ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শিক্ষক দিবস

ফ্রেন্ড ফিলোসফার গাইড- এমন শিক্ষক পাওয়া কঠিন

হাসান আজিজুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ৫ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফ্রেন্ড ফিলোসফার গাইড- এমন শিক্ষক পাওয়া কঠিন

আমার প্রিয় শিক্ষক একজন নয়। পাঠশালায় একজন ছিলেন, নাম যাশোরথী পাঠক। হিন্দু ব্রাহ্মণ। খুব নিষ্ঠাবান। একমাত্র তাঁর বাড়িতেই আমাদের গ্রামের কালীপূজা হতো। বাড়িতে কালীমূর্তি গড়া ছিল। মূর্তি বিসর্জনের পর খড়সহ মূর্তি তুলে এনে বাড়িতে রেখে দেয়া হতো। ফলে বছরজুড়ে তাঁর বাড়িতে খড়ের তৈরি কালীমূর্তি থাকতো। স্যার প্রতিদিন পূজা করতেন। বেলা এগারোটার দিকে পাঠশালা ছুটি হয়ে গেলে স্যার পূজায় বসতেন। স্যার প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে লক্ষ্মীপূজা করতেন। সেখান থেকে যে প্রসাদ পেতেন সেই ভাগ আমরাও পেতাম; ভেজানো আতপ চাল, একটু সন্দেশ!

স্কুলেও আমার কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে শিবরাম চৌধুরী অন্যতম। তিনি গ্রাজুয়েট ছিলেন না কিন্তু অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণ করতেন। তিনি যখন বাংলা পড়াতেন, ভালো লাগতো। শিবরাম স্যার হয়তো কিছুদিন আগে মারা গেছেন। এমনও হতে পারে, তিনি এখনো বর্ধমান শহরে একশ চার-পাঁচ বছর বয়স নিয়ে বেঁচে আছেন। স্যারের একশ বছর বয়স যখন হলো তখন দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমার বাড়িও তো বর্ধমান। স্যার বর্ধমান শহরে আছেন জেনে গিয়েছিলাম। শিবরাম চৌধুরী থাকতেন আমাদের পাশের গ্রামে, সেখান থেকে হেঁটে স্কুলে আসতেন। আমার মতে তিনি ছিলেন অসাধারণ শিক্ষক! খুব ভালো বক্তা ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে একটি কথা না বললেই নয়- তিনি ছিলেন দয়াদ্রচিত্ত একজন।

আর একজন স্যারের কথা খুব মনে পড়ে- দুগ্গাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। খালি গায়ে থাকতেন। কখনো একটি চাদর হয়তো জড়িয়ে নিতেন। মোটা পৈতা গলায় থাকতো। তিনি আমাদের নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠ দিতেন। কখনও গায়ে হাত তুলতেন না। ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত, পালি সবগুলো ভাষা জানতেন। তিনি আজও আমার অসম্ভব শ্রদ্ধেয়। কলেজ লেভেলেও অনেক ভালো শিক্ষক পেয়েছি। তার মধ্যে একজনের নাম আমি সবসময় বলি- সম্বুদ্ধ। এটি স্যারের ছদ্মনাম। ‘শনিবারের চিঠি’তে রসরচনা লিখতেন। ভালো নাম অমূল্য কুমার দাশগুপ্ত। তাঁর সর্বশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য, অসাধারণ বক্তৃতা, সাহস, দৃঢ় মনোবল আমাদের মুগ্ধ করে রাখত। এতো চমৎকার ভাষণ দিতেন ভাষায় বোঝানো কঠিন! তিনি আমাদের পলিটিক্যাল সায়েন্স, ফিলোসফি পড়াতেন। তিনি যা পড়াতেন তাতে সিলেবাসে যা থাকতো তারচেয়ে অনেক বেশি জানা যেত। তিনি স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। একেবারে অসাম্প্রদায়িক। স্যারকে আমি কখনো ভুলবো না। তাঁর রসরচনাও খুব ভালো। তিনি একদিক থেকে পরশুরাম, রাজশেখর বসুর অনুসারী ছিলেন।

আর একজন ছিলেন অমূল্য কুমার সিংহ। তিনি দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। কলেজের এই দুজন শিক্ষকের পাণ্ডিত্যের সঙ্গে তুলনায় পরবর্তীকালে আমি আর কাউকে দেখিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যদিও অনেককে পেয়েছি। সেখানে অনেক বড় বড় শিক্ষক ছিলেন। ড. সালাহ্‌উদ্দীন আহ্‌মদ কত বড় শিক্ষক ছিলেন সে তো কারও অজানা নয়। তার বইও প্রকাশিত হয়েছে ‘ফিরে দেখা’। তিনি অসামান্য ভদ্রলোক এবং জ্ঞানী। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ছিলেন, তাঁর নাম সবার জানবার কথা। আরও ছিলেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম; বদরুদ্দীন উমর স্যার এখনো জীবিত। প্রায় নব্বই বছর বয়স পার করেছেন। তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক। ওই যাকে বলে- ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। হ্যাঁ, এই বিশেষণগুলো তার নামের সঙ্গে জুড়ে দেয়া যায়। সেজন্য এখনো আমি তার উপদেশ শুনি। উপদেশ নিতে গেলে বকুনি দেন, এই বকুনিটাই আমার শুনতে ভালো লাগে। বদরুদ্দীন উমর স্যারের লেখা সম্পর্কে সকলেই জানে; একদম বামপন্থি লেখা। আনিসুজ্জামান তো আমার প্রায় সমবয়সী। তবু তাঁকে শ্রদ্ধা করি। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, তিনিও আমার শ্রদ্ধার পাত্র। আর তো তেমন শিক্ষক দেখি না।

তবে আমরা যখন শিক্ষকতা করেছি, ছাত্রছাত্রীরা পুত্র-কন্যার মতো ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ আর সে রকম নেই। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কে সেই ঘনিষ্ঠতা, স্নেহ, বাৎসল্য, শ্রদ্ধা এসব এখন কমই দেখা যায়। সব কিছুই মনে হয় পড়তির দিকে- বলবার মতো কিছু নেই! আধুনিক হওয়ার ফলে আমরা যে কী হচ্ছি, কোন দিকে যাচ্ছি; বলতে গেলে বলতে হবে যে ‘হাতি ছোট হয়ে এরকম হয়েছে, নাকি ইঁদুর বড় হয়ে এরকম হয়েছে’।বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে সাংস্কৃতিক জীবনটা খুব চর্চা করেছি। আবৃত্তি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষকদের লড়াই করার জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলা- এগুলো করেছি। সেই পরিবেশটাও নষ্ট হয়ে গেল। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বেও। শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। ইংল্যান্ডে শিক্ষিত একটা জাত আছে বলে তো মনে হয় না। আমেরিকায় তো কথায় নেই; ইউরোপেই বা কেন যাবো, আর মধ্যপ্রাচ্যেই বা কেন? মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর কোথাও আর তেমন বিশ্ববিদ্যালয় দেখি না। সেখানকার সাহিত্যেও আর তেমন কিছু দেখি না। দেখেছি একজন, দু’জন এরকম লেখক-সাহিত্যিক। বৈজ্ঞানিকও তো তেমন নেই। ভারতে তবু তো এপিজে কালাম ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতিও ছিলেন। ওই মাপের মানুষ বাঙালিদের মধ্যে ইস্ট ওয়েস্ট কোনো বাংলাতেই নেই। সব কিছুর অবনমন হয়েছে। এখন এমন শিক্ষক খুঁজে পাওয়া কঠিন যাকে একইসঙ্গে ‘ফ্রেন্ড, ফিলোসফার, গাইড’ বলা যায়।

শ্রুতিলিখন : স্বরলিপি

শিক্ষক দিবসের আরো লেখা: 




ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়