ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বীরাঙ্গনার জীবন চলে টয়লেট পরিষ্কার করে

রেজাউল করিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:২২, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বীরাঙ্গনার জীবন চলে টয়লেট পরিষ্কার করে

১৯৭১ সাল। ব্রাহ্মণপাড়ার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি রত্না চক্রবর্তী। তখন তিনি সদ্য কৈশোর পেরুনো তরুণ‌ী। বয়স মাত্র ১৭।

তখন সারাদেশেই চলছে তুমুল যুদ্ধ। হানাদার বাহিনী ক্যাম্প করে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার দোহাজারী গ্রামে। ৭১ সালের ৩০ এপ্রিল। এই ক্যাম্প থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হানা দেয় লোহাগাড়া উপজেলার সুখছড়ি ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত ব্রাহ্মণপাড়ায়। এলোপাতাড়ি ব্রাশ ফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে গ্রামের সাত পুরুষকে। কেউ কেউ পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন।

পাকিস্তানি সৈন্যরা তখন বাড়ি বাড়ি ঢুকে খুঁজছিল কোন কোন বাড়িতে সুন্দরী নারী রয়েছে। এই সময় ঘরের কোনে লুকিয়ে থাকা রত্না চক্রবর্তীকে খুঁজে পান তারা। সৌন্দর্যই তার কাল হয়েছিলো সেদিন। পাকিস্তানি সৈন্যরা রত্না চক্রবর্তীকে আটক করে নিয়ে যায় দোহাজারী হানাদার ক্যাম্পে। ৭১ এর এই লোমহর্ষক নির্যাতনের কাহিনী রাইজিংবিডিকে এভাবেই বর্ণনা করছিলেন রত্না চক্রবর্তী।

যে ৩০ লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে রত্না চক্রবর্তী তাদেরই একজন। কিন্তু তিনি এখন চট্টগ্রামের এক অভিজাত শপিং মলের ক্লিনার। মার্কেটের ফ্লোর আর টয়লেট ক্লিন করেই কোন রকমে তার দিন চলে।

৭১ এর বীরাঙ্গনা হিসেবে সরকারিভাবে তার স্বীকৃতি মিলেছে, কিন্তু ভাগ্য বদলায়নি। বয়স এখন ৬৮ পেরিয়েছে। এই বয়সেও দৈনিক ১২ ঘণ্টা শ্রম দিয়ে মাত্র ৫ হাজার টাকা বেতনের চাকুরি করছেন তিনি।

চট্টগ্রাম মহানগরীর পাঁচলাইশ থানা এলাকায় অভিজাত শপিং মল ‘আফমি প্লাজা’য় ক্লিনার হিসেবে চাকুরি করেন রত্না। মার্কেটের তৃতীয় তলায় মহিলা টয়লেটের সামনে দাঁড়িয়েই তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

রাইজিংবিডিকে তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর তার উপর নেমে আসে অমানবিক পাশবিক অত্যাচার। ৩০ এপ্রিল থেকে পুরো এক মাস ক্যাম্পে বন্দি রেখে প্রতিদিন দিনে-রাতে তাকে করা হয়েছে ‘গণধর্ষণ’। অব্যাহত পাশবিক অত্যাচারে একদিন জ্ঞান হারান রত্না। পাকিস্তানি সেনারা তাকে মৃত ভেবে স্থানীয় এক রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে যায়। এই সময় রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বাদল কান্তি চক্রবর্তী নামের এক ব্যক্তি রত্নাকে দেখতে পেয়ে কাছে গিয়ে দেখেন তার দেহে প্রাণ রয়েছে। তিনি তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। সুস্থ করতে সব রকম ব্যবস্থা করেন। সুস্থ হওয়ার পর রত্নাকে বিয়ে করেন এই বাদল চক্রবর্তী।

রত্না জানান, হানাদার বাহিনী যখন তাকে ধরে নিয়ে যায় তখন তিনি ছিলেন স্থানীয় সুখছড়ি কলাউজান উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী। যুদ্ধ আর হানাদার বাহিনীর হাতে আটক হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে তার এসএসসি পরীক্ষা দেয়া হয়নি। বিয়ের পর স্বামী বাদল চক্রবর্তীর উৎসাহে আবার স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৭৩ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ঘোষিত ফলাফলে দ্বিতীয় বিভাগে উর্ত্তীর্ণ হন রত্না। পরে উচ্চ মাধ্যমিকে কলেজে ভর্তি হলেও দারিদ্রতা, সংসার, প্রতিবন্ধকতার কারণে পড়ালেখা আর করা হয়নি।

যুদ্ধ পরবর্তী স্বামীর সংসারে অভাব অনটনে দিন কেটে গেলেও ২০১৫ সালে তার উপর নেমে আসে বিপর্যয়। স্বামী বাদল চক্রবর্তী অসুস্থ হয়ে অর্থাভাবে এক রকম বিনা চিকিৎসাতেই মৃত্যু বরণ করেন। ওই সময় বাদল চক্রবর্তী ছিলেন মার্কেট ক্লিনার। বাদল চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর রত্না চক্রবর্তী নিজের জীবন ধারণ করতে ক্লিনার হিসেবে কাজ নেন শপিং মল আফমি প্লাজায়।

রাইজিংবিডিকে রত্না বলেন, তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেরাও ক্লিনার ও দিনমজুরের কাজ করলেও মা-কে তেমন সহায়তা করতে পারেন না। চট্টগ্রাম মহানগরীর পশ্চিম বাকলিয়া দেওয়ান বাজার ভরাপুকুর পাড় এলাকায় মাসিক ৭ হাজার টাকায় ভাড়ায় এক ছোট্ট বাসায় বসবাস করেন। বাসা ভাড়া দিয়ে এক সন্তান মাকে সহায়তা করলেও মায়ের ভরন পোষন চালাতে পারেন না সন্তান। ফলে মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতনে দৈনিক ১২ ঘণ্টা ক্লিনার হিসেবে কাজ করতে হয় তাকে।

রত্না বলেন, মার্কেটের তৃতীয় তলার নারীদের টয়লেট এবং মার্কেটের ফ্লোর ঝাড়ু দেয়া এবং পানি দিয়ে মুছে পরিষ্কার করা তার প্রতিদিনের রুটিন। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এক টানা ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। মাঝখানে দুপুরের খাবারের জন্য ১ ঘণ্টা বিরতি পাওয়া যায়। কিন্তু ৫ হাজার টাকায় একমাস খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়না।

রত্না জানান, নানা আবেদন নিবেদন করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সার্বিক সহযোগিতায় চলতি বছরের ২৯ জুলাই ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি মিলেছে তার। এছাড়া গতমাসে চট্টগ্রাম বিভাগের শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসেবে সম্মাননাও দেয়া হয়েছে রত্না চক্রবর্তীকে।

রত্না জানান, বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি পেলেও তিনি এখনো কোন সরকারি ভাতা পান না। জেলা প্রশাসকের দপ্তরে তার সরকারি ভাতা প্রাপ্তির ফাইলটি আটকে রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তদবির করতে না পারায় তার সরকারি সহায়তার দ্বারটি মুক্ত হচ্ছে না।

রত্না কান্না জড়িত কণ্ঠে রাইজিংবিডিকে বলেন, সরকারি ‌ ন্যূনতম সাহায্য সহযোগিতা পেলে তিনি এমন কষ্টের ক্লিনারের কাজ ছেড়ে দিতেন। ৬৮ বছর বয়সে এসেও এতো পরিশ্রমের কাজ করা সম্ভব হয় না। তারপরও জীবন ধারনের তাগিদে একান্ত বাধ্য হয়েই এই কাজ করে যেতে হচ্ছে।

আফমি প্লাজা মার্কেটের সবার প্রিয় ‘মাসি’ রত্না চক্রবর্তী সম্পর্কে আফমি প্লাজা প্রপার্টিজের সহকারী ব্যবস্থাপক স্বপন মুহুরী রাইজিংবিডিকে জানান, এক ক্লিনিং কোম্পানির হয়ে রত্মা চক্রবর্তী এই মার্কেটে ক্লিনারের কাজ করে যাচ্ছেন দীর্ঘ ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে। তিনি টানা ১২ ঘণ্টা পরিশ্রম করেন। ক্লিনিং কোম্পানিটি মাসে ৫ হাজার টাকা বেতন দেয় তাকে।

৭১ এর একজন বীরাঙ্গনা’র এই বয়সেও এমন অমানবিক কাজ কখনো মেনে নেয়া যায়না। তিনি যাতে সরকারিভাবে নিয়মিত মাসিক ভাতা পেতে পারেন সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানান স্বপন মুহুরী।

মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ী রাইজিংবিডিকে জানান, সরকারিভাবে জয়ীতা সম্মাননা পাওয়ার পর মার্কেটের সবাই জানতে পেরেছেন তাদের ‘মাসি’ রত্না চক্রবর্তী একজন বীরাঙ্গনা। কিন্তু যার সম্ভ্রম ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি তেমন এক নারী মার্কেটে ক্লিনারের কাজ করে এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক।

সরকারের কাছে তার কি চাওয়া এমন প্রশ্নে রত্মা চক্রবর্তী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘দেশের জন্যই নিজের সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়েছি। ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছি। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি জুটলেও ন্যূনতম ভাতাটুকু জোটেনি। মাথা গোঁজার ঠাঁইও নেই। তাই টয়লেট ক্লিনিংএর মতো কাজ করে অন্ন যোগার করতে হয়। ন্যূনতম ভাতাটুকু পেলে এই কাজ করতে হতো না। ’

রত্না আরো বলেন, ‘সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক কিছুই করছেন, আমার খুব বেশি চাওয়া নয়। আর যতদিন বেঁচে আছি দুমুটো অন্ন যোগানোর মত ভাতা আর মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেই স্বস্থিতে মারা যেতে পারতাম। ’


চট্টগ্রাম/রেজাউল/বুলাকী

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়