ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ছররা গুলিতে সিয়ামের মৃত্যুর অভিযোগ, পুলিশের মামলায় ভিন্ন বয়ান

এনাম আহমেদ, বগুড়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৪, ১৮ আগস্ট ২০২৪   আপডেট: ১০:৫৫, ১৮ আগস্ট ২০২৪
ছররা গুলিতে সিয়ামের মৃত্যুর অভিযোগ, পুলিশের মামলায় ভিন্ন বয়ান

পুলিশের ছররা গুলিতে বগুড়ায় সিয়াম শুভ নামে এক কিশোরের মৃত্যুর অভিযোগ উঠলেও পুলিশের দায়ের করা মামলায় ভিন্ন বয়ান দেওয়া হয়েছে। 

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আন্দোলনকারীদের ছোড়া ককটেল বিস্ফোরণে আহত হয়ে সিয়াম শুভ নিহত হয়েছেন। তবে হাসপাতালের ডাক্তার, নিহতের স্বজন ও স্থানীয় লোকজন গুলিতে মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন। 

গত ২১ জুলাই রোববার সদর থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মো. জাকির আল আহসান মামলাটি করেন। 

মামলায় বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ভিপি সাইফুলকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। ২ নং আসামি করা হয়েছে ওই এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর এরশাদুল বারীকে। এছাড়া মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন এবং জামায়াতের মোট ৩৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত অনেককে আসামি করা হয়েছে।

এর আগে ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে পুলিশ এবং আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষকালে গুলিতে গুরুতর আহত হন সিয়াম শুভ।  

পরে চিকিৎসার জন্য বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে ওই সময় হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. আবু সালেহ সিয়ামকে মৃত ঘোষণা করে। তিনি ওই দিন সিয়ামের মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ হিসেবে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, একাধিক ছররা গুলি শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে প্রবেশ করায় সিয়ামের মৃত্যু হয়েছে।

সিয়ামকে শজিমেকের আগে নিয়ে যাওয়া হয় সেউজগাড়ী এলাকায় অবস্থিত বগুড়া নার্সিং হোম ক্লিনিকে।  ক্লিনিকের চেয়ারম্যান ডা. এএইচএম মুশিহুর রহমান ওই সময় বলেছিলেন, সিয়ামকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আন্দোলনকারীদের কয়েকজন আমার ক্লিনিকে নিয়ে আসে। তখন আমি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তাকে জীবিত পাইনি। সে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেছিলো। 

তিনি আরও জানিয়েছিলেন, সিয়ামের শরীরে অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন পেয়েছেন তিনি। তার দুই চোখের ভেতরে গুলি ঢুকে মাথার ভেতরে চলে গিয়ে মৃত্যু হতে পারে। 

এদিকে, ২১ জুলাই পুলিশের দায়ের করা মামলার এজাহারের একটি অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, ১ নং আসামি ভিপি সাইফুল ও ২নং আসামি এরশাদুল বারী এরশাদের নেতৃত্বে ও মদদে হাতে লাঠি নিয়ে মামলার সকল আসামি বেআইনি জনতায় দলবদ্ধ হয়ে অতর্কিতভাবে কর্তব্যরত পুলিশের সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টিসহ পুলিশকে লক্ষ্য করে বেপরোয়া বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ও বিস্ফোরক দ্রব্য ককটেল নিক্ষেপ করতে থাকে। মামলার ১৭ নং আসামি থেকে ২৩ নং আসামিরা ‍পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করতে থাকে।  এ সময় ১৮ নং আসামি বগুড়া জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী রিগ্যানের ছোড়া ককটেল বিস্ফোরণে মামলার বাদীসহ তিনজন পুলিশ আহত হন। পরে আসামিদের ধাওয়া করলে তারা পুনরায় পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ছুড়লে আসামিদের সঙ্গী সিয়াম এর কপাল, মুখমণ্ডল, বুক, পেট, দুই হাত ও পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর জখম হয়। পরে স্থানীয় লোকজন সিয়ামকে উদ্ধার করে শজিমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত সিয়ামের স্বজন ও প্রতিবেশী সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ বছর আগে সিয়ামকে বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনে কুড়িয়ে পান তার বর্তমান হাড্ডিপট্টি বস্তির বাসিন্দা শাপলা বেগম। পরে সিয়ামকে বাড়িতে নিয়ে আশিক-শাপলা দম্পতি সিয়ামকে লালন-পালন করেন।

সিয়ামের পালিত বাবা মো. আশিক বলেন, সিয়ামের আসল বাড়ি বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার কড়িরহাট গ্রামে। তার বাবার নাম বাবলু মিয়া। মায়ের নাম আয়েশা বেগম। তারা দু’জনই মৃত। তার বাবা-মা কি করতো সেটা আমরা জানি না। যখন সিয়ামকে কুড়িয়ে পাই তখন ওর বয়স ছিলো ৯ বছর। সে আমাদের যেটুকু বলেছে সেটাই জানি। সে আমাদের বাড়িতেই ছিলো। ছোট বেলায় অল্প কিছুদিন লেখাপড়া করেছে। পরে বড় হওয়ার পর আর লেখাপড়া করেনি। আমাদের আরো দুই ছেলে দুই মেয়ে রয়েছে। তারা লেখাপড়া করে। 

আশিক বলেন, সিয়াম ভাঙ্গারি কুড়ানোর কাজ করতো। তার মৃত্যু কিভাবে হলো জানতে চাইলে আশিক বলেন, সেদিন সে ভ্যান নিয়ে ভাঙ্গারি কুড়াতে গিয়েছিলো। এরপর কুড়িয়ে আসার পর ভ্যান রেখে সেউজগাড়ীতে ভাত খেতে গিয়েছিলো। ওই সময় সে গুলি খায়।  সিয়ামকে বগুড়ার নামাজগড় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। সিয়ামের মৃত্যুর পর প্রশাসন থেকে কোন খোঁজ খবর বা সাহায্য সহযোগিতা করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে আশিক বলেন, প্রশাসন থেকে কোন খোঁজ খবর বা সাহায্য সহযোগিতা করা হয়নি।

মেডিক্যালের মর্গ থেকে সিয়ামের লাশ নিতে গিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মো. ফারুক হোসেন।  তিনি বলেন, সিয়ামের মুখে এবং বুকে অজস্র ছররা গুলির চিহ্ন ছিলো। মামলায় দেখলাম ককটেলের বিস্ফোরণে হাতসহ বুক মুখে ক্ষত হয়েছে। লাশের হাতে আমরা কোনো ক্ষত পাইনি।  এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলা। তিনি বলেন, পুলিশ গুলি করে হত্যা করে সেটা চাপিয়েছে বিএনপি এবং জামায়াতের নেতাকর্মীদের উপর।

এদিকে সিয়ামের লাশ দেখেছেন তার প্রতিবেশি আমেনা বেগম। তিনি বলেন, সিয়ামের বুক, মুখ পুরোটাই ঝাঝরা ছিলো। সে ভাঙ্গারি কুড়িয়ে খাবার খেতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যায়।

মামলার আসামি বগুড়া জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী রিগ্যান বলেন, মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম, ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এরশাদুল বারী এরশাদ ও যুবদলের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীরের হুকুমে আমার ছোড়া ককটেলের আঘাতে সিয়ামের মৃত্যু হয়েছে।  সিয়াম নিহত হওয়ার ঘটনাটি দিনের বেলা রাস্তার উপরের ঘটনা। সেখানে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা ছিলো। কার গুলিতে কিভাবে নিহত হয়েছে সেটা সবাই দেখেছে। সেটার ভিডিও ফুটেজ, চাক্ষুস স্বাক্ষী সবই আছে। ছাত্র জনতার উপর হামলা করে আন্দোলন দমন করার জন্য, স্বৈরাচারকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা অন্যায়ভাবে এ মামলা করেছে।

জানতে চাইলে মামলার বাদী সদর থানার এসআই জাকির আল আহসান বলেন, মামলার কপি তার কাছে নেই। কাগজ না দেখে তিনি বলতে পারবেন না এজাহারে কি লেখা আছে । ডাক্তাররা কি বলেছে সেটাও বলতে পারবেন না তিনি। তিনি বলেন, মামলাটি ডিবিতে দেওয়া হয়েছে। তারাই এটা নিয়ে কাজ করছে। 

মামলার ইনভেস্টিগেশন অফিসার কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিবি’র ওসি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সম্পর্কে বলতে পারবেন।

বগুড়া ডিবি পুলিশের ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য একটা সিদ্ধান্ত প্রাথমিকভাবে হয়েছে। লিখিত চিঠি হয়তো পেয়ে যাবো। এই মামলায় এখন পর্যন্ত ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বগুড়া পুলিশ সুপার জাকির হাসান বলেন, মামলার বিষয়টি পুনরায় তদন্ত করে দেখা হবে।

/টিপু/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়