ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

দোল পূর্ণিমা : রঙিন জীবনের তাৎপর্য

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২০, ২৫ মার্চ ২০২৪   আপডেট: ১৫:২২, ২৫ মার্চ ২০২৪
দোল পূর্ণিমা : রঙিন জীবনের তাৎপর্য

দোল পূর্ণিমা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষ একটি দিন। এই দিন হোলি উৎসব বা দোলযাত্রা নামেও পরিচিত। দোলযাত্রা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে অতি পবিত্র। উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয়। যেমন : ভারতের উড়িষ্যায় দোলোৎসব, উত্তর ও মধ্যভারতে হোলি বা হোরি, গোয়া ও কঙ্কণ অঞ্চলে শিমাগা, দক্ষিণ ভারতে কামায়ন। উত্তর ভারতে হোলি উৎসব বাংলার দোলযাত্রার পরদিন পালিত হয়।

দোল হিন্দু সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন উৎসব। নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ ও জৈমিনি মীমাংশায় রং উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়। ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক ‘হোলিকোৎসব’ পালনের উল্লেখ পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের নাটক ‘রত্নাবলী’তেও হোলিকোৎসবের উল্লেখ আছে। বেশ কিছু কাহিনী ঘিরে এই দোল উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সমাজের অশুভ শক্তির বিপরীতে শুভ শক্তির বিস্তার বা বিজয় লাভ করা এবং সকলের সাথে সকলের আনন্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন এই উৎসবের প্রধান উদ্দেশ্য। 

দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামে অভিহিত করা হয়। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোল পূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির বা গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলোতে এই উৎসকে ‘বসন্ত উৎসব’ হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৪৮৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, দোল পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মগ্রহণকে কেন্দ্র করেও এই মহোৎসব পালন করা হয়। এই তিথিকে গৌর পূর্ণিমাও বলা হয়। 

বসন্তের রঙের সঙ্গে এই উৎসব আরও রঙিন হয়ে ওঠে। হিন্দু পুরাণে প্রায় ২ হাজার বছর আগে, ইন্দ্রদ্যুম্নের দ্বারা গোকুলে হোলি খেলা প্রচলনের উল্লেখ রয়েছে। তবে ইতিহাস বলছে প্রাচীন ভারতে ইন্দ্রদ্যুম্নের নাম একাধিকবার রয়েছে। আবার অন্য একটি প্রচলিত কাহিনী থেকে জানা যায়, হিরণ্যকশিপু এবং প্রহ্লাদের কাহিনী থেকে হোলি উৎসব এসেছে। কারণ প্রহ্লাদ ধার্মিক ছিলেন। তাই তাকে হত্যা করা সহজ ছিল না। কোনোভাবেই তাকে হত্যা করা যাচ্ছিল না। তখন হিরণ্যকশিপু ছেলেকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেন। অন্যদিকে হোলিকা আগুনে কোনোদিন ক্ষতি হবে না এই বর পেয়েছিল। তাই প্রহ্লাদকে হত্যা করার জন্য হোলিকা সিদ্ধান্ত নেয় সে প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেবে। হোলিকা ছিল হিরণ্যকশিপুর বোন। সে প্রহ্লাদকে মারার ষড়যন্ত্র রজনা করে হিরণ্যকশিপুর সঙ্গে হাত মেলায়। সে প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে একদিন আগুনে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু হোলিকার বর পাওয়া সত্তেও সেদিন শেষ রক্ষা হয়নি। প্রহ্লাদ বিষ্ণুর আশীর্বাদে বেঁচে যায়। কিন্তু আগুনে ভস্ম হয়ে যায় হোলিকা। সে তার বরের অপব্যবহার করায় আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার সময় তার বর নষ্ট হয়ে যায় এবং সে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই দিনটি থেকে পালন করা হয় হোলি বা দোল উৎসব। 

এর পেছনে রয়েছে আরও একটি জনপ্রিয় প্রচলিত কাহিনী। এটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বাপর যুগের কথা। দুই দৈত্যের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষ। ফাল্গুনী পূর্ণিমার আগের দিন শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম মিলে ওই দুই দৈত্যকে হত্যা করেন। এরপর সন্ধ্যার সময় শুকনো কাঠ, খড়কুটো দিয়ে তাদের আগুনে পুড়িয়ে দেন। সেই দিন থেকে ন্যাড়া পোড়া প্রচলিত হয়। এ ভাবে শ্রীকৃষ্ণ দুই দৈত্যের অত্যাচার থেকে মথুরাসাবীকে মুক্তি দিলেন। মথুরাবাসী তাদের এই মুক্তির দিনটি শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের সঙ্গে রং খেলে উদযাপন করেন। সে দিন থেকেই শুরু হয় এই দোল উৎসব। তবে বৈষ্ণব বিশ্বাসটাই বেশি গেঁথে গেছে। এই দিনে রাধাকৃষ্ণ নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। বাড়িতে-বাড়িতে, মন্দিরে পূজা হয়। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু গানে দোল ও রাধা-কৃষ্ণের দোল লীলার তাৎপর্য এসেছে। তাঁর ‘সোনারতরী’তে ঝুলন, ‘কথা ও কাহিনী’তে হোলি খেলাসহ অনেক কবিতায় এ প্রসঙ্গ এসেছে। দোলযাত্রা উৎসব শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব নামে পরিচিত। কবির জীবদ্দশা থেকে এ উৎসব নানা আয়োজনে পালিত হয়ে আসছে। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গানে হোলি বারবার এসেছে। দোল বা হোলি দুটোই রঙের খেলা হলেও কিন্তু এই দুটি ভিন্ন অনুষ্ঠান। দোল আগে উদযাপিত হয় তারপর হোলি! দোলযাত্রা বা বসন্তোৎসব একান্তভাবেই সনাতন বাঙালির নিজস্ব উৎসব। আর হোলি অবাঙালিদের উৎসব ।

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়