ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ঐতিহ্য হারাচ্ছে শীতল পাটি, করোনায় দুর্দিনে পাটিকর

ঝালকাঠি প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৫, ২৩ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
ঐতিহ্য হারাচ্ছে শীতল পাটি, করোনায় দুর্দিনে পাটিকর

‘পেয়ারা আর শীতল পাটি’ এই নিয়ে ঝালকাঠি। যারা শীতল পাটি তৈরি করেন তাদের ‘পাটিকর’ বলা হয়। প্লাস্টিকের পাটির চাহিদা বৃদ্ধিতে এমনিতেই পাটিকরদের সুদিন ফুরিয়েছে। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে করোনাভাইরাস। করোনার কষাঘাতে জর্জরিত ঝালকাঠির তিন শতাধিক পাটিকর পরিবার।

সচেতন মহলের দাবি, সরকারের উচিত করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুত এই শিল্পসংশ্লিষ্টদের প্রণোদনা দিতে হবে। পাটি বিক্রির মৌসুমে পাটিকরদের জন্য বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি অচিরেই হারিয়ে যাবে।

জেলার রাজাপুর উপজেলার হাইলাকাঠি ‘পাটি গ্রাম’ নামে পরিচিত। এই গ্রামে অধিকাংশ পাটিকরের বাস। গ্রামবাসীর জীবিকার প্রধান অবলম্বন পাটি তৈরি করে বিক্রি করা। গরমে সবচেয়ে বেশি পাটি বিক্রি হয়। সেই হিসেবে এটি পাটি বিক্রির মৌসুম। অথচ করোনার কারণে গ্রাহক নেই পাটি গ্রামে। খুচরা বিক্রি টুকটাক হলেও পাইকাররা বিভিন্ন জায়গা থেকে আসতে পারছে না পাটি কিনতে। ফলে বিক্রি নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোটায়। এতে পাটিকররা পড়েছেন চরম দুরবস্থায়। এই ভরা মৌসুমে পাটি তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করবেন নাকি সংসার সামলাবেন- এই দুশ্চিন্তায় পাটিকরদের কপালে পড়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।  

গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি ক্রমশ বাজার হারাচ্ছে। এই দুশ্চিন্তাকে সঙ্গী করেই পাটিকরেরা বংশ পরম্পরায় এই পেশা বেছে নেয়। ফলে অন্য পেশার সঙ্গে তারা দ্রুত সম্পৃক্ত হতে পারে না। পুঁজির অভাব এর অন্যতম কারণ। স্থানীয় তপন ও বিজয় পাটিকর বলেন, সরকারি সহযোগিতায় অল্প সুদে ঋণ পেলে এবং সরকার বাজারজাত করণের উদ্যোগ গ্রহণ করলে শীতল পাটির বাজার পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এই করোনা আমাদের সব আশা ভরসা শেষ করে দিচ্ছে।

হাইলাকাঠি গ্রামসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, ৮-১০ বছরের শিশুরাও নিপুণ কারুকাজে পাটি তৈরি করছে। তারা পরিবারে বড়দের কাজে এভাবেই সাহায্য করে। এই গ্রামের চিকন বেতির শীতল পাটির চাহিদা রয়েছে। পাইত্রা বা মোর্তা নামে এক ধরনের বর্ষজীবী উদ্ভিদের কাণ্ড থেকে বেতি তৈরি করা হয়। পরিপক্ক গাছ কেটে পানিতে ভিজিয়ে রেখে তারপর কাণ্ড থেকে পাটির বেতি তোলা হয়। এরপর ভাতের মাড় ও পানি মিশিয়ে বেতি জ্বাল দেওয়া হয়। এতে বেতি হয়ে ওঠে মসৃণ এবং সাদাটে। বেতির উপরের খোলস থেকে শীতল পাটি, নিচের অংশ তুলে বুকার পাটি এবং অবশিষ্ট অংশ ছোটার (চিকন দড়ি) কাজে ব্যবহার করা হয়।

গ্রামের শত শত হেক্টর জমিজুড়ে রয়েছে পাটিগাছের বাগান। এখানে শীতল পাটি, নামাজের পাটি ও আসন পাটি নামে তিন ধরনের পাটি তৈরি করা হয়। পাটির বুনন পদ্ধতি প্রধানত দুই ধরনের। পাটির জমিনে ‘জো’ তুলে তাতে রঙিন বেতি দিয়ে নকশা করা পাটি এবং পাটির জমিন তৈরি হলে তার চারপাশে অন্য বেতি দিয়ে মুড়ে দেওয়া পাটি। শৈল্পিক উপস্থাপনা এবং নির্মাণ কুশলতার কারণে দুই ধরনের পাটিরই দেশে চাহিদা রয়েছে। এমনকি এই পাটি বিদেশের রপ্তানি হয়। যদিও শীতল পাটি এদেশের রপ্তানীযোগ্য পণ্যের স্বীকৃতি আজও পায়নি। 

একটি পাটি বুনতে ৩-৪ জনের দুই দিন সময় লাগে। বিক্রি করে পাঁচশ থেকে হাজার টাকা পাওয়া যায়। পাইত্রা চাষ ও কেনার জন্য মূলধন প্রয়োজন। এ জন্য পাটিকরেরা মহাজন বা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। মহামারির এই কালে ঋণের সুদ পাটিকরদের জন্য বাড়তি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মঞ্জু রানী পাটিকর হিসেবে কাজ করছেন দীর্ঘদিন। এই পেশায় এমন দুর্দিন তিনি এর আগে কখনও দেখেননি। মঞ্জু রানী বলেন, এ বছর মেলার বিক্রিও নাই! গ্রামেগঞ্জে মেলা বসে নাই এ বছর। অথচ ঋণ নিয়ে পাইত্রা কিনে পাটি তৈরি করে রেখেছিলাম বৈশাখের মেলায় বিক্রির জন্য। এখন সুদ টানতে হচ্ছে। সরকার বিনাসুদে ঋণ দিলে আমাদের খুব উপকার হতো।

পাটি শিল্পী সমিতির সভাপতি বলাইচন্দ্র পাটিকর বলেন, সরকার কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসএমই খাতের আওতায় ঋণ দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ২৫ জন পাটিকর ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ পেয়েছে। তবে বিনাসুদে ঋণ দিলে আমরা উপকৃত হতাম।

ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী বলেন, ‘চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিপণন ত্রুটি থাকায় বছরের একটা সময় পাটিকরদের বসে থাকতে হয়। করোনা অন্যান্য পেশাজীবীদের মতো তাদেরও দুর্ভোগে ফেলেছে। আমরা সরকারের অতি দরিদ্র কর্মসৃজন কর্মসূচির মাধ্যমে পাটিকরদের কাজের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।’ এখন পাটিকরদের পাটি বিক্রি বন্ধ থাকায় তাদের সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি।



ঝালকাঠি/অলোক সাহা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়