শূকর চরিয়ে জীবিকা যাদের
কাঞ্চন কুমার || রাইজিংবিডি.কম
রাস্তার পাশে শূকর চরাচ্ছেন দুখিরাম (ছবি : কাঞ্চন)
কাঞ্চন কুমার, কুষ্টিয়া : জীবনধারণের তাগিদে মানুষ কোনো না কোনো পেশা বেছে নেয়। আর এর মাধ্যমেই সে তার নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। একটু খেয়াল করলেই আমরা নিজেদের চারপাশে অসংখ্য বৈচিত্র্যময় পেশা দেখতে পাই। এদের কোনোটিই কিন্তু ছোট নয়। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি পরিবার তেমনি একটি বৈচিত্র্যময় পেশাকে এখনো টিকিয়ে রেখেছে।
পথে পথে ঘুরে শূকর চরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন এসব মানুষ। দিন নেই, রাত নেই, মাঠে-ঘাটে, রাস্তার পাশে শূকর চরানোই তাদের কাজ। যেখানে রাত হয়তো সেখানেই কাত। পলিথিন দিয়ে কোনোমতে তাঁবু খাটিয়ে রাতটা পার করা গেলেই হলো। রাতের বেলা পশুর সঙ্গেই রাত কাটায় ওরা।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সরদারপাড়ার অভিমানী সরদার (৬৫) রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পথেঘাটে শূকর চরাই আমরা। আমাদের আবার জীবন! দিন নেই, রাত নেই এই পশুগুলোর সঙ্গেই থাকতে হয় আমাদের। এমন জীবন যেন আর কারো না হয়। কী আর করব, ওদের প্রতি যে মায়া লেগে গেছে। এখন এরাই আমার সব। যেখানে রাত হয় সেখানেই বিছানা পাতা। রাতটা কোনোমতে কেটে গেলেই তো হলো। সকালে আবার কোথায় যেতে হবে কে জানে?’
বড় রাস্তার পাশে খাবারের সন্ধানে ঘুরছে শূকরের দল
তিনি জানান, বর্তমানে তার পালে প্রায় ২৮০টি শূকর রয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি মা শূকর, দুটি পাঁঠা শূকর, এবং বাকিগুলো বাচ্চা। প্রতিটি মা শূকর বছরে দুবার করে বাচ্চা দেয়। একবারে গড়ে ৮-৯টা করে বাচ্চা দেয়। প্রতিটি মা শূকরের দাম ১০-১২ হাজার টাকা এবং প্রতিটি বাচ্চার দাম ২-৩ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, ‘রাস্তায় রাস্তায় শূকর চরিয়েই প্রায় কেটে গেল জীবন। সেই ছোটবেলা থেকে আমি এই শূকর চরাই। প্রথমে কালু সরদারের শূকরের পাল চরাতাম। সেখান থেকে বছর ছয়েক আগে চলে আসি। তারপর ১০টা মা শূকর ও পাঁচটা বাচ্চা নিয়ে নিজেই শূকরের পাল তৈরি করি। সেখান থেকেই আজ এই পর্যন্ত। এখান থেকেই কোনোমতে সংসার চালিয়ে চার ছেলে ও এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। গরিব মানুষ তো, তাই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারিনি। আর করাব বা কীভাবে, নিজেই খেতে পাই না ঠিকমতো। সারা দিন এদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরি। দুপুরবেলা একবার রান্না করি, তাই তিন বেলা খাই।’
চরে বেড়াচ্ছে শূকরের দল
‘আমি যখন কালু সরদারের পাল চরাতাম তখন আমাকে প্রতিবছরে ২০ হাজার টাকা বেতন এবং ১০টি করে শূকর দিত। এই নিয়েই কোনোমতে চলতাম। আপনিই বলুন আজকের দিনে বছরে ২০ হাজার টাকায় কিছু হয়? তারপরে খাবার-দাবার বাদে আরো খরচ তো আছেই। রাতে কেরোসিনের তেল, মোমবাতি, মশার কয়েল তো প্রতিদিনই লাগে।’
তিনি আরো বলেন, ‘২-৩ মাস পরপর বাড়িতে যাই। এই রাস্তাই যেন আমার বাড়ি। আর এই শূকরগুলোই যেন আমার পরিবার। এর সঙ্গেই তো কাটালাম এতগুলো বছর। তবে আর বেশি দিন এ কাজ করব না। বছর খানেক পরে এ কাজ ছেড়ে দেব। ভাবছি এগুলো বিক্রি করে বাড়িতে গরু কিনে পালন করব, আর কৃষিকাজ করব। অনেক বছর ধরে আছি আর এই ছোট বাচ্চাগুলোর জন্য এটা বাদ দিতে পারছি না।
সারা দিন চরে বেড়িয়ে ঘুমাচ্ছে ক্লান্ত পশুগুলো
‘আমি এখানে একা এ কাজ করি না। আমার সঙ্গে আরো তিনজন আছে। উপজেলার সরদারপাড়ার বাদল সরদার (২৫), রইতন সরদার (২০) আর দুখিরাম সরদার (৩৫)।’
বাদল সরদার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এমন জীবন আমি চাই না। সারা দিন-সারা রাত রাস্তায় থাকতে হয়। ১-২ মাস পরে একবার বাড়ি যাই। এগুলো রেখে আবার থাকতেও পারি না। এই পেশায় আমি প্রায় ১০ বছর ধরে আছি। আগে কালু সরদারের পাল চরাতাম। তার কাছ থেকে ১০টি বাচ্চা পেয়েছিলাম। এখন সেগুলোই চরাই।’
‘এই কাজ আমার আর ভালো লাগে না। সমাজের সাধারণ মানুষ আমাদের ভালোবাসে না। আমাদের ঘৃণা করে। মানুষের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে দেয় না। আমি এ কাজ বেশি দিন করব না। ভাবছি গরমে বাচ্চাগুলো বড় হয়ে গেলে বিক্রি করে দেব। আর আমি আমার সন্তানদের এ কাজ করতে কোনো দিনই দেব না।’
‘এগুলো চরিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। আমরা এগুলো নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে যাই। যেমন- কুষ্টিয়ার মিরপুর, মশান, কাকিলাদহ, দৌলপুরের চিলমারীর চর, ভেড়ামারা, চুয়াডাঙ্গা ও যশোর।’
অভিমানী সরদার ও বাদল সরদার
প্রায় একই কথা জানালেন পালে থাকা রইতন ও দুখিরাম। তারা জানান, রাতের বেলা রাস্তার ধারে ও ঝোপঝাড়ে থাকতে হয়ে। তারাও এ কাজ আর বেশিদিন করবেন না বলে জানালেন।
রইতন বলেন, ‘আমরা কি মানুষ না? ব্যাংক থেকে আমাদের কোনো ঋণ দেওয়া হয় না। কয়েকদিন আগে গ্রামীণ ব্যাংক আমাদের ঋণ দেওয়ার কথা বলেছিল কিন্তু সেটা আর হয়নি। আমাদের তো আর মামা-খালু নেই। আমাদের জীবনের নিশ্চয়তাও নেই। কখন সাপ-পোকা এসে কামড়ায় কে জানে।’
তার সঙ্গে থাকা দুখিরাম বলেন, ‘আমরা আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই মিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিনকে। তার কারণেই এই অঞ্চলে আমরা শান্তিতে শূকরের পাল চরাতে পারি। এর আগে অনেক সমস্যা হতো। সন্ত্রাসীরা আমাদের কাছ থেকে চাঁদা চাইত। কিন্তু চেয়ারম্যানের কঠোরতায় এখন আর এটা হয় না।’
তারা জানান, উপজেলা চেয়ারম্যান তাদের অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন। এবারের ঈদে তাদের সবাইকে একটা করে লুঙ্গি, শাড়ি ও নগদ টাকা দিয়েছেন।
মিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই রয়েছে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। আর এরাও তো মানুষ। এদেরও রয়েছে বেঁচে থাকার অধিকার। আমার এলাকায় কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলবে না। এটা কঠোরভাবে দমন করা হচ্ছে, আগামীতেও হবে।’
রাইজিংবিডি/কুষ্টিয়া/৫ আগস্ট ২০১৫/কাঞ্চন কুমার/সনি/এএন
রাইজিংবিডি.কম