ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ফুটবলার ইতি ও সাথির গল্প মানুষের মুখে মুখে 

মাগুরা প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৪, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২   আপডেট: ১২:৫৬, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২
ফুটবলার ইতি ও সাথির গল্প মানুষের মুখে মুখে 

বাংলাদেশ সাফ নারী চ্যাম্পিয়ন দলের গোলকিপার ইতি রানী মণ্ডলের বাবা-মা

মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার নিভৃত গোয়ালদহ গ্রামের দুই মেয়ে সাথি বিশ্বাস (১৭) ও ইতি রানী মণ্ডল (১৬)। এবার নারী সাফ চ্যাম্পিয়ন দলে অতিরিক্ত গোলকিপার হিসেবে বাংলাদেশ দলে ছিলেন তারা। নেপালকে ফাইনালে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় এখন মাগুরার প্রতিটি মানুষের মুখেই ইতি-সাথির নাম উচ্চারিত হচ্ছে।

ইতি এবং সাথি দুজনই বড় হয়েছেন দরিদ্র পরিবারে। প্রথম দিকে মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে এলাকার লোকজন অনেকেই নেতিবাচক নানা কথা বললেও এখন তারাই ইতি-সাথির প্রশংসা করছেন। তাদের নিয়ে গর্ববোধ করছেন।

ইতি রানী মণ্ডলের বাবা মনোজিৎ কুমার মণ্ডল। পেশায় ভ্যানচালক। পাশাপাশি ডেকোরেটরের দোকানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। ২০ শতক জমিতে ছোট দুটো টিনের ঘর আছে তার। মাঠে কোনো জায়গা জমি নেই। ভ্যান চালিয়ে ও দিনমজুরের কাজ করে চার মেয়ের তিনজনকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে ইতি রানী মণ্ডল এখন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের সদস্য।

মনোজিৎ কুমার বলেন, ‘ইতি যদি ফুটবল না খেলত, তালি ওর এত দিন বিয়ে হয়ে যেত। এখনকার মতো সাহস পালি (পেলে) অন্য মেয়েদের অত অল্প বয়সে বিয়ে দিতাম না।’

তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের নিয়ে নানা রকম দুশ্চিন্তায় ভুগতে হয় বাবা–মায়ের। বিয়ে দিতে না চাইলেও মানুষজন নানাভাবে চাপ দেয়। তবে ইতির মতো হতে পারলে তাকে নিয়ে মা–বাবার আর চিন্তা নেই। বড় তিন মেয়েকে খুব অল্প বয়সে বিয়ে দিছি। পড়ালেহা করাতি পারিনেই। সবাই কইছে মায়ে ঝিপুত ঘরে পুষে লাভ কী? ছাওয়াল (ছেলে) পাইছ বিয়ে দিয়ে দেও।’  

বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকালে গোয়ালদহ গ্রামে ইতিদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় ইতির বাবা মা খুবই খুশি। 

তিনির মা উন্নতি রানী মণ্ডল বলেন, ‘ফাইনাল খেলার দিন সারা দিন না খেয়ে ছিলাম। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার এক দিন পরেও মেয়ের সঙ্গে কথা হয়নি একটি স্মার্টফোন নেই বলে। আমাদের চার মেয়ে। কোনো ছেলে নেই। তাতে এখন আর কোনো দুঃখ নেই। অনেক সময় টাকা ধার করে টাকা দিছি। এখন এতটাই আনন্দ হচ্ছে যে কান্না চলে আসতেছে বারবার।’

সাথি বিশ্বাসের বাবা-মা

গোয়ালদহে সাথিদের বাড়িতে কথা হয় তাঁর বাবা বিদ্যুৎ কুমার বিশ্বাস ও মা সুদেবী বিশ্বাসসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে।

সাথির দাদা বৈকণ্ঠ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘গোয়ালদহে শিক্ষকদের উদ্যোগে প্রথম যে মেয়েদের নিয়ে ফুটবল অনুশীলন শুরু হয়, তাদের একজন সাথি বিশ্বাস। ওই সময়ে সাথির পরিবার মেয়েকে ফুটবল খেলতে দিতে আগ্রহী ছিলেন না। মূলত শিক্ষকদের অনুরোধেই সাড়া দিয়েছিল তার পরিবার।’

তিনি আরও বরেন, ‘আমারা দরিদ্র মানুষ। মেয়েরা যখন ফুটবল খেলা শুরু করে, তখন এলাকার লোকজন বলত মেয়েদের তো নষ্ট করে ফেলতিছ। এখন তারাই বলে তোমার নাতিন তো মানুষ হয়ে গেছে। এলাকায় আমাদের সুনাম বেড়েছে। এখন আমার আরও নাতনি বিকেএসপিতে (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) খেলতেছে।’

বিদ্যুৎ কুমার বিশ্বাসের বাজারে একটা ছোট স্টুডিও আছে। সেখান থেকে আসা অল্প আয়েই চলে তার সংসার।

বিদ্যুৎ কুমার বলেন, ‘আমার মেয়ে এত দূর যাবে ভাবিনি। দেশ–বিদেশে খেলতে যাচ্ছে, এটা বিশাল কিছু মনে হয়। এবার মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিল সাথি বিশ্বাস। তবে সাফে খেলতে যাওয়ার কারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি সে।’ 

মা সুদেবী বিশ্বাস বলেন, ‘পরীক্ষা দেবে না খেলতে যাবে, এটা জিজ্ঞেস করেছিল। আমি ওর শিক্ষকদের ওপরে ছেড়ে দিয়েছিলাম। দেশের জন্য খেলে ও যে সম্মান এনেছে, এতে আমি খুবই খুশি।’

সাথি ও ইতি ফুটবল খেলা শুরু করেছিল গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। সেখান থেকে বিকেএসপি হয়ে এখন জাতীয় দলের সদস্য তারা।

স্থানীয় লোকজন জানান, গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রভাস রঞ্জন দেবজ্যোতি ও সহকারী শিক্ষক শহিদুল ইসলামের উদ্যোগে এলাকায় মেয়েদের ফুটবল খেলা ও অনুশীলন শুরু হয়। কয়েক বছর ধরে সকাল–বিকেল দুই বেলা বিদ্যালয়ের মেয়েদের ফুটবল অনুশীলন করান এই দুই শিক্ষক। তাতে সফলতাও এসেছে। 
জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি এখন পর্যন্ত এই বিদ্যালয় থেকে ১৪ জন মেয়ে বিকেএসপিতে সুযোগ পেয়েছে। তার মধ্যে ৮ জনসহ মোট ১০ জন মেয়ে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলছেন।

প্রধান শিক্ষক প্রভাস রঞ্জন দেবজ্যোতি বলেন, মেয়েরা নিজেদের গ্রামসহ মাগুরার নাম উজ্জ্বল করেছে, এতেই আমি খুশি।’

মাগুরা জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলম নিজের ফেসবুক আইডিতে সাফ জয়ী দলের সদস্য মাগুরার দুই নারী ফুটবলারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। 

তিনি লেখেন, ‘মাগুরায় আসার পর দুই নারী ফুটবলারকে সম্মান জানানোর উদ্যেগ নেওয়া হবে।’

শাহীন/ মাসুদ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়