ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৩ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বানরের জন্য গড়া ইকোপার্কটি এখন আধুনিক রিসোর্ট

বেলাল রিজভী, মাদারীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৬, ২ নভেম্বর ২০২৫   আপডেট: ১১:৩৯, ২ নভেম্বর ২০২৫
বানরের জন্য গড়া ইকোপার্কটি এখন আধুনিক রিসোর্ট

মাদারীপুরের চরমুগুরিয়া এলাকায় প্রায় ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ইকোপার্ক।

মাদারীপুরের চরমুগুরিয়া এলাকায় প্রায় ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ইকোপার্কটি যেন অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিতে অচলাবস্থায় পরিণত হয়েছে। বানরের আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তোলা এই পার্কে নেই বানরের খাবার কিংবা উপযুক্ত আবাসের ব্যবস্থা। তবে রয়েছে বহুতল ভবন, বিশাল আকারের সুইমিং পুল, চারটি পিকনিক স্পট, অর্কিড হাউস ও চিলড্রেন কর্নার।

একসময় মাদারীপুর শহরের বানর ছিল সারা দেশে পরিচিত। সদর উপজেলার চরমুগুরিয়া, নয়ারচর ও আশপাশের এলাকায় শত শত বানর অবাধে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বনভূমি ও খাদ্যাভাবে বানরগুলো শহর-গ্রামে ঢুকে মানুষের ঘরে খাবার খুঁজতে শুরু করে। সংসদেও একাধিকবার বিষয়টি আলোচনায় আসে।

সেই সংকট নিরসনে ২০১৬ সালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘চরমুগুরিয়া বানর অভয়াশ্রম’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রায় সাড়ে ১০ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় প্রথম ইকোপার্ক। প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল বানরের জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরি, খাদ্যোপযোগী বৃক্ষরোপণ এবং ইকোট্যুরিজমের মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতি সচল করা।

প্রথম পর্যায়ে ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় পার্কের সীমানা প্রাচীর, বানরের থাকার শেড, রাস্তা ও কিছু ছোট স্থাপনা। প্রকল্পে বলা হয়েছিল কাঁঠাল, পেয়ারা, ডুমুর, আম প্রভৃতি গাছ লাগানো হবে, যেন বানরের খাদ্যাভাব মিটে যায়। কিন্তু বাস্তবে বানরের খাবার উপযোগী গাছ লাগানো হয়নি। অথচ কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঠিকাদার সম্পূর্ণ বিল তুলে নেয়।

প্রথম প্রকল্পটি কোনো কাজে না আসায় ২০২০ সালে নতুন করে ‘চরমুগুরিয়া ইকোপার্ক আধুনিকায়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। এর অনুমোদিত ব্যয় ধরা হয় ৩১ কোটি ৭৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা। পরবর্তীতে প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় বাড়ানো হয় ১ কোটি টাকা, আর দ্বিতীয় সংশোধনীতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ কোটি ৭৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।

সরকারি নথি অনুযায়ী, এই প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের ঠিকাদার ছিলেন সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ভাই হাফিজুর রহমান যাচ্চু খান। মোট ১১টি প্যাকেজে কাজ হাতে নেওয়া হয়। তবে স্থানীয় সূত্র বলছে, প্রকল্পের কাজের বেশিরভাগই ছিল কাগজে-কলমে।

২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দুই দফায় প্রায় ৬৫ কোটি টাকার প্রকল্প এখন কার্যত অচল।

প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল বানরের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবে ইকোপার্কে বানরের দেখা মেলে না। পুরো এলাকায় চোখে পড়ে শুধুই পাকা স্থাপনার জৌলুস। বিশাল আকারের সুইমিং পুল, তিন তলা অফিস ভবন, বহুতল পানির ট্যাংক, চারটি পিকনিক স্পট, চিলড্রেন কর্নার, অর্কিড হাউস এবং বিশাল সীমানাপ্রাচীর ও গেট।

বানরের জন্য মাত্র একটি ছোট শেড ও চিকিৎসা কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। ফলে নামমাত্র বানর অভয়াশ্রম হলেও বাস্তবে এটি রূপ নিয়েছে ‘রিসোর্টমুখী অবকাঠামো প্রকল্পে’।

স্থানীয়রা বলছেন, এখন পার্কে মানুষ ঘুরতে আসে কিন্তু বানরগুলো আগের মতোই শহরজুড়ে ঘুরে ঘুরে খাবার খোঁজে।

চরমুগুরিয়া এলাকার বাসিন্দা ফিরোজ মাহমুদ বলেন, “বানরের উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে সরকার দুই দফায় প্রায় ৬৫ কোটি টাকা খরচ করেছে। অথচ বানরের কোনো উন্নয়ন হয়নি, বানরের কোনো উপকারও হয়নি। লাভবান হয়েছে ঠিকাদাররা।”

নয়ারচর এলাকার গৃহবধূ সালমা বেগম বলেন, “প্রতিদিন বানর ঘরে ঢুকে খাবার নিয়ে যায়। যদি ইকোপার্কটা সত্যিই শেষ হতো, তাহলে আমরা শান্তিতে থাকতে পারতাম। বানরগুলোরও আশ্রয় হতো।”

মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, “এই প্রকল্পে অর্থ ব্যয় হয়েছে পরিকল্পনার বাইরে। যে প্রকল্প বানরের জন্য নেওয়া হয়েছিল, সেটি এখন পর্যটনকেন্দ্র বানানোর নামে দুর্নীতির খাতায় যুক্ত হয়েছে।”

সামাজিক বন বিভাগের মাদারীপুর কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “ইকোপার্ক প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। দ্রুত সমাধানের আশ্বাস পাওয়া গেছে।”

মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আল-নোমান বলেন, “প্রকল্পটি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ। অনিয়মের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

স্থানীয় বনবিভাগের কেউই জানেন না মোট কত টাকা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তুলে নিয়েছে এবং কত ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। সরকারি কোনো দপ্তরেই নেই সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি প্রতিবেদন।

ইকোপার্ক আধুনিকায়নের প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, “জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও পরিবেশের উন্নয়ন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, বানরের আবাসস্থল সৃষ্টি ও খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা, এবং ইকোট্যুরিজমের মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন।”

অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে- বানরের কোনো আশ্রয় তৈরি হয়নি, খাদ্যোপযোগী গাছ লাগানো হয়নি বরং প্রকল্পটি রূপ নিয়েছে কংক্রিটের পার্কে।

স্থানীয় সচেতন মহল বলছে, ইকোপার্কের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও বাস্তবে কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন নেই। তারা মনে করেন, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে দুর্নীতি ছিল প্রকট।

মাদারীপুরের সাংবাদিক শফিক স্বপন বলেন, “ইকোপার্ক প্রকল্পটি মাদারীপুরের পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ হিসেবে পরিচিত হতে পারত। কিন্তু পরিকল্পনার স্বচ্ছতা ও তদারকি না থাকায় এটি এখন দুর্নীতির দৃষ্টান্ত।”

যে প্রকল্প বানর রক্ষা ও পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল, তা এখন অর্ধনির্মিত স্থাপনা ও অপচয়ের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও বানরগুলো এখনো শহর ও গ্রামে খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। আর চরমুগুরিয়া ইকোপার্ক পড়ে আছে নিঃসঙ্গ ও নিস্তব্ধ যেন সরকারি অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত।

ঢাকা/এস

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়