স্নেহ ও কর্তব্যে পিতা রবীন্দ্রনাথ
আবদুল মান্নান পলাশ || রাইজিংবিডি.কম
বাম থেকে মীরা দেবী, পুত্র রথীন্দ্রনাথ, কবিগুরু, পুত্রবধূ প্রতিমা এবং বড় মেয়ে মাধুরীলতা
আবদুল মান্নান পলাশ
১৮৮৩ সাল থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত ১৯ বছরের সংসার জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তিন কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক। তিন কন্যার মধ্যে কনিষ্ঠা ছিলেন শ্রী অতসীলতা দেবী মীরা, মধ্যমা শ্রী রেনুকা দেবী রানী ও জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা দেবী বেলা। কনিষ্ঠ পুত্র শ্রী শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রী রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিন কন্যার মধ্যে মীরার বিয়ে হয় পনেরো বছর বয়সে, শ্রী নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে। কবি রেনুকা দেবীর বিয়ে দিয়েছিলেন জনৈক ডাক্তার সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে মাত্র সাড়ে দশ বছর বয়সে। বিয়ের দুই বছরের মধ্যে রেনুকার আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। বেলার বয়স চৌদ্দ পার হতে না হতেই তার বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন কবি। কবি-বন্ধু প্রিয়নাথ সেনের প্রস্তাবে বেলার বিয়ে হয় বিহারীলার চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র শরত কুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে।
কবির দুই পুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র তেরো বছর বয়সে কলেরায় মারা যায়। জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলাতের ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিদ্যায় উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। শুধু তাই নয়, কবি রথীন্দ্রনাথকে বিধবার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার পিতৃজীবনে তিন কন্যা ও দুই পুত্রকে নিয়ে যে অপরিসীম দুঃখ-দুর্দশাকে নির্দোষরূপ গণ্যপূর্বক তাতে শান্তি ও সান্ত্বনা খুঁজে নিতে চেয়েছিলেন তার তুলনা পাওয়া যায় না।
এই নিবন্ধে শুধুমাত্র মীরা দেবীকে নিয়ে কবির মনে যে অশান্তি তৈরি হয়েছিল তা তুলে ধরছি। ৬ জুন, ১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবীর বিয়ে হয় বরিশালের ব্রাহ্ম সমাজের নিষ্ঠাবান ভক্ত বামনচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র নগেন্দ্রনাথের সঙ্গে। উচ্চাভিলাষী নগেন্দ্রনাথের বিলাত যাবার একান্ত বাসনা। কিন্তু পারিবারিক অবস্থা সে ইচ্ছাপূরণে অনুকূল ছিল না। এ জন্য বিলেত যাওয়ার ব্যয় বহনে ইচ্ছুক এমন কন্যা দায়গ্রস্ত পিতাকে দায়মুক্ত করতেও তিনি রাজি। শ্বশুরের খরচে বিলেত গমনেচ্ছু পাত্র রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন না। বিয়ের নামে এই বিনিময় প্রথা তার ভীষণ অপছন্দ। কিন্তু প্রিয়দর্শন, তেজস্বী যুবক নগেন্দ্রনাথকে দেখে মত বদল করেন তিনি। নগেন্দ্রনাথকে বিদেশে পাঠানোর কথা দিয়ে কন্যাদান করলেন। কবির ইচ্ছে অনুযায়ী নতুন জামাই নগেন্দ্রনাথ বিয়ের তিন সপ্তাহ পর ২৮ জুন, ১৯০৭ সালে বিলেত যাত্রা করলেন। তিনি ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে ১৯১০ সালে দেশে ফিরে আসেন।
কবির স্বপ্ন ছিল, পুত্র এবং জামাতা তার স্বপ্নপূরণে পাশে এসে দাঁড়াবে। তার অসমাপ্ত কাজের ভার তারা নেবে। শান্তিনিকেতনে তার সাধনা সিদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে তারা। কিন্তু নগেন্দ্রনাথকে নিয়ে কবির সকল আশা অচিরেই বিলীন হয়ে গেল। শ্বশুর নির্ধারিত সকল কাজকর্ম থেকে নগেন্দ্রনাথ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। তিনি অন্যত্র চাকরি প্রয়াসী হলেন। নগেন্দ্রনাথকে ভারমুক্ত করতে কবি তার পৈতৃক দেনা শোধ করলেন। শুধু তাই নয়, তার ভাইদের পড়াশোনারও দায়িত্ব নিলেন। এরপর কন্যা-জামাতার জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করলেন। নগেন্দ্রনাথের কোন নির্দিষ্ট কাজকর্ম নেই। ফলে আয়ও নেই তেমন। নির্লিপ্ত থাকা তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সব বিষয়েই গা-ছাড়া একটা ভাব। উপরন্তু বে-হিসেবী জীবনযাত্রাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে কবির সঙ্গে জামাতার মতান্তর থেকে মনান্তর শুরু হলো।
এ ঘটনার অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া ঘটল মীরা দেবীর উপর। যে সরল ও সুরুচিপূর্ণ পরিমণ্ডলে কবি-কন্যা লালিত পালিত হয়েছিলেন, জামাইয়ের পারিবারিক পরিবেশে তার ঘাটতি ছিল। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ১৯১৮ সাল নাগাদ কবি-কন্যা ও জামাতার মধ্যে এক দুস্তর ব্যবধান তৈরি হলো। বিলম্বে হলেও নগেন্দ্রনাথের একটা জীবিকার ব্যবস্থা হলেও তার জীবনবীণার ছেঁড়া তার জোড়া লাগার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। কন্যার প্রতি মমত্ববোধ, আর জামাইয়ের প্রতি কর্তব্যবোধে কবির দিক থেকে কোনো ঘাটতি না থাকলেও উভয়ের মানসিকতায় যে যোজন পরিমাণ ফারাক সৃষ্টি হয়েছে তার প্রতি বিধান কবির সাধ্যাতীত। এক পর্যঅয়ে মীরা দেবী স্বামীর ঘর করতে কলকাতা যেতে অনিচ্ছুক হলেন। নগেন্দ্রনাথের ইচ্ছে, কবি তাকে জোর করে স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখানেই কবির আপত্তি। তিনি লিখেছেন, ‘মীরার সঙ্গে তোমার লেশমাত্র বিচ্ছেদ হয়, এ আমার কিছুতেই ইচ্ছাসম্মত নয়। এর দায়-দায়ীত্বও আমার পক্ষে বহন করা কঠিন। তবু আমাকে পরম দুঃখে এটা স্বীকার করতে হচ্ছে। এবার মাদ্রাজে যখন দেখলুম মীরা তোমাকে ভয় করে। তোমার হাত থেকে প্রকাশ্য অপমানের সংকচে একান্ত সংকুচিত হয়। তখন স্পষ্ট দেখতে পেলুম তোমাদের দু’জনের প্রকৃতির মূল সুরে মিল নেই।’ (চিঠি, ৮ ভাদ্র, ১৩২৬ )।
সুতরাং মীরা দেবী পুত্র-কন্যা নিয়ে রয়ে গেলেন শান্তিনিকেতনে। কখনো বা পিতার সাথে জোড়াসাঁকোয়। নগেন্দ্রনাথ কলকাতায়। নগেন্দ্রনাথ বার বার চেষ্টা করেছেন স্ত্রীকে নিজের কাছে আনতে কিন্তু মীরা দেবী রাজি হননি। কারণ কবি তার জামাইয়ের স্বভাব-চরিত্র বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ‘তোমার অধৈর্য অসহিষ্ণুতা, তোমার আত্মসম্বরণে অসাধ্যতা, তোমার দুর্দান্ত ক্রোধ, এবং আঘাত করিবার হিংস্র ইচ্ছা, সাংসারিক দিক থেকে আমাকে অনেক সময়ে কঠিন পীড়া দিয়েছে।’ (চিঠি, ১১ অগ্রহায়ণ, ১৩২৬)।
এমন পরিবেশে কন্যা স্বামী গৃহে যেতে না চাইলে কবি তাকে জোর করে কীভাবে পাঠান। সুতরাং কবি কন্যাকে পাঠালেন না। অন্য একটি চিঠিতে কবি লিখেছেন, ‘মীরা যে প্রশান্ত গাম্ভীর্যের সঙ্গে নিঃশব্দে আপন দুঃখবহন করে। তাতে ওর মুখের দিকে তাকালে আমার চোখে জল আসে। ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে কোনও জীবনযাত্রা বহন করতে যদি প্রস্তুত হতে হয়, তবে সে চিন্তা আমার জন্য দুর্বিষহ। এখন সে শুধু আমার কন্যা নয়, সে যে আমার আশ্রয়ে আছে, আমি যদি তাকে বলি তার এখানে থাকা হবে না, তাহলে তাকে চলে যেতেই হবে। জানি, সে কখনো আভাসেও অসম্মতি জানাবে না। কিন্তু কোনমতেই আমার দ্বারা এমন নির্মম কাজ হবে না। মীরা যখনি ইচ্ছে করবে। যখনি সে আমাকে বলবে আমি যাব। তখনি আমি তাকে যেতে বলব।’ (চিঠি, ২০ ফাল্গুন, ১৩২৬)।
ব্যথাহত রবীন্দ্রনাথ এক পত্রে নগেন্দ্রনাথকে লিখেছেন, ‘তোমাদের দু’জনেরই ভাগ্য তোমাদের নিজেদের হাতে। আমি জোড় করে তার গতি পরিবর্তন করতে পারিনে। এ সকল দুর্ঘটনার মূল রয়েছে অন্তরের মধ্যে। তোমাদের পরস্পরের মধ্যে যে বিচ্ছেদ ঘটেছে সে তো বাইরের জিনিস নয়। বাইরে থেকে জোড় করে, শাসন করে, ভয় দেখিয়ে জোড়া দেবার যে চেষ্টা, সে আমার দ্বারা কিছুতেই হতে পারে না। কারণ, তার মতো নীচতা ও নিষ্ঠুরতা আর কিছুই নেই। তুমি এ সম্মন্ধে আদালতে নালিশ করতে চাও, মীরা যদি সেই আঘাতও সহ্য করতে সম্মত থাকে। তাহলে আমি কি করতে পারি? তুমি এ সম্মন্ধে তাকেই বরঞ্চ ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখো। যদি ভয় পেয়ে সে হার মানে তাহলে তাই হোক।’ (চিঠি, ২৫ মাঘ, ১৩২৬) ।
মীরা দেবী স্বামীর ঘরে না থেকে বাবার কাছে থাকলে লোকনিন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করে নগেন্দ্রনাথ কবিকে লিখলে তিনি জবাবে লিখেছেন, ‘মীরা নিজের সম্মন্ধে লোক নিন্দা গ্রাহ্য করে না তোমাকে লিখেছে শুনে খুশী হলুম। জীবনে সব মানুষের ভাগ্যে সুখ থাকেনা। তা নাই বা থাকল কিন্তু স্বাধীনতা যদি না থাকে তবে তার চেয়ে দুর্গতি কিছু হতে পারে না। মীরা এখানে আপন মনে একটি কোণে থাকে বেশী কিছুই চায় না, একটু খানি শান্তি এখানে পায়, আর জানে আমি ওকে কত স্নেহ করি। লোকনিন্দার ভয়ে মীরার এই অধিকারটুকু নষ্ট হতে দেখলে আমার আর দুঃখের অন্ত থাকবে না।’ (চিঠি, মাঘ-ফাল্গুন, ১৩২৯)।
বিদেশ থেকে কবি মীরা দেবীকে লিখেছিলেন, ‘তোর দুঃখ আমার হৃদয় ভরে আছে। আমি একদিনও ভুলতে পারিনে। এ দুঃখ দূর করি এমন শক্তি আমার নেই, তোদের নিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে সুখী হব ঈশ্বর আমাকে সে অবকাশ দেবেন না। …সুখের আশা রাখিসনে মীরু, দুঃখকে ভয় করিসনে। তুই যে কোনো শাসনের ভয়ে, পীড়নের দায়ে নিজের সত্তাকে বিকোতে চাসনে এতে আমি সুখী ।’ (চিঠি, ১৯২১)।
কিছুদিন পর নগেন্দ্রনাথকে লিখলেন, ‘এই দুঃখ রয়ে গেল যে, তোমাদের দু’জনের কাউকেই আমি সুখী করতে পারিনি, তার শাস্তি নিয়ত অন্তরের মধ্যে ভোগ করছি, অতএব আমাকে ক্ষমা কোরো।’ (চিঠি, ২১ আশ্বিন, ১৩২৯)।
কন্যাকে নিয়ে কবি কতটা গভীর পীড়া অনুভব করেছেন তা বোঝা যায় পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠিতে। তিনি লিখেছেন, ‘মীরা যখন নাবার ঘরে ঢুকেছিলো তখন একটা গোখরো সাপ ফস করে ফণা ধরে উঠেছিল। আজ আমার মনে হয়, সে সাপ যদি তখনি তাকে কাটত, তাহলে ও পরিত্রাণ পেত।’
বিশাল বিচিত্রমুখী রবীন্দ্রসাহিত্যের কোন চরিত্রের মুখে এমন নিষ্ঠুর নিষ্করুন সংলাপ বা পঙ্ক্তি শোনা যায়নি। কী গভীর মনস্তাপে রবীন্দ্রনাথের মতো স্নেহশীল পিতা ও সংবেদনশীল কবির কলমে এমন নির্মম, নির্দয় উক্তি বেরুতে পারে তা অনুভব করা যায়, বোঝা যায় না।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ মার্চ ২০১৫/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম