোচট খান। তার আলোয় ঝলমল বর্ণিল আকাশে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে আসে।  

রবিউল যাদের কাছ থেকে পণ্য কিনতেন, তারা তাকে বেশ কিছু খারাপ পণ্য তথা খুব নিন্মমানের কাপড় দিয়ে দেন। শুরুতে তিনি বুঝতে না পারলেও যখন তিনি বুঝতে পারেন, তখন তার কিছুই করার ছিল না। এই খারাপ কাপড়ে আটকে যায় অনেক বড় একটা টাকার অংশ। চোখে-মুখে শর্ষে ফুল দেখতে পান তিনি। এই কাপড় কোনোভাবেই বিক্রি করা সম্ভব নয়। খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তবে তিনি হতাশ নন, কারণ যারা সফল হবেন, হতাশা তাদের কাছে পাত্তা পায় না। 

বরিউল অনেক কষ্ট করে ব্যবসায়ী মহলে গড়ে তোলেন বিশাল নেটওয়ার্ক। সততা দিয়ে জয় করে নেন সবার মন। অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার সু-সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং তাদের নিকট রবিউল নিজেকে একজন সৎ লোক হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হন। ফলে বিশাল লোকসানের কবলে পড়ে পুঁজি শূন্য হয়ে যাওয়া রবিউল তার সততাকে পুঁজি করে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অগ্রীম চেক দিয়ে (বাকিতে) পণ্য কেনা শুরু করেন। সেই পণ্য বিক্রি করে মূল্য পরিশোধ করেন। এভাবেই তিনি তার বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া ব্যবসা পুনরুদ্ধার করেন। 

এক পর্যায়ে তিনি পুনরায় ব্যবসায় গতি ফিরে পান। আগের চেয়ে আরও দুর্বার গতিতে চলতে থাকে তার ব্যবসা। দ্বিতীয় তলায় তিনি আরও একটি দোকান নিয়ে নেন। এবার মাকের্টে তার দোকান সংখ্যা দাঁড়ায় ৩টিতে। 

অন্যের উপর নির্ভরতা কমাতে এবার তিনি প্রোডাকশনে যাওয়ার চিন্তা করেন। যেই ভাবনা সেই কাজ, নিজে ফেব্রিক কিনে কারখানায় প্রোডাকশন শুরু করেন। জমজমাট চলতে থাকে তার ব্যবসা। আবারও হোচট খান রবিউল, কক্সবাজারের এক ব্যবসায়ী তার অনেক টাকা লুটে নেন। তবে তিনি অত্যন্ত ধৈর্য্য ও সাহসীকতার সঙ্গে সব বাঁধা অতিক্রম করতে সক্ষম হন। এবার খুব একটা বেগ পেতে হয়নি তাকে। কারণ তার প্রতিষ্ঠান এখন অনেক বড়। কিছু দিন পর তিনি ওই মার্কেটে একটি অফিস নেন। কম্পিউটার দিয়ে দুজন অনলাইনে দক্ষকর্মী বসিয়ে দেন, যারা অনলাইনে লাইভ করতে থাকে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ‘ফেব্রিকন ফ্যাশন’-এর নাম। 

বড় বড় বায়ার পেতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান রবিউল ইসলামকে লোন দিতে ছুটে আসে। কোনো কোনো ব্যবসায়ীরা যখন নানা ব্যাংকে ঘোরাঘুরি করেও লোন পাস করাতে পারেন না, সেখানে অনায়াসেই লোন পেয়ে যান রবিউল। 

অনেক বাঁধা উপেক্ষা করে ঘুরে দাঁড়ানো সফল উদ্যোক্তা রবিউল ইসলাম এখন শাহ্ আলী কলেজ মার্কেটে তিনটি দোকান ও একটি অফিসের মালিক। তিনি একাই সফল হননি, তৈরি করেছেন ৮ জন লোকের কর্মসংস্থান। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় একটি করে শো-রুম প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে শুধু ‘ফেব্রিকন ফ্যাশন’-এর পণ্য বিক্রি হবে। 

রবিউল ইসলামের পিতার নাম মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ। তিনি পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলায় সোনামুখির আমিড়া গ্রামে তার বাড়ি।

লেখক: সৌদি আরব প্রবাসী। 

ঢাকা/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়